স্বৈরাচারের দোসর ডিপিডিসির দুই প্রকৌশলীর ঘুষ বাণিজ্যে
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ০২:৩৬ পিএম, ২রা সেপ্টেম্বর ২০২৫

বিদ্যুৎ সংযোগের আশায় সাধারণ মানুষ দিনশেষে এসে দাঁড়ায় ঘুষের কাছে। নিয়ম ভেঙে, প্রভাব খাটিয়ে, সিন্ডিকেট গড়ে ডিপিডিসি হয়ে উঠেছে দুর্নীতির আখড়া। নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল মনসুরের কথায় চলে মুগদাপাড়া ডিভিশনের প্রকৌশলীরা। তার ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা সহকারী প্রকৌশলী মো. ইলিয়াস হোসেন ঘিরে শক্তিশালী এক সিন্ডিকেট। যার নাম ডিপিডিসির ভেতরে এখন স্বৈরাচারের দোসর দুই প্রকৌশলীর ঘুষ বাণিজ্যে। এই দুইজনের ইশারায় বিদ্যুৎ সংযোগ, ট্রান্সফরমার ব্যবসা, এমনকি ঘুষ বাণিজ্য পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয়। অভিযোগ আছে, একেকটি সংযোগ পেতে গ্রাহককে গুনতে হয় লাখ লাখ টাকা। মিটার টেম্পারিং থেকে শুরু করে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি সবখানে চলছে এই চক্রের দৌরাত্ম্য। অথচ গ্রাহক অভিযোগ তুললেও নিশ্চুপ ডিপিডিসির বড় কর্তারা। ফলে দুর্নীতি হয়ে উঠেছে ওপেন সিক্রেট।
ঘুষের বোঝায় জিম্মি গ্রাহক: ১০ জুলাই গভীর রাত। মুগদাপাড়া ডিভিশনের নতুন ফ্ল্যাটে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ব্যবসায়ী আলদ্দিন ওয়াজেদ। গৃহস্থালির সব আয়োজন তৈরি, শুধু নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। এক সপ্তাহ ধরে ডিপিডিসির অফিসে দৌড়ঝাঁপের পর অবশেষে একটি খবর পেলেন সংযোগ চান তো দিতে হবে পাঁচ লাখ টাকা। বিস্ময়ে হতভম্ব আলদ্দিন বুঝলেন, নিয়ম মেনে বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া যেন স্বপ্নের মতো। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ঘুষের টাকা মিটিয়েই বিদ্যুৎ সংযোগ পেলেন তিনি। এ অভিজ্ঞতা শুধু আলদ্দিনের নয়, রাজধানীর মুগদাপাড়া অসংখ্য ভুক্তভোগীর। অভিযোগ, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেটের হাতে। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন মুগদাপাড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল মনসুর। তার সঙ্গে সহকারী প্রকৌশলী ইলিয়াস হোসেনসহ আরও একজন যাদের নিয়ে গড়ে উঠেছে দুই স্বৈরাচারের দোসর।
ঘুষ বাণিজ্যের অঘোষিত রেট: ডিপিডিসির মাঠ পর্যায়ের গ্রাহকদের অভিযোগ, নতুন একটি বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে হলে ঘুষ ছাড়া উপায় নেই। এলাকাভেদে রেটও ভিন্ন। কেউ দিতে হয় দুই লাখ, কেউবা তিন লাখ, আর বড় বাসা বা বাণিজ্যিক সংযোগ চাইলে রেট ওঠে পাঁচ লাখে। সূত্র জানায়, ঘুষের এই টাকা সরাসরি একজন প্রকৌশলীর হাতে যায় না; ভাগ হয়ে যায় সিন্ডিকেটের মধ্যে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, অফিসের দালাল, এমনকি ট্রান্সফরমার সরবরাহকারী কোম্পানির সঙ্গেও মিলে তৈরি হয় দুর্নীতির শৃঙ্খল। মুগদাপাড়ার বাসিন্দা সজিব আহমেনের ভাষায়, ‘বিদ্যুৎ না থাকলে ঘর সাজানো যায় না। অথচ সংযোগ চাইতে গিয়ে বুঝলাম, এ যেন বৈধ ঘুষের অফিস। টাকা ছাড়া কারও কানে কথা পৌঁছায় না।’
ট্রান্সফরমার থেকে কমিশন: বিদ্যুৎ সংযোগেই শেষ নয়, নির্দিষ্ট কোম্পানির ট্রান্সফরমার নিতেও গ্রাহকদের বাধ্য করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বাজারে কম দামে ভালো মানের ট্রান্সফরমার পাওয়া গেলেও ডিপিডিসির কর্মকর্তারা তাদের পছন্দের কোম্পানির কাছ থেকে ক্রয় করতেই চাপ দেন। এতে প্রকৃত গ্রাহকের খরচ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। নির্বাহী প্রকৌশলী মে. আবুল মুনসুরের নির্দেশে এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় বলে অভিযোগ প্রকৌশলীদেরই একটি অংশের। তার ইশারাতেই উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলীরা ‘ট্রান্সফরমার কমিশন ব্যবসা’ পরিচালনা করেন।
