মানবিক ও নৈতিক শিক্ষায় রমজান


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


মানবিক ও নৈতিক শিক্ষায় রমজান

বিশ্ব মুসলিম জাতির জন্য রমজান বিশেষ এক তাৎপর্যপূর্ণ মাস। রোজা এক মাসের কিন্তু শিক্ষা বারো মাসের। রমজান রহমতের ফল্গুধারা। রোজা ইবাদতের দরজা। রোজা শরীরের জাকাত। রোজা জীবনের পরিবর্তন আনে। রমজান ইবাদতের বসন্তকাল। রমজানকে মহান আলস্নাহতায়ালা বিস্ময়কর এবং অসাধারণ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল করেছেন। রোজা বাস্তবিকই আত্মিক নিয়মানুবর্তিতার একটি উপায়, যা মানুষকে নৈতিক শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে প্রকৃত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়। এমনিভাবে মাহে রমজানের মূল্যবোধ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য, সংযম, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। তাই রোজা এক মাসের কিন্তু শিক্ষা বারো মাসের। রমজান মাসে রোজাদারদের মধ্যে যে মানবিক মূল্যবোধ, আত্মিক, নৈতিক, আদর্শিক ও চারিত্রিক গুণাবলি বিকশিত হয়, তা যদি সারা বছর অব্যাহত থাকে, তাহলে এ সমাজ শান্তির সমাজে পরিণত হতে পারে।দ্বীনের প্রাণশক্তিই হলো তাকওয়া। মাহে রমজানে রোজার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও শিক্ষা হলো হৃদয়ের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে আলস্নাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। মুত্তাকির বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য পবিত্র কোরআনে আলস্নাহ ঘোষণা করেন যে 'হে ইমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন- ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যেন তোমরা মুত্তাকি বা খোদাভীরু হতে পারো' (সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৮৩)। রমজান মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। রোজায় তাকওয়া বা আলস্নাহভীতি নিশ্চিত হয় এবং অত্যন্ত গভীরভাবে ধর্মীয় অনুশাসন সঞ্চারিত হয়। এতে আখেরাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও নিশ্চিত হয়। ইমান ও আমলের ক্ষেত্রে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণের মাপকাঠি হলো তাকওয়া বা আলস্নাহভীতি। সুতরাং ইহকালে কল্যাণ ও পরলৌকিক মুক্তির জন্য মাহে রমজানে রোজাব্রত পালন করা অত্যাবশ্যক।

এমনকি নৈতিক শক্তির ও চারিত্রিক দৃঢ়তার পরম শিক্ষা ও চরম পরীক্ষা হলো রোজা। রমজানে রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় রোজাদার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সকল প্রকার বৈধ পানাহার ও যৌনকর্ম থেকে বিরত থাকেন। জনমানবহীন নির্জন নিরালায়, দরজা-জানালা বন্ধ ঘরে গোপন স্থানে অতি সংগোপনেও রোজাদার পানাহার তথা রোজার বিপরীত কোনো কাজ করেন না। সব কাজে সব সময় নেক আমলের জন্য কষ্টসহিষ্ণুতা ও পাপ বর্জনের জন্য মানসিক দৃঢ় মনোবল অর্জনই রোজার মূল শিক্ষা বা লক্ষ্য। যদি কেউ রোজা পালন করেন; কিন্তু গুনাহ ছাড়তে না পারেন, তবে তাঁর রোজা দ্বারা কোনো প্রতিফল তিনি পাবেন না। রমজান মাস ইবাদত-বন্দেগির মাস। রমজান মাস হলো কৃচ্ছ্র সাধনার মাস। রমজানের প্রতিটি দিন তার আগের দিনের চেয়ে দ্বিগুণ বা বহুগুণ ফজিলত নিয়ে আসে। রমজানের প্রথম অংশ ও মধ্যম অংশ অপেক্ষা শেষ অংশ অধিক ফজিলতপূর্ণ ও গুরুত্ববহ। রোজা হলো নৈতিক শক্তির ও চারিত্রিক দৃঢ়তার পরম শিক্ষা ও চরম পরীক্ষা। রমজানে রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় রোজাদার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সব ধরনের বৈধ পানাহার ও যৌনকর্ম থেকে বিরত থাকেন। জনমানবহীন নির্জন-নিরালায়, দরজা-জানালা বন্ধ ঘরে।গোপন স্থানে অতি সংগোপনেও রোজাদার পানাহার তথা রোজার বিপরীত কোনো কাজ করেন না। সব কাজে সব সময় নেক আমলের জন্য কষ্টসহিষ্ণুতা ও পাপ বর্জনের জন্য মানসিক দৃঢ় মনোবল অর্জনই রোজার মূল শিক্ষা বা লক্ষ্য। যদি কেউ রোজা পালন করেন, কিন্তু গুনাহ ছাড়তে না পারেন, তবে রোজার প্রকৃত সুফল তিনি পাবেন না হালাল খাদ্য গ্রহণ ও হালাল উপার্জিত সম্পদ ব্যবহার করা সব ইবাদত কবুল হওয়ার শর্ত। হালাল উপার্জিত সম্পদের সঙ্গে হারাম বা অবৈধ সম্পদ যুক্ত হলে পুরো সম্পদই অপবিত্র বা হারাম হয়ে যায়। যেসব ব্যবসায়ী রমজান মাসেও ব্যবসায় লেনদেনে মিথ্যার বা ছলচাতুরীর আশ্রয় নেন; খাদ্যে ভেজাল মেশান, ওজনে বা মাপে কম দেন; এক নম্বর জিনিস বলে দুই-তিন নম্বর জিনিস ধরিয়ে দেন; কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করেন।

