আটরশি পীরের জীবনী
মোঃ শফিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৬:৪৮ পিএম, ২৪শে আগস্ট ২০২৫

নিজস্ব ছবি
ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানার আটরশি গ্রামে বিশ্ব জাকের মঞ্জিল অবস্থিত। বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের মহামহিম প্রতিষ্ঠতা হযরত মওলানা শাহসূফী খাজাবাবা ফরিদপুরী কুদ্দেছা ছে-রহুল আজিজ ছাহেব। হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী ছাহেবের পুরো নাম হযরত মওলানা শাহসূফী মোহম্মদ হাসমত উল্লাহ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী (কু:ছে:আ:)। দেশ-বিদেশের কোটি কোটি জাকেরান আশেকান ধর্ম প্রাণ মমিন মুসলমাদের কাছে তিনি খাজাবাবা নামেই সুপরিচিত। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের মহান তাপস সুফী সাধক হযরত মওলানা শাহসূফী খাজা এনায়েতপুরী (রঃ) ছাহেবের অন্যতম প্রিয় মুরিদ ও খলিফা। খাজাবাবা ফরিদপুরী ছাহেব ততকালিন ময়মনসিংহ জেলার বর্তমান শেরপুর জেলার পাকুরিয়া গ্রামে এক সমভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জম্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম শাহ্ আলিমুদ্দিন ছাহেব। বিশ্ব স্রাষ্ঠা ও পরম কৌসুলী আল্লাহপাকের ইচ্ছায় খাজাবাবা ফরিদপুরী ছাহেব মাত্র এক বছর বয়সে মাতৃহারা হন। শিশু কালে সাধক পিতা হযরত আলিমুদ্দিন ছাহেব ও পূর্ণবতী দাদীর স্নেহ ভালোবাসায় গড়ে ওঠে খাজাবাবা ফরিদপুরীর শৈশব জীবন। পিতামহ মরহুম বশির উদ্দিন সাহেব ছিলেন নেত্রকোনার অধিবাসী। অতপর তিনি চলে আসেন শেরপুরের পাকরিয়া গ্রামে। মরহুম বশির উদ্দিন সাহেবর পুত্র জনাব সমির উদ্দিন সাহেব ছিলেন হযরত মওলানা শাহসূফী খাজাবাবা ফরিদপুরী (কু:ছে:আ:) ছাহেবের দাদা।
ছোটবেলা থেকেই খাজাবাবা ফরিদপুরী বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকতেন। কখনও কখনও অসুস্থতার মাত্র এত অধিক হতো খাজাবাবা ফরিদপুরী ছাহেবের নারীর স্পন্ধন পর্যন্ত অনুভুত হইতো না। ফলে চারিদিকে খাজাবাবার মৃত্যুর সংবাদ প্রচারিত হইতো। কিন্তু খাজাবাবা ফরিদপুরী ছাহেবের প্রতি শাহসুফী খাজা এনায়েতপুরী ছাহেবের দয়ার দৃষ্টি ছিলো। খাজাবাবা ফরিদপুরীর একবারের একটি রোগের কথা বলি, খাজাবাবার নানাজান তখন জীবিত ছিলেন, খাজাবাবা ফরিদপুরী তার নিজের ঘরে একটি আলো দেখিতেন। আকাশে যেমন বিদ্যুৎ চমকায় ঠিক তেমনি বিদ্যুৎ চমকানোর মতোই আলোর ঝলক দেখে জ্ঞান শূণ্য হতেন। মাঝে মাঝেই এমন হতো। কেউ বলতো এটা অশরীর প্রভাব আবার কেউ বলতো জ্বিনের তাসির। খাজাবাবা ফরিদপুরী ছাহেবের নানাজান একজন নামকরা ফকির ও দরবেশ ছিলেন। খাজাবাবার নানাজানের চেষ্টা তদবিরে খাজা এনায়েতপুরীর ওসিলায় আল্লাহপাক সেই রোগ থেকে খাজাবাবা ফরিদপুরীকে মুক্তিদেন।
