ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল হোতা

চোরের পক্ষে কি ডিপিডিসি!


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ১২:২০ অপরাহ্ন, ২রা জানুয়ারী ২০২৫


চোরের পক্ষে কি ডিপিডিসি!
ছবি: জনবাণী প্রত্রিকা থেকে নেওয়া ।

# আমি ঘটনা সম্পর্কে অবগত

প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান. এমডি, ডিপিডিসি 


# তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা

কিউ এম শফিকুল ইসলাম,  নির্বাহী পরিচালক ডিপিডিসি 


ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন (ডিপিডিসি) কোম্পানির কাকরাইল ডিভিশনের একটি চক্র গ্রাহকের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিদ্যুৎ চুরির মহোৎসবে মেতে উঠেছে। এতে করে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। ঘটনা জানাজানি হলে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। আর এই কমিটি প্রতিবেদন দেয় মূল অভিযুক্তদের বাদ দিয়েই। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায় মূল হোতারা। কাকরাইল ডিভিশনের মো. মুসা মুজিব গং নামে এক বিদ্যুৎ গ্রাহক তাঁর বাড়ির আঙ্গিনায় একটি আবাসিক ও একটি বাণিজ্যিক মিটার সংযোগ নিয়ে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকার বিদ্যুৎ চুরি করছেন। আর এই চক্রের সঙ্গে ওই ডিভিশনের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান ভূইয়ার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযুক্তরা জানিয়েছেন। সূত্রের দাবি, কাকরাইল ডিভিশনের মুন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির বাৎসরিক (সিএসএস)  ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মিটার রিডার আব্বাস, সুপারভাইজার (কর্মাশিয়াল) দিলীপ কুমার ত্রিপুরাসহ বেশ কয়েকজন এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। 


আরও জানা যায়, ওই বিদ্যুৎ গ্রাহক তার বাড়ির আঙ্গিনায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক দুইটি মিটারের একই নাম্বার দিয়ে ডুপ্লিকেট মিটার ব্যবহার করতো। সম্প্রতি বিদ্যুৎ চুরির ঘটনায় কাকরাইল ডিভিশনের একটি কারিগরি দল তাঁর লাইন বিচ্ছিন্ন করলে জরিমানা থেকে বাঁচতে শুরু হয় ঘুষ নিয়ে দেন-দরবার। জানা যায়, ওই গ্রাহকের কাছ থেকে মিটার রিডার আব্বাস ৫ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। ওই গ্রাহক ৩ লাখ টাকা দেন। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান ভুঁইয়ার কাছে মিটার রিডার বিষয়টি ফয়সালা করতে গেলে তিনি নিজেই ৫ লাখ টাকার ঘুষ দাবি করেন। পরবর্তীতে আব্বাসকে ৫ লাখ টাকা দিতে গ্রাহক অস্বীকৃতি জানালে, তাঁকে বড় জরিমানার আওতায় আনা হবে বলে মিটার রিডার আব্বাস হুমকি দেয়। বিষয়টির সমাধান না হওয়ায় আব্বাস গ্রাহককে ঘুষের তিন লাখ টাকা ফেরত দিয়ে দেন। ইতিমধ্যে ওই ডিভিশনেরই আরেক বিল সুপারভাইজার দিলীপ কুমার ত্রিপুরা গ্রাহককে আশ্বস্ত করেন যে, তিনি বিষয়টি যথাযথ সমাধান করে দিবেন। 


সূত্র জানায়, বিল সুপারভাইজার দিলীপ ওই গ্রাহকের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নেন। পরবর্তীতে তিনি ওই গ্রাহককে দিয়ে গত ২৪ জুলাই ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন) সোনামনি চাকমার কাছে কাকরাইল ডিভিশনের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগে লিখিত অভিযোগ দাখিল করান। ওই বাড়ির মালিকের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব আলী গং এই অভিযোগটি দাখিল করেন।


ঘটনা জুন মাসে হলেও গ্রাহকের আবেদনের প্রেক্ষিতে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করে। সূত্র জানায়, সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ের এক নির্বাহী প্রভাবশালী পরিচালকের নির্দেশনায় মূল অভিযুক্তদের বাদ দিয়েই তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। 


ওই ডিভিশন সূত্র থেকে জানা যায়,গঠিত তদন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা দিয়েছে। কিন্তু অপরাধীরা ধরাছোয়ার বাইরে রয়েছে বলে জানা গেছে। জানা যায়, ওই মিটার রিডার আব্বাসকে চাকুরিচ্যুৎ করলেও ও বিল সুপারভাইজার দিলীপ এখনও চাকরিতে বহাল তবিয়তে রয়েছে। 