কিন্ত তাঁদের আয়-উপার্জনও হালাল হবে না, তাঁদের রোজা-নামাজও কবুল হবে না; তাঁরা রমজানের শিক্ষা ও দীক্ষা থেকেও বঞ্চিত থাকবেন। মহানবী (সা:) বলেছেন: যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মত নয়। (মুসলিম) ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতের খেলাপ যেকোনো কাজ সব সময়ই নিষেধ; বরং তা রমজানের ইবাদতের মাসে আরও বেশি ক্ষতির কারণ। তাই রমজানে রোজা অবস্থায় কোনো প্রকার ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতের বরখেলাপ কোনো কাজ অবশ্যই কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও অধিক নিন্দনীয়। অনেককে দেখা যায়, রমজানে দিনের বেলায় যে গুনাহের কাজটি করছেন না, রাতের বেলায় অবলীলায় তা করছেন; এটি মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। এটা নৈতিকতার পরিপন্থী। রোজার নৈতিক শিক্ষা হলো জীবনটাকে রোজার মতো সুনিয়ন্ত্রিত করা।উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে সামগ্রিক দিক দিয়ে। পাঠ্যশিক্ষার হার বাড়ছে দিন দিন, কিন্তু এই শিক্ষার আসল সুফল কি সমাজ পাচ্ছে? এক দিকে বাড়ছে শিক্ষার হার, অন্য দিকে সমাজে বাড়ছে বিশৃঙ্খলা, কলহ, অশ্লীলতাসহ নানা অপরাধপ্রবণতা। সমাজ ক্রমেই হয়ে উঠছে অস্থির। সামাজিক শৃঙ্খলা আর মূল্যবোধ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায়, আমাদের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং ছিন্ন হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। অস্থির হয়ে উঠছে সমাজব্যবস্থা। নৈতিকতাহীন শিক্ষাব্যবস্থা, অপরাজনীতি, অপসংস্কৃতির বেপরোয়া অনুকরণ, ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব এবং পারিবারিকভাবে মৌলিক শিক্ষার ঘাটতি আজকের যুবসমাজ পরিণত হতে যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধহীন এক যান্ত্রিক মানুষ। একটা সমাজের মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, আচরণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সামাজিক মূল্যবোধ। 

অথচ আজকের দিনে বিষের মতো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে হিংসা, দলাদলি, অন্যায়-অনাচার, দুর্বলের ওপর অকথ্য নির্যাতন, ঘুষ, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি জঘন্য কার্যকলাপ; যা বিশ্বের কাছে আমাদের জাতির জন্য লজ্জার। নৈতিক মূল্যবোধের এই ধ্বংসাত্মক চিত্র রোধে কর্মসূচি গ্রহণ করা এখন অতীব প্রয়োজন। এই নিশ্চিত অধপতন ঠেকাতে সন্তানদের পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব সমানভাবে দেয়া প্রয়োজন। তা হতে হবে ব্যবহারিক কাজের মধ্যে, তাদের বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে অন্তর্ভুক্ত করে নষ্ট চিন্তা থেকে দূরে রাখতে হবে। তা ছাড়া পাঠ্যবইয়ের বাইরেও শিক্ষামূলক গল্প কাহিনী পড়ায় আগ্রহী করে তোলা অনেক ক্ষেত্রেই মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। নৈতিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হলোÑ শিক্ষার্থীর জীবনকে কোনো আদর্শের লক্ষ্যে পরিচালিত করে তার চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে তা প্রতিষ্ঠা করা। সত্য বলা, কথা দিয়ে কথা রাখা, মানুষ ও পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দেশপ্রেম, নৈতিকতাবোধ, দয়া-করুণা, সহমর্মিতা, আত্মত্যাগ, শান্তি, মানবাধিকার, পারস্পরিক অধিকার ও মর্যাদা দেয়ার মানসিকতা ও অভ্যাস গড়ে তোলা ইত্যাদি সামাজিক কল্যাণমূলক ও দেশের মানোন্নয়নমূলক মানবীয় গুণাবলি প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে দেয়া হয় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা।আরবি মাসসমূহের নবম মাস হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। রোজা হচ্ছে ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। রোজা শব্দটি ফারসি। এর আরবি পরিভাষা হচ্ছে সাওম, বহুবচনে বলা হয় সিয়াম। সাওম অর্থ বিরত থাকা, পরিত্যাগ করা। পরিভাষায় সাওম হলো আল্লাহর সন্তুটি কামনায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহকারে পানাহার থেকে বিরত থাকা। রোজা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের জন্য ফরজ একটি ইবাদত।বছরে একটি মাস রোজা রাখা হয়। আর সেই মাস হলো রমজান। 