ছোটবেলায় খাজাবাবা ফরিদপুরী নির্জনতা পছন্দ করতেন। একা একা থাকতে তার ভালো লাগতো। শৈশব ও কৈশরে তার তেমন বন্ধু-বান্ধব ছিলো না। তার গ্রামের বাড়িতে একটি পুকুর ছিলো। সেই পুকুরে ঢিল ছুড়তেন। অনেক গুলো মাটি বা ইটের টুকরো একজায়গায় করে একের পর এক সেগুলো পুকুরে নিক্ষেপ করতেন।
একদিন খাজাবাবা ফরিদপুরী স্বপ্নে দেখতে পান তিনি পুকুরে একা একা ঢিল ছুড়তেছেন কিছুক্ষন পর তার বয়সের একটা সুন্দর ছেলে তার সাথে ঢিল ছুড়তে লাগলো। দুজনে মিলে সেই মাটির টুকরো পুকুরে ফেলতেছেন এমন সময় খাজাবাবার আব্বাজান তাকে ডাকেন। পিতার নিকট খাজাবাবা যখন যান তখন তার পিতা তাকে বলেন বাবা তোমার সাথে যে ছেলেটি খেলতেছেন তিনি মদিনা থেকে এসেছেন। তুমি তাকে তোমার সাথে রাখার চেষ্টা করো সে যেন চলে না যেতে পারে। পিতার নিকট থেকে সেই মূল্যবান তথ্য পেয়ে খাজাবাবা মদিনার সেই মেহমানকে খেলার সঙ্গি হিসাবে ধরে রাখার জন্য কত যে কৌশল করেন তার শেষ নেই। এরপরই খাজাবাবার ঘুম ভেঙে যায়। তারপর থেকে খাজাবাবার খেলার সাথি ছিলেন মদিনার সেই মেহমান। সেই ছোট বেলা থেকেই এমন তাৎপর্য্যবহ স্বপ্ন খাজাবাবা মাঝে মাঝেই দেখতেন।
খাজাবাবা ফরিদপুরীর বয়স যখন ৫ থেকে ৬ বছর তখন নোয়াখালী জেলার সুপ্রসিদ্ধ ও সুযোগ্য আলেম মাওলানা সারাফাত আলী ছাহেবের কাছে তার প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। স্কুলে সাধারন শিক্ষার পাশাপাশি চলতে থাকে ধর্মীয় জ্ঞান ও আরবী ফারসি শিক্ষা। তিনি নান্দিনা হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। বাংলা ১৩২৮ কিংবা ১৩২৯ সাল ভারত উপমহাদেশের অবিসংবাদিত প্রখ্যাত আধ্যাতিক পুরুষ হযরত শাহসুফী খাজা এনায়েতপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেব। প্রথম শেরপুর পকুরিয়ার বগা বায়িত নিবাসি মো: নইমুদ্দিন মুন্সি সাহেবের বাড়িতে আসেন। নইমুদ্দিন মুন্সি খাজা এনায়েতপুরীর অতি মহব্বতের মুরিদ ছিলেন।
নইমুদ্দিন মুন্সী ছাহেবের সাথে আলাপকালে খাজা এনায়েতপুরী তাকে বলেন, ‘‘তোমাদের গ্রামের ছর্দারকে ডাকিয়া আন।” খাজাবাবার পিতা জনাব আলীমুদ্দিন ছাহেব মুজাদ্দেদী ছিলেন অত্র এলাকার সর্বাধিক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। নইমুদ্দিন মুন্সী তাকে ডাকিয়া আনেন। খাজা এনায়েতপুরীর সাথে আলীমুদ্দিন ছাহেবের বহু সময় আলাপ আলোচনা হয়। আলীমুদ্দিন ছাহেব খাজা এনায়েতপুরীর উপদেশে মুগ্ধ হন এবং বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করেন। খাজা এনায়েতপুরীও বাড়ি যেতে রাজী হন। খাজা এনায়েতপুরীর সাথে খাজাবাবা ফরিদপুরীর প্রথম দেখা হয় তার বয়স যখন মাত্র আট বছর।
