বদর যুদ্ধ : ইসলাম বিকাশের ভিত্তি স্থাপন


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩:৫২ অপরাহ্ন, ১৮ই মার্চ ২০২৫


বদর যুদ্ধ : ইসলাম বিকাশের ভিত্তি স্থাপন
প্রতীকী ছবি

ইসলামি ইতিহাসের পাতায় ১৭ রমজান এক অবিস্মরণীয় দিন, এটি নবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাহাবিদের ধার্মিকতা ও সাহসিকতার জীবন্ত প্রমাণ। ইসলামি ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় বছরে সংঘটিত এ ঐতিহাসিক যুদ্ধটি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি ভাগ্যান্বেষণ ছিল এবং এটি ইসলামের বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।


আরও পড়ুন: বৃষ্টির পানি অসতর্কতাবশত মুখে গেলে রোজা ভাঙবে?


বদর যুদ্ধ কোনো সাধারণ যুদ্ধ ছিল না; এটি ছিল সত্য-মিথ্যার চূড়ান্ত পরীক্ষা, ঈমান ও কুফরের মধ্যকার প্রথম মুখোমুখি সংঘর্ষ। এ যুদ্ধের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীদের বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। এ মহান বিজয় ইসলামের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস ও ঈমানকে মজবুত করে তোলে।


রাসুল (সা.)-এর এই দোয়া থেকেই স্পষ্ট হয়, বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট কতটা ভয়াবহ ছিল! মহান আল্লাহ দয়া করে সেদিন ফেরেশতাদের মাধ্যমে মুমিনদের সাহায্য করেছিলেন। যদিও এটি ক্ষুদ্র একটি যুদ্ধ ছিল, কিন্তু এর প্রভাবে বিশ্বের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যায়। যারা একদিন আগেও ইসলামের অগ্রযাত্রা রোধ করাকে সহজ মনে করেছিল, তারা বুঝতে পেরেছে যে ইসলামের এ অগ্রযাত্রা রোধ করা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবও বটে।


বদর যুদ্ধের পটভূমি


ইসলাম প্রচার শুরু করার পর মুহাম্মাদ (সা.) মক্কার কুরাইশদের পক্ষ থেকে বিরোধীতার সম্মুখীন হন। মুসলিমদের উপর নির্যাতনের কারণে মুসলিমরা মদিনায় হিজরত করে। রাসুল (সা.) নিজেও এক পর্যায়ে মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতের পরে অবতীর্ণ কুরআনের আয়াতে মুসলিমদেরকে অস্ত্রধারণের অনুমতি দেয়া হয়। মদিনায় আসার পর মুহাম্মাদ (সা.) তিনটি প্রধান সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। প্রথমত, মদিনার গোত্রগুলির সাথে শান্তিচুক্তি স্থাপন করা হয়, দ্বিতীয়ত, কুরাইশ ও তাদের মিত্রদের তথ্য সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত করা হয়, তৃতীয়ত, মদিনার পাশ দিয়ে সিরিয়াগামী মক্কার বাণিজ্য কাফেলায় অভিযান চালানো হয়। এরপর সিরিয়ার পথে যাতায়াত করা কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাগুলির উপর বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করা হয়।


৬২৩ সালের নভেম্বর বা ডিসেম্বরে মুহাম্মাদ (সা.) সিরিয়া অভিমুখী মক্কার একটি বড় বাণিজ্যিক কাফেলার বিরুদ্ধে অভিযানে নেতৃত্ব দেন। এই কাফেলায় কুরাইশদের অনেক মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী ছিল। মুসলিম বাহিনীর সদস্য ছিল ১৫০ থেকে ২০০ জন এবং আরোহণের উট ছিল ৩০টি। মুহাম্মাদ (সা.) তাদের নিয়ে যুল উশাইরাহ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিমরা পৌছানোর কয়েকদিন পূর্বে কুরাইশরা সে পথ অতিক্রম করে চলে যাওয়ার কারণে মুসলিমরা তাদের পথরোধ করতে পারেনি। এই অভিযানটি গাজওয়ায়ে উশাইরা নামে পরিচিত। ইবনে ইসহাকের মতে এই অভিযানের জন্য মুহাম্মাদ (সা.) ২ হিজরির জামাদিউল আওয়াল মাসের শেষে বের হয়ে জামাদিউল আখির মাসের শুরুতে ফিরে এসেছিলেন।


