ডিজিটাল প্রতারণায় মাসুদ শত কোটি টাকার মালিক


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ১২:৫১ অপরাহ্ন, ২রা জুলাই ২০২৫


ডিজিটাল প্রতারণায় মাসুদ শত কোটি টাকার মালিক
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া ।

# ফ্রিল্যান্সিং প্রকল্পে কোটিপতি হওয়ার শুরু

# বস্তাভর্তি টাকা ও নাটকীয় আটক

# রাজনৈতিক আশীর্বাদ: রাসেল থেকে নাহিম পর্যন্ত

 সরকারি প্রকল্পে আধিপত্য ও কমিশন বাণিজ্য

# দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের নজরদারি

প্রতিষ্ঠান সাম্রাজ্য


আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেলের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত মাসুদ আলম এখন শত শত কোটি টাকার মালিক। অথচ, শিক্ষা জীবন থেমে গিয়েছিল চতুর্থ শ্রেণিতেই। স্বল্পশিক্ষিত এই মানুষটির উত্থান ডিজিটাল প্রতারণা ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কোটি টাকার প্রকল্প বাগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে এমনটাই বলছে অনুসন্ধান।


ফ্রিল্যান্সিং প্রকল্পে কোটিপতি হওয়ার শুরু: ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে একটি জাতীয় দৈনিকে একটি খবর প্রকাশ হয় ‘ফ্রিল্যান্সিং শেখানোর কাজ পাচ্ছে ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং, সুযোগ পাবেন ২৮,৫০০ জন’। এই খবর দেখে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান বিস্মিত হয়ে পড়ে। বেসিসের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভ। কারণ, পরিচিত, দক্ষ ও স্বীকৃত আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাশ কাটিয়ে কাজ পেয়ে যায় অখ্যাত ‘ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেড’।


জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানের মালিক মাসুদ আলম ওরফে মাসুদ অভি। জন্ম শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাটে, ১৯৯১ সালের ১ জুলাই। বাবা আজাহার উদ্দিন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। সংসারের অভাবে শিক্ষাজীবন থেমে যায় প্রাথমিক পর্যায়েই।


বস্তাভর্তি টাকাসহ আটক: ২০২৫ সালের ৭ আগস্ট উত্তরা হাউসবিল্ডিং এলাকায় সিগন্যালে একটি প্রাইভেট কার (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-১৫৮১) আটক করে ছাত্র আন্দোলনের কিছু অংশগ্রহণকারী। গাড়িতে পাওয়া যায় এক বস্তা নগদ টাকা প্রায় দেড় কোটি টাকা। পরবর্তীতে জানা যায়, গাড়িটিতে ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টিকার। সেদিন গাড়িতে ছিলেন মাসুদ আলম নিজেই। নিজেকে ‘প্রমিজ গ্রুপ’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচয় দেন। পরে তাকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। তার দাবি ছিল, “ওটা আমার অফিসের স্টাফদের বেতনের টাকা। ১৬ জেলায় ৬ লাখ করে দিতে হয়। অফিস ভাড়াই ৩২ লাখ টাকা।”


রাজনৈতিক আশীর্বাদ: রাসেল থেকে নাহিম পর্যন্ত: যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন মো. জাহিদ আহসান রাসেলের ঘনিষ্ঠ ক্যাশিয়ার ছিলেন মাসুদ। মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু প্রকল্প সরাসরি পেয়েছেন তার প্রতিষ্ঠান। নিজ এলাকা গোসাইরহাটে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগ্রহও প্রকাশ করেন তিনি, যেখানে পেছনে ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের প্রয়াত সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে, সাবেক সাংসদ নাহিম রাজ্জাক। নির্বাচনী পোস্টারে নাহিম রাজ্জাকের ছবি, নানা অনুষ্ঠানমালায় তাদের উপস্থিতি সব মিলিয়ে মাসুদের রাজনৈতিক পরিচয় হয়ে উঠে শক্ত ভিত।


সরকারি প্রকল্পে আধিপত্য ও কমিশন বাণিজ্য: ২০২৩ সালে ‘জাতীয় যুব কাউন্সিল’-এর সভাপতি হন মাসুদ আলম। একই বছর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ পুরস্কার’-এ “সাধারণ-বেসরকারি” ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নির্বাচিত হন। যদিও তার প্রতিষ্ঠান ‘ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ যে ৩০০ কোটি টাকার প্রশিক্ষণ প্রকল্প পেয়েছে, তার যোগ্যতা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। এই প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে, যার আওতায় ৪৮টি জেলায় দুইটি করে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন, প্রশিক্ষণ, ভাতা ও খাদ্যসহায়তা প্রদান করা হবে। প্রকল্পটির পরীক্ষামূলক পর্যায় চলে ২০, ২২, ২৪ পর্যন্ত ১৬ জেলায়, যেখানে সরকার খরচ করে ৪৭ কোটি টাকা। পরে একনেকের বৈঠকে অনুমোদিত হয় পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প।


প্রতিষ্ঠান সাম্রাজ্য: মাসুদ আলমের প্রতিষ্ঠানের তালিকা চমকপ্রদ। শুধু ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং-ই নয়, তিনি প্রতিষ্ঠাতা বা পরিচালক আরও অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠানের, যেগুলো হচ্ছে: প্রমিজ আইটি সল্যুশন লিমিটেড। নগদ এক্সপ্রেস কুরিয়ার নগদ হাট বাংলাদেশ লিমিটেড। ই-টেলিকম, প্রমিজ ইনফোটেক লিমিটেড, সোসাইটি ফর পিপলস অ্যাডভান্সম্যান্ট (চেয়ারম্যান),রিসদা বাংলাদেশ (পরিচালক), মোড়াল লার্নিং ইনস্টিটিউট, ক্লিক দ্য ফটো, ফটো ফিক্সা। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ডাকা দরপত্রে অংশ নেয় ২০টি প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে মাত্র ৪টি প্রতিষ্ঠান রেসপনসিভ হিসেবে বিবেচিত হয়। কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে সেরা হয় মাসুদের ‘ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’। যার বিরুদ্ধে এত প্রশ্ন, যার শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই বললেই চলে, যিনি নিজে প্রযুক্তিতে পারদর্শী নন তাকে কীভাবে শত কোটি টাকার প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রকল্প দেওয়া হয়? এর উত্তর খুঁজছে গোটা দেশ।


আরএক্স/