খাজা এনায়েতপুরীর দীপ্তময় চেহারা দেখে মুগ্ধ হন খাজাবাবা ফরিদপুরী। সেই দিনের বিবরণ দিতে গিয়ে খাজাবাবা ফরিদপুরী বলেন, সময় ছিলো আসরের সময়। আমার মনে হইতেছিলো চারিদিক বেহেশতী সৌরভে সমস্ত বাড়ি মুখরিত হইয়া উঠিলো । খাজা এনায়েতপুরী আলাপ আলোচনার মধ্যেই খাজাবাবা ফরিদপুরীর পিতাকে বলেলেন, ‘‘বাবা, আপনার দুই ছেলে আমাকে দেন।”খাজাবাবার আব্বা সাথে সাথে তাকে এবং তার বড় ভাইকে দিয়ে দিলেন। খাজা এনায়েতপুরী তাকে জিজ্ঞেসা করিলেন কোন দাবি রাখলেন না তো? উত্তরে খাজাবাবার পিতা বললেন কোন দাবি রাখি নাই। খাজা এনায়েতপুরী আবার জিজ্ঞেসা করিলেন। দিয়ে দিলেন তো? তিনি পুনরায় বলিলেন দিয়ে দিলাম কোন দাবি রাখি নাই। দেওয়া নেওয়ার পর্ব শেষ হইলো।
খাজা এনায়েতপুরী পাকুরিয়া যাওয়ার দুই বছর পর। খাজাবাবা ফরিদপুরী কেবলাজানের বয়স যখন দশ বছর। তখন তার পিতার সাথে বাংলা আসামের বিখ্যাত সুফীসাধক হযরত খাজা ইউনুস আলী এনায়েতপুরী ছাহেবের দরবারে আসেন এবং তার পাককদমে সমর্পণ করেন।
তখন থেকেই ভবিষতের এই মহান সুফীসাধকের সাধনা জীবন শুরু হয়। তিনি এই অল্প বয়স থেকেই তার পীরের খেদমতে সম্পূর্ণ আত্ম নিয়োগ করেন। খাজা এনায়েতপুরী ছাহেব খাজাবাবা ফরিদপুরীকে শরিয়ত-তরিকত-হকিকত ও মারফতের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। খাজা এনায়েতপুরী খাজাবাবা ফরিদপুরীকে অত্যান্ত স্নেহ করতেন। খাজাবাবা ফরিদপুরীও আপন পীরের খেদমতে আত্মনিয়োগ করে অত্যান্ত আনন্দ পেতেন। দীর্ঘ ৪০ বছর পীরের কদমে অনাহার-অনিদ্রা ত্যাগ-তিতিক্ষা, চরম দারিদ্রতা, অমানুষিক শ্রম ও অপরিসীম ত্যাগের পরীক্ষা দিতে হয়।
আপনপীরের দরবারে খেদমত প্রসঙ্গে খাজাবাবা ফরিদপুরী বলেন, পীর কেবলাজান আমাকে তেমন খাইতে দিতেন না। দিনে একবার; কখনও বা দুইবার দিতেন। খাদ্য কম দেওয়া যেন শুধু আমার জন্যই নির্ধারিত ছিল। অথচ পরিশ্রম আমাকেই সকলের চেয়ে বেশী করিতে হইত। খাদ্য কম, কাজ বেশী। ক্ষুধা পেটে, দুর্বল শরীরেই আমাকে মাটি কাটিতে হইত, ছয় মাইল দূর হইতে টুকরী ভর্তি বাসন আনিতে হইত। ইহা ছাড়াও যমুনা নদীর তীরে স্থলচর ঘাট হইতে গরুর গাড়ীতে করে ধান, চাউল বা ডাউল আনিতে হইত। এমনিভাবে কঠোর খেদমত করিতে হইত। একদিন পীর কেবলাজান আমাকে বলিলেন, ‘‘বাবা, তুমি যদি আল্লাহকে পাইতে চাও, তবে ত্যাগী হও।” বিদায় লইয়া বাড়ীতে গিয়া আব্বাজানকে পীর কেবলাজানের উপদেশের কথা বলিলে তিনি আমাকে বলিলেন, ‘‘বাবা, বড়ই কঠোর হুকুম। তোমাকে সর্বস্ব ত্যাগ করিতে হইবে।” আমি আমার সমুদয় জমি-জমা, সহায়-সম্পদ বিক্রয় করিয়া প্রাপ্ত টাকা কেবলাজান হুজুরের কদমে নজরানা দিয়া একেবারে মিছকীন হইলাম। কেবলাজানের কদমে নিরলস খেদমত করিতে থাকিলাম। পীরের দরবারে অনাহার-অনিদ্রাসহ কঠোর খেদমত চলে জীবনের চল্লিশটি বছর।