এদিকে দ্বিতীয় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাবার পর কর্তৃপক্ষ গত ২৪ ডিসেম্বর তারিখে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিঃ দাঃ) মেহেদী হাসান ভুইয়াকে  (আইডি নং-২১৫৯২) এনওসিএস কাকরাইল-এর দপ্তর থেকে নির্বাহী প্রকৌশলী, স্টোর ম্যানেজমেন্ট রেভিনিউ -এর দপ্তরে বদলি করে। 


এদিকে ডিপিডিসির প্রধান কার্যালয়ের কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ধামাচাঁপা দিতে তড়িঘড়ি করে ২৯ ডিসেম্বর কাকরাইল ডিভিশনের মুন পাওয়ার ইন্জিনিয়ারিং কোম্পানির বাৎসরিক (সিএসএস)  ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিল সুপারবাইজার মো: ইউসুফ আলীকে চাকুরিচ্যুৎ করার জন্য কাকরাইল ডিভিশন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়। এখন প্রশ্ন থাকে, কাকরাইলের বিল সুপারবাইজার মো: ইউসুফ আলী গত জুন মাসে  মো. মুসা মুজিব গং নামে এক বিদ্যুৎ গ্রাহকের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ঐ বিদ্যুৎ চুরির ঘটনা উদঘাটন করে। প্রশ্ন উঠেছে মূল অভিযুক্তদের বাদ দিয়ে উল্টো কেন ইউসুফ আলীকে চাকুরিচ্যুত করা হলো। এদিকে ঐ বিদ্যুৎ গ্রাহক ১০ জুলাই কাকরাইল ডিভিশনের কারিগরি প্রতিনিধি দলের কাছে ঐ দিন একটি লিখিত মুচলেখা দেয়, তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ চুরি করে আসছে। ঐ মুচলেখায় তিনি উল্লেখ করেন ব্যবহৃত ঐ মিটার দুটি তার জিম্মায় রয়েছে। বিদ্যুৎচুরির ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর ১০ জুলাই ডিভিশনের কারিগরি দলের কাছে দেয়া গ্রাহকের লিখিত স্বীকারোক্তি এবং ২৪ জুলাই ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন) সোনামনি চাকমার কাছে দেয়া লিখিত অভিযোগে দুই ধরনের বক্তব্য নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধুম্রজাল। 


লিখিত স্বীকারোক্তিতে গ্রাহক জানান, কারিগরি দল মিটার দুটি সিলগালা করে তাঁর হেফাজতে রেখে গেছে। কিন্তু  নির্বাহী পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগে বলেন, মিটার দুটি কারিগরি দল ওইদিন নিয়ে গেছে। এদিকে, কাকরাইল ডিভিশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মিটার দুটি ডিভিশনের স্টোরে এখনো জমা হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে , মিটার দুটি তাহলে কোথায়?


প্রসঙ্গত, স্থাপনার মালিক প্রবাসে থাকায় দেখাভালের দায়িত্বে আছেন আইয়ুব আলী গং। মালিকের পক্ষে তিনিই দুই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। সঠিক তদন্ত হলে গ্রাহককে অর্ধকোটি টাকার বেশি বিল গুনতে হবে বলে জানা গেছে। তাই বিভ্রান্তি ছড়াতেই আইয়ুব আলী গং দুই ধরনের বক্তব্য দিয়েছে বলে অভিযোগ।  এদিকে মূল অভিযুক্তদের বাদ দিয়ে বিনা দোষে ইউসুফকে চাকুরিচ্যুত করায় সাধারণ প্রকৌশলীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। 


নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক কর্মকর্তা দৈনিক জনবাণীকে জানান, চুরি করলো বড় একটি চক্র, আর ফেঁসে গেলেন যিনি (ইউসুফ) চুরি ধরেছেন। এতে করে সাধারণ বিদ্যুৎ কর্মীদের মাঝে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।  তারা আরও বলছেন, এভাবে অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুত করা হলে ভবিশ্যতে বিদ্যুৎ কর্মীরা বিদ্যুৎ চুরি হলেও তারা তা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাবেনা।


এ ব্যাপারে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলাম বলেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 


এ ব্যাপারে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান বলেন, আমি ঘটনা সম্পর্কে অবগত। বিষয়টি তদন্ত করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 


আরএক্স/