ডিপিডিসির প্রকৌশলী ইলিয়াস কালো টাকার মালিক


Janobani

মো. বাকি বিল্লাহ

প্রকাশ: ০১:৪০ পিএম, ৩রা সেপ্টেম্বর ২০২৫


ডিপিডিসির প্রকৌশলী ইলিয়াস কালো টাকার মালিক
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে গিয়ে গ্রাহকরা যে ভোগান্তির শিকার হন, তার পেছনে রয়েছে একটি প্রাতিষ্ঠানিক অসঙ্গতি ও অভিযোগের পাহাড়। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) দেশের অন্যতম বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান হলেও, সেখানে বছরের পর বছর ধরে কিছু ‘সিন্ডিকেট’ এবং প্রভাবশালী কর্মকর্তা ডিপিডিসির মুগদাপাড়া ডিভিশনের সহকারী প্রকৌশলী ইলিয়াসের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সমাধানহীন থেকে গেছে।


আমি না বললে বিদ্যুৎ সংযোগে হবে না: রাজধানীর মুগদা নেটওয়ার্ক অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস (এনওসিএস) অফিসে নতুন সংযোগের জন্য কাগজপত্র ঠিকঠাক জমা দিয়েও গ্রাহককে শুনতে হয়েছে, উপকরণ কোথা থেকে নেবেন, ঠিক আছে তো? এর পর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ঠিকাদারদের ভিজিটিং কার্ড। গ্রাহক বললেন, সব কাগজ ঠিক, টাকা পয়সাও জমা দিলাম। কিন্তু বলা হলো, আমাদের কথা না শুনলে ফাইল এগোবে না। এই অভিজ্ঞতা তার একার নয়, বনশ্রী ও মুগদার গ্রাহকেরা একই অভিযোগ করছেন।


অভিযোগকারীদের দাবি, নতুন সংযোগ, ট্রান্সফরমার, কেবল বা সোলার সরঞ্জাম কেনাবেচার সঙ্গে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী জড়িয়ে আছে। তাদের ইশারা ছাড়া ফাইল নড়ে না।


এক সহকারী প্রকৌশলীকে ঘিরে বিতর্ক: বনশ্রী ডিভিশনে দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রকৌশলী ইলিয়াসের বিরুদ্ধে অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এখন তিনি মুগদাপাড়া ডিভিশনে কর্মরত আছেন। গ্রাহক হয়রানি, উপকরণ কিনতে বাধ্য করা, এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে অশালীন আচরণ এসবই নিত্যদিনের অভিযোগ। ভুক্তভোগীদের দাবি, নির্দিষ্ট সরবরাহকারীর কাছ থেকে ট্রান্সফরমার বা কেবল না কিনলে সংযোগ আটকে দেওয়া হতো। তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, শুধু মুগদাপাড়া ডিভিশনে নয়, বনশ্রীসহ ডিপিডিসির অন্যান্য ডিভিশনেও প্রভাব খাটাতেন। মূলত বনশ্রী ডিভিশনে তিনি কর্মরত থাকলেও ডিপিডিসির ৩৬ টি ডিভিশনেই ছিলো তার অবাদ বিচরণ। এই ৩৬টি ডিভিশনই এই প্রকৌশলী একটি সিন্ডিকেট করে অবৈধভাবে অর্থ কামাতো। সরকারি চাকরি করেই তিনি গড়েছেন সাবস্টেশন কোম্পানী, সোলার কোম্পানী। কোন গ্রাহক তার কাছ থেকে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, ক্যাবল ও সোলার প্যানেল না কিনলে সে বিদ্যুৎ সংযোগ পেত না। তৎকালীন সময় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন আসার পরও তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এতে করে সে হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। 


রাজনীতি, প্রভাব ও পদোন্নতি: অভিযোগ রয়েছে, প্রকৌশলী ইলিয়াস আওয়ামীপন্থী প্রকৌশলী সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের নেতাদের সঙ্গে ছিলো তার সখ্যতা। আবার ৫ আগস্টের সরকার পরিবর্তনের পর তিনি বিএনপিপন্থী প্রকৌশলীদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকেই তার প্রভাব বিস্তার। ডিপিডিসির বনশ্রী ও মুগদা ডিভিশনে কর্মরত দুই প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ইলিয়াসের দুর্নীতি এখনও থামেনি। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিশেষ সখ্যতার কারণেই তিনি বেপরোয়া। এ সময় তারা সুপারিনটেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার হরিচন্দ্র হালদার ও চিফ ইঞ্জিনিয়ার মশিউর রহমান জোয়ারদারের নাম উল্লেখ করেন। তবে এগুলো এখনো অভিযোগ মাত্র, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা যায়নি।