পরবর্তী সময়ে খাজা এনায়েতপুরীর নির্দেশে কলকাতায় ৬ নং হায়াত খান লেনে মামাতো ভাই সামাদ সাহেবের বাসায় অবস্থান করেন খাজাবাবা ফরিদপুরী। মামাতো ভাইয়ের বাসাতে তার সাথে আরও দুইজন থাকিতেন। তাহাদের একজন হইলেন জনাব মহসীনউদ্দিন খান ছাহেব; অপরজন হইলেন সিরাজ ছাহেব। পীরের নির্দেশে কিছুদিন খাজাবাবাকে কলকাতায় অবস্থান করতে হয়। এসময় খাজবাবার সাথে মহসীন উদ্দিন খান সাহেবের পরিচয় হয়। তখন তিনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও রহস্যময় স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহসীন উদ্দিন খান সাহেবের সাথে গভিরতর বন্ধুত্ব হয়। এর কিছু দিন পরে মহসীন খান ছাহেবকে সাথে নিয়ে খাজা এনায়েতপুরীর দরবারে যান। মহসীন উদ্দিন খান খাজা এনায়েতপুরীর বায়াত গ্রহন করেন। এরপর মহসীন উদ্দিন খান সাহেব খাজাবাবা ফরদিপুরীকে ফরদিপুরে তার নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। ক্রমে তাদের বন্ধুত্ব আরো গভীর হতে থাকে।
হযরত খাজা এনায়েতপুরীর নির্দেশে খাজাবাবা ফরিদপুরীর বড় ভাইয়ের কন্যাকে জনাব মহসীন উদ্দিন খান ছাহেবের সাথে বিবাহ দেন। পরবর্তীতে খাজা এনায়েতপুরীর আর এক নির্দেশে মহসীন উদ্দিন খান ছাহেবের ভাইয়ের কন্যার সাথে খাজাবাবা ফরিদপুরী বিবাহ করেন। এমনিভাবে আটরশিতে জনাব মহসীন খান ছাহেবের সহিত খাজাবাবার আত্বীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠে।
বিবাহের ১২ বছর পর খাজাবাবা ফরিদপুরীর সহধর্মিণী ইন্তেকাল করেন। প্রথম স্ত্রীর জীবন দশায় হযরত খাজা এনায়েতপুরীর নির্দেশে আবার মহসীন উদ্দিন খান ছাহেবের অন্য এক ভাইয়ের কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সুদীর্ঘ ৩২ বছর হযরত পীরকেবলা জানের খেদমত করার পর তার দ্বিতীয় স্ত্রীও ইন্তেকাল করেন। এটাই ছিলো খাজাবাবা ফরিদপুরীর আটরশি আসার সংক্ষিপ্ত কাহিনি। মূলত এই আটরশি আসার লাইনটাই ছিলো কলকাতা।
হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (রঃ) তার পীরের নির্দেশে ফরিদপুর জেলায় অবস্থান করতে থাকেন এবং তরিকায় নকশাবন্দীয়া মুজাদ্দেদিয়া প্রচার করতে থাকেন। হযরত খাজা ফরিদপুরীর পীর ছাহেব তাকে নির্দেশ দেন তুমি ফরিদপুরে যাও। ফরিদপুর তোমার দাদাপীর খাজা ওয়াজেদ আলী (রঃ) এর দেশ, সেই দেশে তুমি সত্য তরিকা প্রচার করতে থাকো। যেদিন খাজাবাবা ফরিদপুরীকে খেলাফতনামা দিয়ে আটরশির জমিনে পাঠান। সেই পাঠানোর সময় খাজাবাবা ফরিদপুরী চোখের পানি ফেলে কাঁনতেছিলেন, খাজা এনায়েতপুরীর চোখের পানি ফেলে দুটি পয়সা খাজাবাবা ফরিদপুরীর হাতে দিয়ে বললেন বাবা “এই দুটি পয়সা আমি তোমাকে দিলান এটা তুমি তোমার কাছে রাখো”। খাজাবাবা বললেন হুজুর জীবনে কোনদিন পয়সার জন্য পীরের কদমে যায় নাই। ৪০টা বছর আমি আপনার কদমে গোলামী করেছি সাধনা করেছি, অভাব অনাটনে আপনার দরবারে না খেয়ে থেকেছি এর বিনিময়ে পয়সা আমি চায় না, হুজুরের দয়ায় আমার জন্য যতেষ্ট হবে। খাজা এনায়েতপুরী বললেন বাবা পীর তোমাকে দিছে পীরের জিনিস ফেরত দিতে