রাজউকের রাজস্ব আয় তলানিতে
মো. রুবেল হোসেন
প্রকাশ: ০১:৫৫ পিএম, ৩রা সেপ্টেম্বর ২০২৫

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা শহরের পরিকল্পিত আধুনিকায়নের মূল চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে আসছে। বহুল প্রতীক্ষিত মেগা প্রকল্প, আবাসন খাতের রূপান্তর, অবকাঠামোগত বিস্তারে রাজউকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সংস্থাটি নিজেদের ইতিহাসের অন্যতম বড় রাজস্ব বিপর্যয়ের মুখোমুখি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজউক যেখানে ৮০০ কোটির বেশি রাজস্ব আদায় করেছিল, সেখানে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধ পেরিয়ে গিয়ে এখন পর্যন্ত আয় হয়েছে মাত্র ১০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক লাফে ৮৭.৫% রাজস্ব কমেছে। রাজউকের এই পতন শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দুরবস্থার ইঙ্গিত নয় বরং পুরো ঢাকা শহরের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের গতি থমকে যাওয়ার সরব বার্তা।
রাজউকের রাজস্ব মূলত আসে প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ, নকশা অনুমোদন ফি, উন্নয়ন প্রকল্পের ফি: ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র, জরিমানা ও অন্যান্য রাজস্ব উৎস। এই ধারাগুলোর উপর নির্ভর করেই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর শত কোটি টাকা আয় করে। তবে ২০২৪ সালের মে মাসে ঘটে যাওয়া একটি প্রযুক্তিগত বিপর্যয় রাজস্ব সংগ্রহে বিশাল প্রভাব ফেলেছে।
সার্ভার বিপর্যয় ও রাজউক কার্যত অচল: ২০২৪ সালের মে মাস থেকে রাজউকের মূল সার্ভার বিকল হয়ে পড়ে। এতে নকশা অনুমোদনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। যে অনলাইন সিস্টেমের মাধ্যমে প্ল্যান সাবমিশন, ভেরিফিকেশন, এবং ফি জমা হতো সেই পথ একেবারেই অচল হয়ে পড়ে। এর প্রভাবে: প্রায় ২৫ হাজারের বেশি নির্মাণ অনুমোদন আবেদন ঝুলে যায়। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়।। ফি জমা না পড়ায় রাজস্ব আদায় মুখ থুবড়ে পড়ে। সাধারণ মানুষও তাদের বাড়ির প্ল্যান অনুমোদন করাতে পারেননি।
রাজউকের জনসংযোগ কর্মকর্তা এক বিবৃতিতে বলেন, সার্ভার সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল। আমাদের আইটি বিভাগ ও কারিগরি টিম বিষয়টি সমাধানের জন্য কাজ করছে। তবে সময় লাগছে। জনগণকে অনুরোধ করছি ধৈর্য ধরার জন্য। এই বক্তব্য শোনার পরেই প্রশ্ন উঠেছে। রাজউকের মতো একটি জাতীয় উন্নয়ন সংস্থার কোনো কার্যকর ব্যাকআপ সিস্টেম নেই কেন? একটি সার্ভার অচল হয়ে গেলে পুরো রাজস্ব বন্ধ হয়ে যাবে এটা কি প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা নয়।
প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা না কি পরিকল্পনার অভাব: বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, এটি কেবলমাত্র সার্ভারের সমস্যা নয় বরং পরিকল্পনার অভাব ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ না করার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। রাজউকের আইটি অবকাঠামো এখনও ২০১০ সালের প্রযুক্তিতে চলছে, কোনো ক্লাউড-ব্যাকআপ বা রিডান্ড্যান্ট সিস্টেম নেই।
আইটি বিশেষজ্ঞ হাসনাত জামান বলেন,এটা কল্পনাও করা যায় না, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সার্ভার এক মাস বন্ধ থেকেও কোনো কার্যকর বিকল্প নেই। এটি শুধু প্রযুক্তির সমস্যা নয় এটি মনোভাব ও অগ্রাধিকার নির্ধারণের ব্যর্থতা।
ঢাকায় উন্নয়ন থেমে আছে: রাজউকের নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বহু নির্মাণ কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিরপুর, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প, উত্তরা সেক্টর ১৮২০ কুড়িল–বসুন্ধরা এলাকা, জিঞ্জিরা ও ডেমরা সংলগ্ন অবকাঠামো প্রকল্প। এই এলাকাগুলোতে রাজউকের অনুমোদন ছাড়া বড় কোনো ভবন বা অবকাঠামো নির্মাণ সম্ভব নয়। তাই প্রকৌশল, নির্মাণ, এবং আবাসন খাতের শত শত কোটি টাকার কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে।
প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দেও ধীরগতি: রাজউক সাধারণত প্রতিবছর পূর্বাচল, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় প্লট বরাদ্দ দিয়ে থাকে। এই বরাদ্দ থেকেই প্রতিষ্ঠানটি বড় অঙ্কের রাজস্ব পায়। কিন্তু চলতি অর্থবছরে কোনো নতুন প্লট বরাদ্দ হয়নি, বরং পুরাতন বরাদ্দগুলো নিয়েও ভোগান্তি বাড়ছে।
