৩৬ জুলাই: যেভাবে প্রতীকী ক্যালেন্ডার হয়ে উঠল জাতীয় প্রতিরোধের হাতিয়ার


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫:২২ অপরাহ্ন, ৪ঠা জুলাই ২০২৫


৩৬ জুলাই: যেভাবে প্রতীকী ক্যালেন্ডার হয়ে উঠল জাতীয় প্রতিরোধের হাতিয়ার
ফাইল ছবি।

বাংলাদেশে ব্যাপক ছাত্র-আন্দোলন ও দেশব্যাপী গণবিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে সোমবার পতন ঘটেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৬ বছরব্যাপী শাসনের। আন্দোলনকারীরা এ দিনটিকে ৫ আগস্ট নয়, বরং প্রতীকীভাবে ঘোষণা করেছেন “জুলাই ৩৬” হিসেবে — একটি মানসিক ও কৌশলগত প্রতিরোধের প্রতীক, যা তাদের আন্দোলনের সময়কালকে সম্প্রসারিত করেছে।


আন্দোলনের সূচনা হয় সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। কিন্তু পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র আন্দোলনকারীদের “রাজাকারদের নাতি” বলে উল্লেখ করেন। এই মন্তব্য দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে।


প্রতিবাদ ক্যালেন্ডারের নতুন সংজ্ঞা: 

“জুলাই ৩৬” ধারণাটি প্রথম প্রবর্তন করেন মোঃ শামসুল আলম, বাংলাদেশ সরকারের সিনিয়র আমলা, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে নির্বাসিত অবস্থায় বাংলাদেশের স্বৈরাচার হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সামাজিক মাঝ‍্যম ব‍্যহবার করে তিনি তার চিন্তাভাবনা, বয়ান, শ্লোগান, নানা পরামর্শ, আন্দোলন পরিচালনার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। সংগ্রামীদের সাথে নিহিড় যোগাযোগে ছিলেন। বিভিন্ন গোয়েন্দা এবং কূটনৈতিক সূত্রের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তিনি প্রচার করেছিলেন, ২০২৪ সালের জুলাই মাসের মধ‍্যে স্বৈরশাসক হাসিনার পতন ঘটবে।


এরপরে মধ‍্য জুলাই থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে সরকারী বাহিনীর ও গুন্ডাদের আক্রমনের মুখে শত শত শিক্ষার্থী আহত/ নিহত হতে লাগল প্রতিদিন। আন্দোলনের ছন্দ পতন ঘটলেও আবার ঘুরে দাড়ায়। কিন্তু দেখা যায় জুলাই মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, অথচ হাসিনা সরকারের পতন না ঘটায়, তিনি ফেসবুকে ঘোষণা দেন: “বিজয়ের আগ পর্যন্ত জুলাই মাস বাড়িয়ে দেয়া হলো। আজ ৩২, আগামীকাল ৩৩... এভাবে মুক্তির ক্যালেন্ডার শেষ হবে যেদিন হাসিনার পতন ঘটবে সেদিন। এই প্রতীকী ক্যালেন্ডার দ্রুত সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্লোগান হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে: “হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত জুলাই শেষ হবে না।” আন্দোলনের একটি ঐক্যবদ্ধ বার্তায় রূপ নেয় এই নতুন ক্যালেন্ডার।


গণভবন ঘেরাও: 

সোমবার, লক্ষ লক্ষ মানুষ “ঢাকা অভিযাত্রা” কর্মসূচিতে অংশ নিতে রাজধানীতে সমবেত হন, যা মূলত ৬ আগস্টের জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখে এটি একদিন এগিয়ে আনা হয়। ৫ আগস্ট আন্দোলনকারীরা ঘেরাও করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন “গণভবন”, যেটিকে আন্দোলনকারীরা “বাংলাদেশের বাস্তিল দুর্গ” হিসেবে উল্লেখ করেন। 


ঐদিন ঢাকার  বিকেলে সেনাপ্রধান সহ একাধিক সরকারি সূত্র নিশ্চিত করে যে, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন। রাজধানী শহরজুড়ে আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে মানুষ। শাহবাগ, টিএসসি এবং মতিঝিল এলাকায় জাতীয় পতাকা ও স্বাধীনতার স্লোগানে মুখরিত হয় রাজপথ।


পূর্বাভাস ছিল আগেই: 

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন—যেটিকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্কিত ও প্রহসনমূলক বলা হয়েছিল—তার পর থেকেই সরকারের পতনের পূর্বাভাস আসতে থাকে। 


শামসুল আলম জানান, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা ও কূটনৈতিক সূত্র তাকে জানিয়েছিল যে হাসিনা সরকার ২০২৪ সালের জুলাইয়ের পরে আর টিকবে না। “যখন জুলাই পেরিয়ে গেল, আমি আমার আত্মিক অনুভূতিকে বিশ্বাস করলাম এবং জুলাই মাসকে পতন অবধি বাড়িয়ে দিলাম,” নিউ ইয়র্ক থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন আলম।” এই প্রতীকী ঘোষণা আন্দোলনকারীদের জন্য একটি মানসিক রণকৌশলে রূপ নেয়—এবং ইতিহাস তার নিজপথে চললো।”


বাংলাদেশের সামনে নতুন অধ্যায়: শেখ হাসিনা সরকারের পতন বাংলাদেশে আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসের এক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অনেকে এটিকে “দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ” বলেও আখ্যা দিচ্ছেন। ছাত্র সংগঠন ও নাগরিক সমাজ ইতিমধ্যে ‘জুলাই ৩৬‘-কে জাতীয় মুক্তি দিবস হিসেবে পালনের দাবি জানিয়েছে—যা সাধারণ জনগণের প্রতিরোধের শক্তিকে উদযাপন করবে। বর্তমানে বাংলাদেশ এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক রূপান্তরের সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে নতুন নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা নির্ধারণে কাজ শুরু করেছে।


আরএক্স/