হয় না বাবা তুমি এটা গ্রহন করো। খাজাবাবা ফরিদপুরী তখন বললেন বাবা ঠিক আছে এটা আমি আমার কাছে যত্ন করে রেখে দিলাম বলে আবারও কান্না করতে লাগলেন। খাজা এনায়েতপুরী তখন বললেন বাবা এই দুইটা পয়সা একটা তোমার এহকালের বাদশাহি একটা তোমার পরকালের বাদশাহি। খাজা ফরিদপুরী (রঃ) তার পীরের আদেশ পালন করার জন্য ফরিদপুরে আগমন করেন। প্রথমে যেদিন খাজাবাবা আটরশিতে আসেন -সেইদিন ছিল কোরবানীর ঈদের দিন। তিনি দেখিলেন, ঈদের দিনে লোকজন লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে মাঠে যাইতেছে। সেখানে নামাজ ছিল না-সমাজ ছিল না। ধনী, মানী, জ্ঞানী, গুণী লোক ছিল না। গরু কোরবানী হইতো না। গরুর গোস্তকে এই এলাকার মোসলমানেরা অস্পৃশ্য মনে করিত। ইসলাম কি-তারা তা জানতো না। পার্শ্বেই ছিল হিন্দু জমিদারের বাড়ী। এই এলাকার মোসলমানগণ জমিদার বাড়ীর পূজায় অংশ গ্রহণ করিত; পূজার প্রসাদ খাইত। তাহারা হিন্দুয়ানী রীতিকে ভালবাস তো। আটরশির মত এত নিকৃষ্ট গ্রাম বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি ছিলো না।
সেই ঈদের দিনে জনাব মহসীন উদ্দিন খান ও তার দুই ভাইকে নিয়ে পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করলেন। সেদিন খোদাতায়ালার নিকট তিনি দু’আ করিলেন, ‘‘হে খোদাতায়ালা! এই যে তিন/চার জন আমরা ঈদের নামাজ পড়িলাম। দয়া করিয়া তুমি এখানে বিশাল ঈদের জামাত কায়েম কর।” মহান খোদাতায়ালার দয়ায় আজ সেখানে বিশাল ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা ১৩৫৪ সাল থেকে খাজাবাবা ফরিদপুরী সত্য তরিকা প্রচার কাজ শুরু করেন। মহসীন উদ্দিন খানের অতি ক্ষুদ্র একটি ছনের ঘর থেকে সত্য তরিকা প্রচারের কর্মসূচি শুরু হয়। একবছর পর পার্শবর্তী গ্রাম থেকে মাত্র আট টাকায় একটি কুড়ে ঘর ক্রয় করেন। সেই কুড়ে ঘরটির নাম দেওয়া হয় জাকের ক্যাম্প। ঘরটি ছিলো ছনের ছাউনি আর বেড়া ছিলো সুপারি খোলের। কয়েক বছরের ব্যাবধানে ছনের তৈরি ক্যাম্পের জায়গায় টিনের তৈরি ঘর এবং বেড়া দেওয়া হয়। সময়ের বিবর্তনে কালের ব্যবধানে সেই জাকের ক্যাম্পই আজ বিশ্ব জাকের মঞ্জিল নামে পরিচিতি লাভ করেছে। জাকের ক্যাম্প থেকে বিশ্ব জাকের মঞ্জিল এটা এক বিরাট ইতিহাস।
খাজাবাবার একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় ও আধ্যাত্মিকতার আকর্ষণে লোক দলে দলে সত্য তরিকায় দীক্ষিত হতে থাকে। এইভাবে সুদীর্ঘ ৪৮ বছর সত্য তরিকা প্রচারের পর সেই ক্ষুদ্র জাকের ক্যাম্প বিশ্ব জাকের মঞ্জিল রূপে লক্ষ্য লক্ষ্য জাকেরানদের একমাত্র আশ্রয়স্থল এবং তরিকত শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে।