৬২৪ সালের জানুয়ারিতে (২ হিজরির রজব মাস) মুহাম্মাদ (সা.) বারো জন মুহাজিরকে অভিযানে পাঠান। বাহিনীর প্রতি দুইজনের আরোহণের জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিল। মুহাম্মাদ(সা.) বাহিনীর নেতা আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশকে (রা.) একটি চিঠি দিয়ে বলেন যাতে দুই দিনের পথ অতিক্রম করার পর এই চিঠি পড়া হয়। নির্দেশ মোতাবেক দুইদিনের পথ অতিক্রম করার আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.) চিঠি পড়েন। এতে নির্দেশ দেয়া হয় যে চিঠি পড়ার পর যাতে তারা অগ্রসর হয়ে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাখলায় পৌছায়। এরপর কুরাইশ কাফেলার আগমনের অপেক্ষা করে এবং তাদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে মদিনায় অবহিত করা হয়। চিঠির নির্দেশ পড়ার পর তারা অগ্রসর হন। তবে পথিমধ্যে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে গাজওয়ানের উট হারিয়ে যায় ফলে তারা পিছিয়ে পড়েন।


আরও পড়ুন: এবার জনপ্রতি ফিতরা সর্বনিম্ন ১১০ টাকা, সর্বোচ্চ ২৮০৫


আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.) তার বাহিনীকে নিয়ে নাখলা পৌছে একটি কুরাইশ কাফেলা দেখতে পান। এতে আবদুল্লাহ ইবনে মুগিরার দুই ছেলে উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ও নওফাল ইবনে আবদুল্লাহ এবং মুগিরার মুক্তপ্রাপ্ত দাস আমর ইবনে হাদরামি ও হাকিম ইবনে কাইসান ছিলেন। এই দিনটি ছিল রজব মাসের শেষ দিন। রজব যুদ্ধনিষিদ্ধ মাস ছিল তাই আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে মাস শেষ হওয়ার সময় কাফেলাটি মক্কার হারাম সীমানায় প্রবেশ করবে ফলে তাদের উপর আর আক্রমণ করা সম্ভব হবে না। এই পরিস্থিতিতে মুসলিম বাহিনীটি কাফেলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। আক্রমণের শুরুতে তীরের আঘাতে আমর ইবনে হাদরামি নিহত হন। মুসলিমরা উসমান ইবনে আবদুল্লাহ এবং হাকিম ইবনে কাইসানকে গ্রেফতার করে। নওফাল ইবনে আবদুল্লাহ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।


রজব মাসে আক্রমণ করার কারণে মুসলিম দলটি ফিরে আসার পর মুহাম্মাদ (সা.) ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন যে তিনি তাদের হারাম মাসে যুদ্ধের অনুমতি দেননি। তিনি কাফেলা থেকে অর্জিত সম্পদ এবং বন্দীদের গ্রহণে অসম্মতি জানান। অন্যদিকে রজব মাসে আক্রমণের কারণে কুরাইশরাও মুসলিমদের কটূক্তি করতে শুরু করে। এরপর কুরআনের অবতীর্ণ আয়াতে বলা হয় যে পবিত্র মাস লঙ্ঘন করার চেয়ে মক্কার লোকদের অত্যাচার আরও বেশি নিকৃষ্ট।এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর মুহাম্মাদ (সা.) কাফেলা ও বন্দীদেরকে গ্রহণ করেন। উসমান ও হাকিমের মুক্তি চেয়ে কুরাইশরা বার্তা পাঠায় এবং বিনিময় হিসেবে পণ্য প্রদানের কথা বলে। কিন্তু ইতিপূর্বে নিখোজ হওয়া সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে গাজওয়ান তখনও ফিরে আসেননি। কুরাইশদের হাতে তাদের জীবনের আশঙ্কা থাকায় তিনি সেসময় প্রস্তাবে রাজি হননি। এরপর তারা দুইজন ফিরে আসেন এবং পণ্য গ্রহণ করে বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়। বন্দীদের মধ্যে হাকিম ইবনে কাইসান ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় থেকে যান। পরবর্তীতে বিরে মাউনায় তিনি নিহত হয়েছিলেন। উসমান ইবনে আবদুল্লাহ মক্কা চলে যান।


