ডিপিডিসির দুর্নীতির সোনার হরিণ সোনা মনি চাকমা’র হাতে
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ১২:৫৮ অপরাহ্ন, ২১শে সেপ্টেম্বর ২০২৪
দুর্নীতি, অনিয়ম আর ক্ষমতার অপব্যবহারের কত রূপ, তা দেখাচ্ছেন ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (এডমিন এন্ড এইচ আর) সোনা মনি চাকমা। বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সম্পদ গড়ার পাশাপাশি অসাধু উপায়ে কামাচ্ছেন কাড়িকাড়ি টাকা। ক্ষমতার দাপটে কাউকেই যেন গ্রাহ্য করেন না। টাকা ছাড়া কিছুই বোঝেন না এই দাপুটে কর্মকর্তা। এ যেন ডিপিডিসির দুর্নীতির সোনার হরিণ। এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগ পত্র জমা পড়েছে। আরো অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার শ্যালক অপু চাকমাকে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছেন ডিপিডিসির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের। তাকে টাকা দিলে মিলে যাচ্ছে পদোন্নতি কিংবা পছন্দের বদলি। দুর্নীতি করেও নানা কারিশমায় পার পেয়ে যাচ্ছেন তিনি।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, সোনামনি চাকমার বন্ধু দীলিপ কুমার ত্রিপুরাকে টেকনিক্যাল সুপারভাইজার পদে বসাতেই কাকরাইল ডিভিশনের টেকনিক্যাল সুপারভাইজার মো. ইউসুফ আলীকে চাকরি থেকে অব্যাহতির হুমকি দেন তিনি। সহকর্মীদের কাছে প্রকাশ্যেই কাকরাইলের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান জনবাণীকে বলেন, সোনা মনি চাকমা স্যারের নির্দেশে ইউসুফ আলীকে অব্যাহতি নিতে বলেছি। গত মার্চ মাস থেকে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন সুপারভাইজার মো. ইউসুফ। তার বিরুদ্ধে নেই কোনো অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ। গত ১০ জুলাই মিটার টেম্পারিংয়ের দায়ে এক গ্রহকের সংযোগ বিচ্ছন্ন করা হয়। এ সময় গ্রহক স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন, তাতে গ্রাহক মো. আইয়ুম আলী (যাহার গ্রাহক নং- ১৯২৯১১৩১, হোল্ডিং নং- ৪৩/৭, নিউ ইস্কাটন রোড) বলেন, আমার বাসায় এবং গাড়ীর গ্যারেজে দুইটি মিটার টেম্পার করি প্রায় ৭/৮ বছর আগে। প্রতি মাসে মিটারে বিল দিয়ে যাচ্ছি। এখন বর্তমান মিটার রিডার মো.আব্বাস আলীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার করে টাকা দেই। আব্বাস আলী আমাকে বলেছে এভাবে টেম্পার মিটার চালালে আমাকে ১০ হাজার টাকা দিবেন আপনার কোন সমস্যা হলে সব সমস্যা আমি দেখবো। এখন দুইটি টেম্পিং অবস্থায় ধরা হয়েছে। তারপর বিদ্যুত অফিস থেকে ডিপিডিসির ফোরম্যান লোকমানসহ ১০ জনের এাকটি টিম এসে মিটার দুইটি সীললাগা করেন। বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মিটার দুইটি আমার হেফাজতে দিয়ে যায়। এর পরে অফিসের সবার সামনে মিটার রিডার আব্বাসকে ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান হুমকি দিয়ে বলে এখন তোমার চাকরি চলে যাবে। নিজে বাচঁতে হলে অন্য কারো নাম বলো। তখন আব্বাস স্বীকার করেছেন আমার সঙ্গে কেউ ছিলো না স্যার আমি প্রতি মাসে এই গ্রহকের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নিতাম। এখন যেভাবে পারেন স্যার আমাকে রক্ষা করেন। এর পরে এই ডিভিশনের আরেক সুপারভাইজার (কমার্শিয়াল) দীলিপ কুমার ত্রিপুরা সোনা মনি চাকমার বন্ধু হওয়ায় আলাদা দাপট রয়েছে। তখন আব্বাসকে রক্ষা করতে দুই লাখ টাকার চুক্তিবদ্ধ হয় এবং ওই পদে নিজে দখল করতেই ২৩ জুলাই গ্রহককে দিয়ে সুপারভাইজার ইউসুফের বিরুদ্ধে ৫ লাখ টাকা ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ এনে প্রশাসনিক কর্মকর্তা সোনা মনির কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়। ওই গ্রহককে ভুল বুঝিয়ে ৪০ লাখ টাকা জড়িমানা থেকে মুক্ত দিবে বলে সোনামনির বন্ধু দীলিপ কুমার ত্রিপুরা কথায় এই অভিযোগ দেওয়া হয়। ওই ডিভিশনের এক প্রকৌশলী বলেন, যদি সুপারভাইজার ইউসুফ গ্রহকের কাছে ঘুষ দাবি করতো, তাহলে কোনো ওইদিনই অভিযোগ করলো না। কেনো ১৩ দিন পরে অভিযোগ দিয়েছে। এতো তো বুঝা যায় সোনামনি স্যারের বন্ধু দীলিপ কুমারের সহযোগিতায় এই অভিযোগ দেওয়া হয়। দীলিপ কুমার গ্রহককে সঙ্গে নিয়ে ডিপিডিসির প্রধান কার্যলয়ে এই অভিযোগ জমা দেন। এই ঘটনার পর গত ৯ আগষ্ট মৌখিক ভাবে ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান সুপারভাইজার (টেকনিক্যাল) ইউসুফকে ডেকে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে চাপ দেন। এ সময় নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, সোনামনি চাকমা স্যার তোমাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে বলেছেন। তুমি যদি চাকরি না ছাড়া তাহলে আমরা তোমার বিরুদ্ধে মামলা করবো। কারণ তোমার ওই পদে দীলিপ কুমারকে আনা হবে। তখন ইউসুফ বলেন, আমি কোনো দোষ করেনি। নিয়ম মেনে পরিক্ষা দিয়ে চাকরি নিয়েছে। স্যার আমি চাকরি না করলে খাবো কি। সূত্র বলছে অভিযুক্ত গ্রহকের কাছ থেকে মোটা অংকের সুবিধা নিয়ে নতুন করে মিটার সংযোগ দিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, আমি এখানে চাকরি করতে চাই না। সোনা মনি স্যারের চাপে মন চায় চাকরি ছেড়ে দেই। সারাদিন চাপে থাকি। তা ছাড়া এখানে প্রধান উপদেষ্টা স্যারের বাস ভবন। তাই সব সময় মনিটরিং এ থাকতে হয়।
তিনি আরো বলেন, আমি বড় স্যারের (সোনা মনি) নির্দেশে সুপারভাইজার ইউসুফকে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে বলেছি। এমন কি বড় স্যারের কারণে ইউসুফকে অফিস করতে নিষেধ করা হয়েছে। আপনি আমার অফিসে আসেন সব বলি। আমি গ্রহকের বাসায় মিটার দিতে বাধ্য হয়েছি। শুধুমাত্র বড় স্যারের কারনে। তিনি আমাকে মিটার দিতে বলেছে।
গ্রাহককে জড়িমানা কেনো নেওয়া হলো না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বড় স্যার মিটার দিতে বলেছে। আমি জড়িমানা নিবো কিভাবে। এখনে চাকরি করতে ইচ্ছে করে না।
অভিযোগ রয়েছে, বৈধভাবে টাকা আয় যেন সোনামনি চাকমার নেশা ও পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব করতে তিনি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমাফিক যা খুশি তাই করছেন। আবার অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে কিংবা ঘুষ দিলে মুহূর্তেই যে কোনো ডিভিশনের বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়, তাতে যদি প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে ঘাটতিও থাকে। এভাবে ডিপিডিসির অধিকাংশ ডিভিশনে অনিয়ম-দুর্নীতির এক অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছেন ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (এডমিন এন্ড এইচ আর) সোনা মনি চাকমা। তার দপ্তরে প্রকৌশলীদের নানা অভিযোগ জমা পড়লেই ফাইলবন্দী ঘুষের নেশা মেতে উঠে।
এ প্রসঙ্গে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (এডমিন এন্ড এইচ আর) সোনা মনি চাকমা বলেন, আমি নির্দোষ, কোনো প্রকার অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে আমি যুক্ত নই। তা ছাড়া দিলীপ আমার কমিউনিটির কেউ না। আমাদের চেহারা অনেকটা একই হতে পারে। তবে সে আমার আত্মীয় নয়। আপনি অফিসে এসে দেখা করেন। তার পরে নিউজ করতে পারবেন।
এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতি বন্ধ না হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই দুর্নীতিবাজ যে হউক তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের(টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অনিয়ম, দুর্নীতির সঙ্গে যে বা যারা জড়িত তাদের বের করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। দুর্নীতি থাকলে দেশে সুশাসন থাকবে না।
এ ব্যাপারে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান বলেন, আমি ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়েছি। অধিকতর তদন্ত করে সঠিক তথ্য উদঘাটনের জন্য এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছি। সুপারিশ পাবার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জেবি/এসবি