বিশ্ব জাকের মঞ্জিল আল্লাহ ও রাসূলে পাক (সাঃ) এর মহা দান, বিশ্ব মানবের জন্য খোদাপ্রাপ্তির প্লাটফর্ম, আধ্যাত্মিক শিক্ষাকেন্দ্র। দেশের সর্বত্র থেকে এখানে মানুষ আসে। আসে আত্মোপলব্ধির তাড়নায়, আসে নিজেকে চিনিবার জন্য, আসে খোদাতায়ালাকে চিনিতে, জানিতে বা বুঝিতে। আজ শুধু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেই নয়; পৃথিবীর সর্বত্র থেকেই লোক আসে। তাহারা আসে আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এর মহব্বত অর্জনের জন্য, আসে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল (সাঃ) এর শাশ্বত প্রেমের শরাব পানের জন্য।
বিশ্ব জাকের মঞ্জিল জাতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। বহুমুখী প্রতিষ্ঠানে আছে আলীয়া মাদ্রাসা, সোনালী ব্যাংকের শাখা, পোষ্ট অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, আছে ৬০০ শয্যাবিশিষ্ট (প্রস্তাবিত) একটি হাসপাতাল (নির্মাণাধীন); আছে সম্পূর্ণ পাথর নির্মিত দ্বিতল একটি মসজিদ (নির্মাণাধীন) ইহা ছাড়াও জাকেরানদের থাকিবার জন্য আছে বহু অট্টালিকা।
দিবা-নিশি ২৪ ঘন্টা চলে শরীয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফাত তথা পূর্ণাংগ ইসলাম সম্পর্কে প্রশিক্ষণ কর্ম। খাজাবাবা ফরিদপুরীর দরবারে আসা ভক্ত আশেকানদের জন্য তিনি বলেন, জাগতিক সমস্যা লইয়া যারা এখানে আসে, সেই সমস্যা সমাধানের উপদেশ দানের মাধ্যমেই আমি তাহাদেরকে আধ্যাত্মিকতা শিক্ষা দেই; খোদাতায়ালার দিকে পথ দেখাই। তাহাদের প্রত্যেকের জিহ্বাতেই এক ফোটা করিয়া আধ্যাত্মিক মধু প্রদান করি; যে অমীয় মধুর মিষ্টি স্বাদে ও আকর্ষণে ঃ তাহারা আসে আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এর এই দরবারে, আরও অধিক মধু পানের অতৃপ্ত তৃষ্ণায়।
কাহার সাধ্য এই বিশাল মেহমানখানা পরিচালনা করে? প্রতিদিন কত লোক আসিবে, কত মেহমানকে খাবার পরিবেশন করা হইবে- তাহার হিসাব নাই। এত লোকের এক সন্ধ্যার তরকারীও কোন উপশহরে মিলে না। অথচ যখনই যত মেহমান আসে, তাহাদের সকলেরই খাবারের ব্যবস্থা থাকে। অত্যন্ত নিয়ম শৃংখলার সাথে চলে এই মেহমানখানা।
হযরত শাহ সুফি খাজা বাবা ফরিদপুরীর বহু কারামত ও অলৌকিক ঘটনার কথা শোনা যায়, তেমন একটি ঘটনা সংক্ষেপে তুলে ধরছি, পাকিস্তান আমলের কথা। বিশ্ব জাকের মঞ্জিল পাক দরবার শরীফের তখন প্রাথমিক অবস্থা। হুজুর কেবলাজানের বুজুর্গীর কথা তখন সবেমাত্র মুখে মুখে প্রচারিত হচ্ছে। সে সময় স্থানীয় লোকজন হুজুর কেবলাকে নিছক একজন মাওলানা হিসেবে বিবেচনা করতো। তাঁর কাছে দুর দুরান্তর থেকে লোকজন আসে, আবার সাথে নিয়ে আসে হাঁস, মুরগী, চাল, ডাল, গরু, টাকা পয়সা। স্থানীয় পীর ওলী বিরোধী আলেম মাওলানাদের এটা সহ্য হতোনা। দুর দুরান্তর থেকে আগত জাকেরদেরকে তারা পথে ঘাটে নানা কটুক্তি করতো, পীর কেবলাজানের কাছে যাওয়াটাকে হাস্যকর ঘটনা মনে করতো। অনেকে জাকেরদের দরবার শরীফে যাওয়ার পথে উত্যক্তও করতো। স্থানীয় আলেম সমাজ জাকেরদের এটা সেটা নজরানা নিয়ে যাওয়াকে নাজায়েজ তথা শরীয়ত বিরোধী বলেও প্রচার করতো। বিশেষ করে খাজাবাবা সূদুর শেরপুর থেকে ফরিদপুর জেলার আটরশি এসে এখানে আস্তানা করেছেন, আর তাঁর কাছে মানুষ এটাসেটা নিয়ে যায়, তা তাদের সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে দিয়েছিল। হুজুর কেবলার কাছে লোকজনের যাওয়া আসা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এটা তাদের জন্য খুবই অসহনীয় ঠেকছিলো। তাই হুজুর কেবলাকে সেখান থেকে কিভাবে বিতাড়িত করা যায় তার ফন্দি খুজে বেড়াচ্ছিল। এরই প্রেক্ষিতে স্থানীয় আলেমগণ বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র ও মসজিদের মুসুল্লীদেরকে নিয়ে দরবার শরীফের অদুরে একটি বায়েছ অনুষ্ঠানের আয়োজন করলো। তাদের সিদ্ধান্ত ছিল যে বায়েছে হুজুর কেবলাকে আমন্ত্রন করে আনবে এবং সেখানে তাঁকে নানা রকম প্রশ্ন করা হবে, হুজুর যদি কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হন তাহলে হুজুরকে আটরশি থেকে উচ্ছেদ করে দেয়া হবে। তারা একটা তারিখ নির্ধারণ করলো এবং কতিপয় লোক দরবার শরীফে এসে হুজুরকে সে বায়েছে নিমন্ত্রন করে গেলো। হুজুর সাদরে সে আমন্ত্রন গ্রহণ করলেন। ঘটনার দিনটি ছিল রবিবার। তখন রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি ছিল। ছুটির সুবাদে দরবার শরীফের প্রবীণ জাকের ওসমান ডাক্তার দরবারে গেলেন। দরবারে যাবার পথে তিনি শুনে এসেছেন আজ দরবার শরীফের অদুরে বায়েছ হবে, সেখানে হুজুর পাকের যাওয়ার কথা। ওসমান ডাক্তার খুবই সৌখিন লোক ছিলেন। তিনি পাঞ্জাবীর সাথে ধুতি পড়তেন। ধুতি পড়েই সেদিন দরবারে গিয়েছিলেন।
তিনি দরবারে গিয়েই হুজুর পাকের সাথে দেখা করতেই হুজুর বললেন, ডাক্তার সাহেব এসেছেন? আজ বাবা আমার একটা দাওয়াত আছে। আমিতো যেতে পারবো না, আমার পরিবর্তে আপনি সে দাওয়াতে যাবেন। ওসমান ডাক্তারের তো মাথায় বাজ পড়লো। তিনি ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত, ধর্মীয় অনুষ্ঠান বায়েছে গিয়ে তিনি কি করবেন। পীরের হুকুম অমান্যও করতে পারছেন না। ভিতরে ভিতরে ভয়ে শুকিয়ে গেলেন। দুপুর বেলা যেতে হবে। তিনি দরবার শরীফের বিভিন্ন স্তরের খাদেমদের কাছে গিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, ভাইজান, আজই আমার জীবনের শেষ দিন। হুজুর আমাকে বায়েছ অনুষ্ঠানে পাঠাবেন, আমিতো কোরান হাদিসের কিছুই জানিনা। মাদ্রাসার ছাত্র ও মুসুল্লীদের মার খেয়ে সেখান থেকে আজ আর ফিরে আসতে পারবো না। যোহরের নামাজের পর হুজুর কেবলাজানকে কদমবুছি করে ওসমান ডাক্তার রওনা হলেন। তিনি বায়েছ অনুষ্ঠানে গিয়ে হুজুর কেবলা তাকে পাঠিয়েছেন শুনেই উপস্থিত মাওলানারা ক্ষেপে গেল। একেতো হুজুর নিজে যাননি, তারপর পাঠিয়েছেন দাড়িহীন ধুতিপড়া এক