রাজউকের এক সাবেক প্রকৌশলী বলেন,বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ চায় না রাজউকের সঙ্গে জড়াতে। কোনো ফাইল অগ্রগতি পাচ্ছে না, নকশা পাস হচ্ছে না, অনুমোদন আটকে আছে। এতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বড় কোম্পানিগুলো পর্যন্ত মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
রাজস্ব কমলে কী হয়: রাজউক যে রাজস্ব সংগ্রহ করে, সেটি ঢাকার পরিকল্পিত উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়। এর মাধ্যমে রাস্তা নির্মাণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন, সরকারি ফ্ল্যাট প্রকল্প বাস্তবায়ন,পার্ক ও খেলার মাঠ সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা নিরসনে অবকাঠামো তৈরি।এই কাজগুলো করা হয়। তাই রাজস্ব হঠাৎ করে ৮০০ কোটি থেকে ১০০ কোটিতে নেমে আসা মানে হচ্ছে এইসব উন্নয়ন থমকে যাওয়া। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব শুধু নাগরিক জীবনে নয় পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও হবে ভয়ঙ্কর।
রাজস্ব পতনের খসড়া তালিকা: খাত আগের রাজস্ব (২০২৩২৪) বর্তমান (২০২৪২৫) পতনের হার
নকশা অনুমোদন ৩০০+ কোটি ৩০ কোটি -৯০%
প্লট/ফ্ল্যাট বিক্রি ২৮০+ কোটি ২৫ কোটি -৯১%
উন্নয়ন ফি ২২০ কোটি ৪৫ কোটি -৭৯%
মোট রাজস্ব ৮০০ কোটি ১০০ কোটি -৮৭.৫%
দুর্নীতি, দালাল ও প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণ: রাজউকের রাজস্ব সংগ্রহ কমার পেছনে আরেকটি গোপন বিষয় রয়েছে। অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও দালালচক্র। অনেক জায়গায় অভিযোগ উঠেছে, নকশা অনুমোদন পেতে ঘুষ লেনদেন হয়। বর্তমানে সার্ভার অচল থাকলেও ম্যানুয়ালি পাস করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দালালরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এমন দাবি করেছেন একাধিক ভুক্তভোগী। প্রভাবশালী ঠিকাদার ও রাজনীতিবিদদের জমি সংক্রান্ত ফাইল ‘বিশেষ সুবিধা’তে ছাড়পত্র পায় যার কারণে সাধারণ মানুষের আবেদন বছরের পর বছর আটকে থাকে।
নাগরিকরা কী ভাবছে: ঢাকার উত্তরার এক বাসিন্দা বাসিরা ইসলাম বলেন, আমি নিজের জমিতে বাড়ি বানানোর জন্য মার্চে নকশা জমা দিই। এখন সেপ্টেম্বর কোনো খবর নেই। অফিসে গেলে বলে সার্ভার ডাউন। এটা কী ধরনের সেবা? আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার জানান, কোম্পানির কোটি টাকার কাজ আটকে আছে শুধু রাজউকের অনুমোদনের কারণে। অথচ ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়ছে প্রতিদিন।
অন্য দেশের অভিজ্ঞতা: বিশ্বের বড় শহরগুলো যেমন: সিঙ্গাপুর, দুবাই, বা ব্যাঙ্কক তাদের শহর উন্নয়নের জন্য ই-গভর্ন্যান্সে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। সেখানে ৩৫ দিনের মধ্যে প্ল্যান পাস হয়, একটি ক্লাউড ভিত্তিক সিস্টেম পুরো প্রক্রিয়া ট্র্যাক করে। তথ্য হালনাগাদ থাকে নাগরিকদের হাতের মুঠোয়। তুলনায় রাজউকের অবস্থান অত্যন্ত পশ্চাৎপদ।
রাজউকের জন্য সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা: এগুলো হলো- সার্ভার রিডিজাইন করে ক্লাউড বেইজড সিস্টেম চালু করা। দ্রুত ব্যাকআপ সার্ভার চালু ও রিডান্ড্যান্সি নিশ্চিত করা। সবার জন্য ট্র্যাকেবল সেবা চালু (মোবাইল অ্যাপ, এসএমএস সেবা) করা। প্রকল্প ও নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়করণ করা। দালালমুক্ত সেবা নিশ্চিতে অভিযোগ ব্যবস্থা জোরদার করা। নতুন প্রকল্প অনুমোদনের জন্য ৬০ দিনের মধ্যে বাধ্যতামূলক নিষ্পত্তি বিধান করা। বার্ষিক রাজস্ব সংগ্রহের উপর ভিত্তি করে কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন করা।
কী অপেক্ষা করছে: রাজউকের সামনে এখন দুটি পথ। পুরানো আমলাতান্ত্রিক, ধীরগতির, দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থায় চলা। একটি আধুনিক, স্বচ্ছ, প্রযুক্তিনির্ভর নগর উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে রূপান্তর হওয়া। ঢাকার নাগরিকদের আশা, রাজউক দ্বিতীয় পথটিই বেছে নেবে। তা না হলে শুধু ১০০ কোটি টাকার রাজস্ব নয়। আগামী দশকে ঢাকার টেকসই উন্নয়ন পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। রাজউকের রাজস্ব পতনের গল্প শুধুমাত্র টাকার হিসাব নয়। এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা, এবং আমলাতান্ত্রিক শৃঙ্খলার অনুপস্থিতির দলিল।সময় এসেছে রাজউককে ঢেলে সাজানোর। জনগণের টাকায় পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নাগরিকেরা উত্তর চান, ‘কেন উন্নয়ন থেমে গেছে।
এ প্রসঙ্গে রাউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলামের দপ্তরে ধন্না দিলেও বক্তব্য মেলেনি। এমনকি মুঠোফোনে সাক্ষাতের সময় দিয়ে তিনি দেখা করেননি। চেয়ারম্যান দপ্তরে তিন ঘন্টা ধন্না ধরেও দেখা মেলেনি।
আরএক্স/