বাংলাদেশ কি শ্রীলঙ্কার পথে এগিয়ে যাচ্ছে


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


বাংলাদেশ কি শ্রীলঙ্কার পথে এগিয়ে যাচ্ছে

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কা। ৬৫,৬১০ বর্গ কলোমিটারের এই দেশের প্রধান খনিজ সম্পদ চুনাপাথর, গ্রাফাইট, খনিজ বালু, রত্নাদি, ফসফেট, কর্দম, জলশক্তি প্রভৃতি। সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা। যার পরিমান ছিল ২ কোটি ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৯৭ (২০১২)। শ্রীলঙ্কার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভ্রমন পিপাসুদের আকর্ষনের ও আগ্রহের জায়গা ছিল। ইয়ালা ন্যাশনাল পার্ক, সার্ফ এন্ড টার্ফ, বিচ ভাউন্সিং ইত্যাদির টানে পর্যটকরা ছুটে আসতো। শ্রীলঙ্কার জিডিপির ১০ শতাংশ আয় হত এই পর্যটন শিল্প থেকে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষায় অগ্রসর ছিল শ্রীলঙ্কা। খেলাধুলায় ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান ছিল প্রথম সারিতে। সমাজিক সুরক্ষার সুচকে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উপরে। ২০০৬ থেকে ২০১২ সালের অর্থনীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৪ শত ৩৬ ডলার। কিন্তু বর্তমানে তার রিজার্ভের পরিমাণ নেমে এসছে ২ বিলিয়ন ডলারে। যা দিয়ে একদিনের আমদানি চালানোও মুশকিলের। অন্যদিকে এ বছরেই তাকে ৭ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে। শ্রীলঙ্কার প্রধান রপ্তানি পন্য তিনটি- চা, রাবার, তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাক শিল্প এই অ লে প্রথম শুরু হয়েছিল শ্রীলঙ্কাতেই। গৃহ যুদ্ধের প্রভাবের কারণে বিদেশি ক্রেতারা নিরাপত্তাবোধ করতেন না বিধায় সেখান থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেন। এত কিছু থাকার পরও শ্রীলঙ্কার দুরবস্থা তৈরি হল কেন? প্রশ্ন আসা খুবই সঙ্গত। জনগনের স্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে উন্নয়নের গল্প শুনালে ও দুর্নীতি- স্বজনপ্রীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করলে, মুষ্টিমেয়ের উন্নয়ন হয়, জিডিপি বাড়ে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে জনদূর্ভোগ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। শ্রীলঙ্কা তার বাস্তব উদাহরণ। 

বাংলাদেশ কি শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে? সত্যি কথা হল-বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার পথেই আছে। অধিকাংশ বুদ্ধিজীবি এই কথাটা সরাসরি বলতে চায় না। অদৃশ্য পিছুটানে বিবেকের কলমটা অচল। তার গায়ে জং ধরে গেছে। তাই একটু প্রলেপ মেখে কথা বললেও সরাসরি বলেন না। জিডিপির গল্প কথকরা একটু খেয়াল করলেই দেখবেন শ্রীলঙ্কার জিডিপি-৩৮৩০ মার্কিন ডলার যেখানে বাংলাদেশের জিডিপি-২৫৯০ মার্কিন ডলার। জিডিপি বৃদ্ধি জনগনের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটায় না। সেটার জল-জ্যন্ত উদাহরণ শ্রীলঙ্কা। এছাড়া ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংক শ্রীলঙ্কাকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ঘোষণ দেয়। কিন্তু প্রবৃদ্ধি কমতে থাকায় আবার নিন্মমধ্যম আয়ের দেশের কাতারে নামিয়ে দেয়। অন্য দিকে বাংলাদেশ উন্নয়নের যে অপ্রতিরোধ্যগতির কথা বলছে। তা শ্রীলঙ্কা বহু আগ থেকেই বলেছে এবং জনগণকে ধোঁকা দিয়ে আসছে। ঋণ করে ঘি খেয়েছে শ্রীলঙ্কার সুবিধাভোগী শ্রেণী আর এখন পুড়ে যাচ্ছে গোটা দেশ। আমাদের অবস্থাটাও তাই। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী মুখ ফসকে বলেছিলেন-মেগাপ্রজেক্ট মানে মেগা লুটপাট মেগা দুর্নীতি। কখনো বালিশ কান্ড কখনো চামুচ কান্ডের মধ্য দিয়ে মেগা দুর্নীতির চিত্র দেশবাসী দেখেছে। যা শ্রীলঙ্কার দুর্নীতি লুটপাট থেকে কোন অংশে কম নয়। করোনাকালে শ্রীলঙ্কা সরকার যে মাত্রায় জনগনের পাশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে সে সময় দুর্নীতি নিয়ে কথা বলায় শিক্ষক, কাটুনিষ্ট, সাংবাদিক ও লেখককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে শাস্তির ব্যবস্থা করেছে, সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের জামিন হওয়ার পর তাকে মুক্তি দিতে সময় ক্ষেপন করেছে। সে অর্থে বাংলাদেশের অবস্থান শ্রীলঙ্কার নিচে।