গ্রাহকের নীরব কান্না: মুগদাপাড়া ও বনশ্রী ডিভিশন থেকেই গ্রাহকদের অভিযোগের ছড়াছড়ি। তবে অভিযোগ করলেও লাভ নেই, কারণ বড় কর্তারা থাকেন নিশ্চুপ। গ্রাহকদের মতে, অভিযোগ করলেই উল্টো সংযোগ বিলম্বিত হয়।
রাজধানীর এক গৃহিণী বলেন, সংযোগ চাইতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, আর কখনো চাই না। মনে হয়েছে আমরা যেন অপরাধী, অথচ দোষ তো তাদের।
দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ: ডিপিডিসির দুর্নীতি নিয়ে ইতোমধ্যে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। মুগদা ডিভিশনের সুনসুর আলী ও বিভাগী প্রকৌশলী ইলিয়াস হোসেনের বিরুদ্ধে মিটার টেম্পারিং ও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের অভিযোগ তদন্তে মাঠে নেমেছেন দুদক। দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা কিছু তথ্য পেয়েছি। কিন্তু প্রমাণ জোগাড় করা কঠিন। তবুও তদন্ত চলছে।
কেন ঠেকানো যাচ্ছে না সিন্ডিকেট: রাজনৈতিক ছত্রছায়া দলবদলের খেলায় সবসময় নিরাপদ থাকেন সিন্ডিকেট নেতারা। প্রশাসনিক উদাসীনতা। গ্রাহক অভিযোগ করলেও বড় কর্তারা নীরব। অর্থের প্রভাব, কালো টাকার পাহাড় গড়ে তোলায় সব দিকেই প্রভাব বিস্তার সম্ভব হয়। অভ্যন্তরীণ জোট নির্বাহী থেকে উপ-সহকারী স্তর পর্যন্ত সিন্ডিকেটের শেকড়।
ডিপিডিসির ভেতরে গড়ে ওঠা স্বৈারাচার প্রকৌশলী সিন্ডিকেট এখন খোলামেলা দুর্নীতির প্রতীক। গ্রাহক জিম্মি, রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্ত, আর কর্মকর্তারা ফুলেফেঁপে উঠছেন কালো টাকায়। রাজনৈতিক ছত্রছায়া আর প্রশাসনিক নীরবতায় এই সিন্ডিকেট দিনের পর দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বিদ্যুৎ সংযোগ মানুষের মৌলিক অধিকার, কিন্তু সেটিই যখন ঘুষ বাণিজ্যে রূপ নেয়, তখন প্রশ্ন ওঠে কাদের হাতে নিরাপদ আমাদের বিদ্যুৎ খাত।
বিদ্যুৎ খাতের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ: একদিকে সরকার অবৈধ সংযোগ রোধ ও বিদ্যুৎ সেবায় স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে ডিপিডিসি কর্মকর্তাদের অনিয়মে গ্রাহকের আস্থা ভেঙে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দুর্নীতি বিদ্যুৎ খাতের সামগ্রিক ভাবমূর্তিকে ধ্বংস করছে।
এ বিষয়ে ডিপিডিসির সহকারী প্রকৌশলী ইলিয়াস হোসেন বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলী মনসুর স্যার যেভাবে বলেন, আমি সেভাবেই কাজ করি। তার নির্দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নাই। তবে টাকা নিয়ে কোনো সংযোগ আমি দেই না। দুর্নীতির মধ্য আমি নাই। এতোটুকো বলতে পারি। তবে আপনি নির্বাহী স্যারের সঙ্গে বসেন আশাকরি সমাধান হয়ে যাবে। এই স্বীকারোক্তিই প্রমাণ করে, সিন্ডিকেটটি কতটা শক্তিশালী ও সুসংগঠিত।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক এক চেয়ারম্যান বলেন, বিদ্যুৎ খাতে যত বিনিয়োগই হোক, যদি মাঠ পর্যায়ে স্বচ্ছতা না থাকে, তাহলে সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যাবে। সিন্ডিকেট ভাঙা না গেলে কোনো সংস্কারই সফল হবে না।”
এ ব্যাপারে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) মুগদাপাড়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল মুনসুর এর মুঠো ফোনে বল দিলে তিনি রিসিভ করেননি।
এ ব্যাপারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ’বিদ্যুৎ খাতে প্রতিনিয়তই দুর্নীতি বাড়ছে। আর বেশি দুর্নীতি করছেন প্রকৌশলীরা। তারা ঘুষের টাকা জন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। অন্যদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিদ্যুৎ নতুন সংযোগ নিতে ঘুষ দিতে হয়। এটা ভালো খবর নয়। দুর্নীতি ঠেকাতে দুদকে কঠোর পদক্ষেপ দেওয়া জরুরি।
আরএক্স/