ইতিপূর্বে গাজওয়ায়ে উশাইরা থেকে বেঁচে যাওয়া কুরাইশ কাফেলাটি সিরিয়া থেকে মক্কা ফেরার সময় মুহাম্মাদ (সা.)তাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ ও সাঈদ ইবনে যায়িদকে উত্তরে প্রেরণ করেন। তারা হাওরা নামক স্থানে পৌছে কুরাইশ কাফেলার অপেক্ষায় থাকেন এবং কাফেলা এই স্থান অতিক্রমের সময় তারা মদিনায় ফিরে ঘটনা অবহিত করেন। কাফেলাটিতে একহাজার উট এবং এসব উটে ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা মূল্যের মালামাল ছিল। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাফেলায় রক্ষী ছিল ৪০জন।


এই কাফেলায় আক্রমণের জন্য মুহাম্মাদ (সা.) মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানান। তবে পরবর্তীতে বৃহদাকার কুরাইশ বাহিনীর সম্মুখীন হতে হবে এমন আশঙ্কা তখনও ছিল না তাই তিনি এতে সকলের অংশগ্রহণ জরুরি বলে উল্লেখ করেননি। ফলে অনেক মুসলিম মদিনায় থেকে যায়। ঘোষণার পর মুহাম্মদ (সা.) বদরের দিকে যাত্রা করেন।


বদর যুদ্ধ শুরু ও মহান আল্লাহর সাহায্য

যুদ্ধের প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাতে তুলে নেন দোয়ার হাতিয়ার। তিনি আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে ফরিয়াদ করেন—


হে আল্লাহ! যদি আজ এই দলটি (মুসলিম বাহিনী) পরাজিত হয়, তবে পৃথিবীতে তোমার ইবাদত করার আর কেউ থাকবে না! (মুসলিম, হাদিস: ১৭৬৩) 


এই দোয়ার পর আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের মাধ্যমে মুসলমানদের সাহায্য করেন। কোরআনে এসেছে— 

যখন তোমরা তোমাদের রবের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলে, তখন তিনি তোমাদের দোয়া কবুল করেছিলেন, বলেছিলেন, আমি এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করব, যারা পর্যায়ক্রমে আসবে। (সূরা আনফাল, আয়াত : ৯)

এরপর মুসলমানরা অদম্য সাহস নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন।


বিজয়ের মুহূর্ত

মুসলমানদের ঈমানী শক্তি, নবীজীর দোয়া, ফেরেশতাদের সহায়তা, সাহাবাদের আত্মত্যাগের ফলে বদর যুদ্ধ এক ঐতিহাসিক বিজয়ে রূপ নেয়। কুরাইশ নেতা আবু জাহেল-সহ কুরাইশ বাহিনীর ৭০ জন নিহত হয়। ৭০ জনকে বন্দি করা হয়। মুসলমানদের শহীদ হন মাত্র ১৪ জন। এই বিজয় শুধু সংখ্যাগত ছিল না; এটি ছিল ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারের জন্য এক মহান বিজয়।


আরও পড়ুন: যে আয়াত নাজিলের মাধ্যমে রোজা ফরজ করা হয়েছে


বদর যুদ্ধের শিক্ষা

আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা : আল্লাহর ওপর  ঈমান ও তাকওয়ার ওপর অবিচল থাকলে ছোট একটি বাহিনী বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করতে পারে। 

নবীজীর দোয়ার শক্তি : বদরের ময়দানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দোয়া কবুল হওয়া ছিল মুসলমানদের জন্য এক বিরাট শিক্ষা। 

আল্লাহর রহমত : সংখ্যাধিক্যের বড়াইয়ের পরিবর্তে আল্লাহর রহমত ও করুণাই মুমিনের জীবনের পরম হাতিয়ার।


এসডি/