অভিযোগ দিলেই উড়ে যায় ফাইল: ডিপিডিসির কল সেন্টার ১৬১১৬ চালু থাকলেও অনেক গ্রাহক অভিযোগ করেছেন, ফোন বা লিখিত অভিযোগ দিলেও তা কার্যকর হয় না। বরং স্থানীয় অফিসে অভিযোগ জানাতে গেলে ফাইল ঝুলে যায়। গ্রাহকেরা বলেন, “অভিযোগ দিলেই উল্টো হয়রানি বাড়ে।


ভুক্তভোগীদের গল্প: বনশ্রীর এক গ্রাহক  সোলায়মান হাসান বলেন, ট্রান্সফরমার কিনতে না চাইলে আমার সংযোগ তিন মাস আটকে রাখা হয়েছিল। রামপুরার আরেক গ্রাহক সাইফ আলম বলেন, আমার কাগজপত্র ঠিক ছিল। তারপরও ৫০ হাজার টাকা অতিরিক্ত দাবি করা হয়।


সুরক্ষা নাকি নীরবতা: অভিযোগকারীরা বলেন, মাঠপর্যায়ের অনিয়ম টিকতে পারে তখনই, যখন তা ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের সুরক্ষা পায়। ডিপিডিসির প্রকাশ্য কর্মী তালিকায় নির্বাহী পরিচালক (অপারেশনস) কিউ. এম. শফিকুল ইসলাম এবং নির্বাহী পরিচালক (অ্যাডমিন অ্যান্ড এইচআর) সোনা মণি চাকমার নাম রয়েছে। অভিযোগকারীদের দাবি, এদের বিশেষ সখ্যতা থাকার কারণেই প্রকৌশলী ইলিয়াসের মতো কর্মকর্তারা দায়মুক্তি পান। গত তিন বছরে দুদকে ইলিয়াসের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ গেলেও রহস্যজনক কারণে আটকে আছে ফাইল।  ফলে গ্রাহকদের আস্থা আরও নষ্ট হয়েছে।


পুরোনো অভিযোগের ছায়া: ডিপিডিসিতে অনিয়ম নতুন নয়। অতীতে বিভিন্ন সময়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের অভিযোগ এসেছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তদন্ত থেমে গেছে প্রাতিষ্ঠানিক ধীরগতি বা রাজনৈতিক প্রভাবে। একজন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এক গণমাধ্যমে বলেছিলেন, সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। কিন্তু মাঠপর্যায়ে বাস্তব চিত্র ভিন্নগ্রাহকের হয়রানি ও অতিরিক্ত খরচ যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।


সরঞ্জাম ক্রয়ে স্বচ্ছতার ঘাটতি: কোন প্রকল্পে কোন উপকরণ, কোন ব্র্যান্ড বা সরবরাহকারী এসব তথ্য প্রকাশ্যে নেই। ফলে নির্দিষ্ট সরবরাহকারীর চাপ সৃষ্টি হয়। বিশেষজ্ঞ ড. আতিকুর রহমান বলেন, বিদ্যুৎ শুধু অবকাঠামো নয়, এটি নাগরিক অধিকারের মৌলভিত্তি। ডিপিডিসিতে সিন্ডিকেট ও উপকরণ চাপানো সংস্কৃতি সুশাসনের জন্য মারাত্মক হুমকি।


দুর্নীতি দমন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট নাজমুল হুদা বলেন, দুদকের অভিযোগ ঝুলে থাকার মানে হলো প্রতিষ্ঠানগত ব্যর্থতা। জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে নতুন প্রকল্পও একই জালে আটকে যাবে।


এ ব্যাপারে ডিপিডিসির মুগদাপাড়া ডিভিশনের সহকারী প্রকৌশলী মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, আমি কোনো অনিয়ম করেনি। নির্বাহী প্রকৌশলী মুনসুর স্যার যে ভাবে বলেন সেই ভাবে কাজ করি। আমার অফিসে আসেন। 


আরএক্স/