রমজান মুসলিমদের মনে শান্তি ও খুশীর বার্তা নিয়ে আগমন ঘটায়। এই রমজান মাস আল্লাহর দরবারে দোয়া কবুলের অন্যতম একটি সময়। এসময়ে মুসলিমরা ইবাদতে মশগুল থাকে এবং বেশি বেশি আমল করার চেষ্টা করে। আল্লাহ তায়ালা এই মাসে আমল করার অনূকূল অবস্থা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। শয়তান মানুষকে আমল থেকে বিচ্যুত করে সে শয়তানকে এ মাসে বেঁধে রাখা হয়।রোজা মানুষকে লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ-ক্ষোভ এবং সকল ধরনের খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। এ বিষয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন- সাওম (রোজা) ঢালস্বরূপ। (বুখারী ও মুসলিম)।রোজাদারের মর্যাদা অনেক ও আল্লাহ তায়ালা রোজাদার ব্যাক্তিকে অপরিসীম ভালোবাসেন এবং পছন্দ করেন।  মুসল্লিয়ানে কেরাম! রাসূল (সাঃ) বলেন তোমাদের এই উম্মতকে রমজান উপলক্ষে এমন পাঁচটি বিষয় দান করা হয়েছে যা পূর্বের কোন উম্মতকে দান করা হয়নি। এটা শুধু তোমাদের কেই দান করা হয়েছে।আমাদের সমাজ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ প্রবণতার কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এ সব অপরাধ প্রবণতা নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা সকল ধরনের মূল্যবোধকে গ্রাস করে চলেছে। কিন্তু আমরা মাহে রমজানের রোজার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হওয়ায় এ সব সমস্যার মধ্যে আরও অধিক জড়িয়ে পড়ছি। আমাদের সমাজে যত লোক রোজা রাখে সে তুলনায় বাস্তবজীবনে তার প্রতিফলন খুবই কম। তাই দিন দিন আমাদের সমাজ জীবন বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।আত্মশুদ্ধি ও নৈতিকতার সুমহান বার্তা নিয়ে বছর পরিক্রমায় আমাদের মাঝে হাজির হয় মাহে রমজান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মাহে রমজান আমাদের জীবনে অনেকবার এসেছে অথচ আমাদের স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরণের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। 

আমরা সিয়ামের যথার্থতা উপলব্ধি করতে পারিনি। আমরা রোজাও রাখি, তারাবিও পড়ি কিন্তু রোজার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসার প্রয়োজন ছিল, সেই পরিবর্তন এখনো আমাদের মাঝে আসেনি। বছরের বাকি এগারো মাস তথা জীবনের বাকি অংশকে সুন্দর, পরিশুদ্ধ ও সংযমের অধিকারী করার জন্যই মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা। এসব বিষয় আমাদেরকে গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং রমজানের সুমহান শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সমাজের অন্যায়, অসত্য, জুলুমবাজি ইত্যাদির সমূলে শক্ত আঘাত হানতে হবে পরিশেষে বলব, এসব ব্যাপারে পরিবারের আমাদের 
অভিভাবকদেরও নিজের সন্তান ও অন্যান্য সদস্যের আচার-আচরণ এবং চলাফেরার প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি। দল-মত নির্বিশেষে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে নৈতিক মানের অবক্ষয় প্রতিরোধ করার জন্য এবং পরিবার- শিক্ষক সবাইকেই সচেতন থাকতে হবে। এমন শিক্ষাব্যবস্থা চাই, যে শিক্ষা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে জ্ঞানী, দক্ষ ও ভালো-মন্দ বোঝার মতো করে গড়ে তোলার পাশাপাশি হৃদয়বান, রুচিশীল, নান্দনিক, নৈতিক ও মানবিক বোধসম্পন্ন, ধার্মিক, দেশপ্রেমিক ও সর্বোপরি আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা জরুরি।

লেখক: রায়হান আহমেদ তপাদার, গবেষক ও কলামিস্ট।  

এসএ/