ব্যক্তিকে। তারা খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়ল। ওসমান ডাক্তার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলেন। না জানি কোন দিক থেকে লাঠির আঘাত মাথায় এসে পড়ে। তিনি ধৈর্য্য সহকারে উপস্থিত আলেমদেরকে বললেন, আপনারা আমাকে যা ইচ্ছে করেন আমার পীরকে নিয়ে কিছু বলবেন না। তারা তখন বলল, ঠিক আছে আমরা যা প্রশ্ন করবো তোমাকে তার জবাব দিতে হবে। তিনি কিছুই বললেন না, হুজুর কেবলার জন্য যে চেয়ারখানা নির্দিষ্ট ছিল তার পিছনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার ডানে বায়ে বড় বড় পাগড়ীওয়ালা আলেম সকল কিতাবের স্তুপ নিয়ে বসে আছে, তিনিতো এসব জীবনে স্পর্শ করেও দেখেননি। তিনি মনে মনে বলতে লাগলেন - খাজাবাবা আমাকে প্রাণে মারার জন্য এখানে পাঠিয়েছেন। মাঠ ভর্তি লোকজন, তাদের কারও হাতে লাঠি সোটাও রয়েছে। কারণ তাদের আজকের পরিকল্পনাই হচ্ছে হুজুরকে আটরশি থেকে তাড়িয়ে দেয়া। যাহোক বায়েছ অনুষ্ঠান শুরু হলো। ওসমান ডাক্তার হুজুর কেবলার চেয়ার ধরে দাড়িয়ে আছেন। পীর ফকিরদের সম্পর্কে নানা কটুক্তিসহ কয়েকজন অতিথি ওয়াজ করলেন। তারপর তাদের মধ্য থেকে ওসমান ডাক্তারকে প্রশ্ন করা শুরু হলো। কোরান হাদিস কিছুই যিনি পড়েননি তাকে সম্মুখীন হতে হলো একদল প্রবীণ আলেমের। কি উত্তর দিবেন তিনি। চোখে মুখে আতংক। তিনি উপস্থিত লোকজনের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাত তার চোখে পড়ল সভার লোকজনের মাথার উপরে বিরাট একটি পর্দা। আর সে পর্দার গায়ে মাওলানা সাহেবের প্রশ্নের উত্তর। তিনি পর্দার গায়ে লেখা উত্তর দেখে প্রশ্নের উত্তর দিলেন। এভাবে যত প্রশ্ন করা হচ্ছে ততই পর্দার গায়ে উত্তর ভেসে আসছে। কোন উত্তর কোন কিতাবের কোন অধ্যায়ে, কত পৃষ্ঠায় রয়েছে সব ভেসে উঠছে। ওসমান ডাক্তারকে তখন কোন প্রশ্ন করেই আর আটকানো যাচ্ছেনা। আলেমগণ ঘাবড়িয়ে গেলো, আটরশির পীরের ধুতিপড়া মুরিদ এত কিতাবের নাম তার পৃষ্টা নম্বর সহকারে বলে দিচ্ছে, পীর সাহেব নিশ্চয় অনেক কিছুই জানেন। তখন তারা প্রশ্ন করা ছেড়ে ওসমান ডাক্তারের হাতে হাত মিলিয়ে বলল, ভাই না বুঝে আপনাকে অনেক কথা বলেছি, মাফ করে দিবেন। ওসমান ডাক্তার বললেন, মাফ যদি চাইতে হয় আমার পীরের কাছে গিয়ে চান, আমি যা কিছু বলেছি সবই তাঁর শিখিয়ে দেয়া। প্রকৃত ঘটনা তিনি গোপন রাখলেন। এরপর থেকে স্থানীয় লোকেরাও দরবার শরীফে আসা শুরু করলো। দলে দলে আলেম সকল পীর কেবলাজানের সত্য তরিকা গ্রহণ করতে লাগল।
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় আল্লাহ তাআলা তার ওলীদের উপরে কতটা সদায়। আল্লাহ তাআলা তার নিজ হাতে তার ওলীদের অলৌকিক ক্ষমতা দান করেন। আল্লাহ তাআলা তার বন্ধু খাজা বাবা ফরিদপুরী (রঃ) এর উসিলায় আমাদের উত্তম হেদায়েত দান করুন। আমিন।
এএস