দেশের উন্নয়ন মানে দেশের জনসাধারণের জীবন মানের উন্নয়ন। সেটা পোশাকী উন্নয়ন নয়। গত দশ বছর ধরে বাংলাদেশে যে সমস্ত উন্নয়নের কথা শাসকরা প্রচার করছে। তার পুরোটা পোশাকী উন্নয়ন। এই উন্নয়ন জনজীবনের সংকট নিরসন তো করেই নি। উল্টো ঋণের বেড়া জালে আটকে ফেলেছে জনগণকে। এই দেশের এখন মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২৯২ দশমিক ১১ মার্কিন ডলার বা ২৪ হাজার ৮৩০ টাকা (৮৫টাকা মূল্যে)। শ্রীলঙ্কা  ইরানের কাছে থেকে জ্বালানী তেল আমদানি বাবদ ২৫০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে প্রতি মাসে ৫ মিলিয়ন ডলারের চা রপ্তানির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার মেগাপ্রজেক্টের ব্যয় নির্বাহের জন্য বিদেশি ঋণের দারস্থ হয়েছে। বাংলাদেশও বিদেশি ঋণের উপর নির্ভর করেই মেগাপ্রজেক্টের কাজ করছে। শ্রীলঙ্কা মেগাপ্রজেক্টে লুটপাট দুর্নীতির মহোৎসব ছিল। বাংলাদেশেও তাই। শ্রীলঙ্কার বাজারে এখন এক কেজি চালের দাম ২২০, গম ১৯০, চিনি ২৪০, গুঁড়ো দুধ ১ হাজার ৯০০ শ্রীলঙ্কান রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি ডিমের দাম ৩০ রুপি। বাংলাদেশি এক টাকা সমান এখন শ্রীলঙ্কান রুপিতে ৩ টাকা ৪২ পয়সা। সে হিসেবে বাংলাদেশের টাকায় শ্রীলঙ্কায় এখন চাল কেজিতে ৬৪, আটা ৫৫, চিনি ৭০, গুঁড়ো দুধ ৫৫১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি ডিমের দাম ৮ টাকা ৭৫ পয়সা। যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান মানুষ বাজারে গেলেই টের পাচ্ছে। পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়েছে পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতন পেয়েও শহরে থাকার উপায় মিলছে না। শ্রীলঙ্কার দ্রব্যের দামের সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশ কোন অংশেই পিছিয়ে নেই। উপরন্তু আমরা দেখতে পাই করোনার লক ডাউনে শ্রীলঙ্কান সরকার জনগনের নূন্যতম দায়িত্ব নিয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের সরকার লুটপাটের সিন্ডিকেটের কারণে দেশের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারের অস্থিরতা কমাতে ব্যর্থ। আমাদের দেশে করোনার আঘাতে লন্ডভন্ড হওয়ার হাত থেকে যে কৃষক আমাদের রক্ষা করলো সেঁচ ব্যবস্থার জটিলতার কারণে সে কৃষক এখন আত্মহত্যার পথ বেচেঁ নিয়েছে। এই রকম উদ্বেগের খবর অন্তত শ্রীলঙ্কায় শুনা যায় না। আমাদের দেশের বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যান্টিনের খাওয়ার টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়। যে প্রবাসী শ্রমীক ৪/৮ ফিট ঘরে গাদাগাদি করে থেকে দেশে টাকা পাঠায় সে শ্রমীকের দুরস্থার কথা প্রতিদিন পত্র পত্রিকায় ভেসে আসে। যা স্পষ্টই শ্রীলঙ্কার চেয়ে ভয়াবহ পরিনতির দিকে যাওয়ার লক্ষন।

যে হারে ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি আর মাদকতার প্রভাব বাড়ছে তাতে আশাবাদের মাত্রা ক্ষীণ। উপরন্তু কিশোর গ্যাংয়ের প্রকোপে শহরের অলিতে গলিতে মারামারি, চুরি ছিনতাই হরহামেশাই চলছে। বিজ্ঞান মনষ্কতার জায়গায় ধর্মীয় কুপমন্ডুকতা সমাজের মাথাকে চিবিয়ে খাচ্ছে। যার ফলাফল বিজ্ঞানের শিক্ষক এখনো কারাগারে। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ দমনের নামে যে হারে পুলিশি নিপিড়ন অব্যাহত আছে তা যে কোন দেশের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়ংকর হুমকি। কাজেই শ্রীলঙ্কার মত আমাদের অবস্থা হবে না। যারা বলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন তাদের এতটুকু জানিয়ে দিতে চাই। দুর্ভিক্ষ সব দেশে একই রকমের হয় না। সুতরাং সংকট একি রকম একি পদ্ধতিতে হবে এমন নয়। কিন্তু যে সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। তা কোন অংশেই শ্রীলঙ্কার থেকে কম নয়।  


লেখক: রিয়াজ মাহমুদ, সংবাদকর্মী ও কলামিস্ট।

এসএ/