চলনবিলের হলুদের স্বর্গরাজ্যে মৌচাষ


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


চলনবিলের হলুদের স্বর্গরাজ্যে মৌচাষ

গুরুদাসপুর প্রতিনিধি: উত্তরবঙ্গের সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর এই তিন জেলাজুড়ে চলনবিল বিস্তৃত। বর্ষাকালে এই চলনবিলের চারপাশ পানিতে থই থই করে। আর এই শুষ্ক মৌসুমে সরিষা চাষে চলনবিল হলুদের সমুদ্রে পরিণত হয়। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে যতদূর চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। এ যেন হলুদ এর স্বর্গরাজ্য।

প্রকৃতির নয়নাভিরাম এই সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমী মানুষকে। দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠে এমন চোখ জুড়ানো হলুদ এর সৌন্দর্যের দেখা মিলবে পুরো চলনবিল এলাকায়। চলনবিলের নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া উপজেলা ছাড়াও সিরাজগঞ্জের তাড়াশ,  উল্লাপাড়া, সদর,,রায়গঞ্জসহ বেশ কয়েকটি এলাকাজুড়ে এখন হলুদের শোভায় ছেয়ে আছে।

মাইল এর পর মাইল এই হলুদ সমুদ্রে যখন বাতাসে দোল খায় সরিষার ফুলের এক একটি গাছ দেখে তখন যেন মন ভরে যায়। আর এই হলুদ ক্ষেতের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে আঁকাবাঁকা গ্রামীণ মেঠোপথ।

বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এই হলুদের মাঠে কান পাতলেই শোনা যায় মৌ মাছির ভন ভন শব্দ। একটি ফুল থেকে আর একটি ফুলে ছুটে চলেছে লাখ লাখ মৌমাছি। এই মৌমাছিগুলো সারাদিন ব্যস্ত সরিষার প্রতিটি ফুল থেকে মধু আহরণে।

মৌ মাছি মৌ মাছি, কোথা যাও নাচি নাচি, দাড়াও না একবার ভাই, ওই ফুল ফোটে বলে, যাই মধু আহরণে দাঁড়াবার সময় তো নাই। সত্যিই কবি নব কৃষ্ণ ভট্টাচার্যের সেই বিখ্যাত কবিতাটির মতো মধু আহরণে মৌমাছির ব্যস্ততার যেনো শেষ নেই।

আর এই মৌ মাছি দিয়েই মধু আহরণ করছে মৌ চাষিরা। সরিষা ক্ষেতের পাশে শত শত মৌ বাক্স স্থাপন করে বিশেষ পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহে এখন ব্যস্ত এই মৌচাষিরা। বিশেষভাবে তৈরি এই সব মৌ বাক্সে ৭ থেকে ৮ টি ফ্রেম বা মৌচাক থাকে। এক একটি মৌ বাক্সে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার মৌ মাছি থাকে। এই মৌ মাছিগুলোই সরিষা ফুল থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে মধু সংগ্রহ করে বাক্সে থাকা মৌচাকে জমা করে। আর মৌচাষিরা ৭ দিন পর পর ধোঁয়ার মাধ্যমে চাক থেকে মৌ মাছি সরিয়ে মৌচাকগুলো একটি মেশিনে দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মধু আহরণ করে।

প্রতিটি মৌচাকে একটি করে রাণী মৌ মাছি থাকে। আর এই রাণী মৌ মাছির জন্যই সারাদিন ফুল থেকে মধু আহরণ করে মৌচাকে জমা করে অন্য মৌমাছিরা। ১ ফোঁটা মধুর জন্য একটি মৌমাছিকে ১০ বার ফুল থেকে মধু তুলতে হয়। এক একটি মৌমাছি ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে এবং মধু সংগ্রহ করে আবারও তার নিদিষ্ট বাক্সে ফিরে আসে বলে জানান এই মৌচাষি।

এক সময় কৃষকদের ভুল ধারণা ছিল যে সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌচাষ করলে ফসলের ক্ষতি হয়। তবে বর্তমানে এই ভুল ধারণা থেকে কৃষকরা বের হতে পেরেছেন বলে জানান মৌচাষি বাবু। কৃষক শফিকুল  ইসলাম জানান সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহে প্রতিটি ফুলে পরাগায়ন হয় এতে সরিষার ফলন বেশি পাওয়া যাবে।

প্রকৃতির এই হলুদ সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে দল বেঁধে ছুটে আসছে প্রকৃতিপ্রেমীরা। অনেকে তার মুঠো ফোনের ক্যামেরা বন্দি করছে প্রকৃতির এমন রূপ, রং আর সৌন্দর্য।

চলনবিল অঞ্চলের তিন জেলার (পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর) উল্লাপাড়া, তাড়াশ, শাহজাদপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুরা, ফরিদপুর, বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া উপজেলার প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে এবার সরিষা আবাদ হয়েছে বলে স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। এসব সরিষা ক্ষেতে পাঁচ শতাধিক মৌবাক্স স্থাপন করা হয়েছে। এসব মৌবাক্সে গড়ে তিন-চারজন করে কর্মচারী কর্মরত।

সরেজমিন ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চলনবিলের বাইরের জেলা টাঙ্গাইল, নড়াইল, যশোর, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর ও গোপালগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মৌচাষিরা চলনবিলে তাদের মৌবাক্স বসিয়েছেন মধু সংগ্রহের জন্য। গত নভেম্বর থেকে খামারিরা মধু সংগ্রহের জন্য বাক্স স্থাপন করেছেন।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মৌ খামারের মাধ্যমে কয়েক শ’ বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রতি বছর মধু সংগ্রহ করে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে থাকেন।

উত্তরবঙ্গ মৌচাষি সমিতির সহসভাপতি আবদুর রশিদ জনবাণীকে বলেন, গত বছর চলনবিল অঞ্চলে প্রায় দুই হাজার মেট্রিক টনের বেশি মধু সংগ্রহ হয়েছিল। আবহাওয়া ভালো থাকলে এ পরিমাণ বা এর চেয়ে বেশি সংগ্রহ হবে আশা করি। তিনি বলেন, দেড়-দুই মাস আমরা চলনবিলের সরিষা ক্ষেতের মধু সংগ্রহ করব। এরপর আমরা যাবো শরীয়তপুরে। সেখানে কালোজিরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে বাক্স বসাব। এরপর আসবে লিচুর ফুল থেকে মধু সংগ্রহের মৌসুম। প্রথমে নাটোরে এবং এরপর দিনাজপুরে লিচু চাষ এলাকায় বাক্স বসাবো। আবদুর রশিদের বাড়ি সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানার হাটিপাড়া গ্রামে। তিনি সুপরিচিত মধুচাষি, একজন ভালো প্রশিক্ষকও বটে। তিনি আরো জানান, তিনি চলনবিল অঞ্চলের উল্লাপাড়া উপজেলার আলীগ্রামে ৩৭০টি মৌবাক্স স্থাপন করেছেন। এখনো ওইভাবে মধু সংগ্রহ শুরু হয়নি। যতটুকুই হচ্ছে, ক্ষেত থেকে বিভিন্নজন কিনে নিচ্ছেন। বাকিটা জমা করে রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা ২০০ টাকা কেজিতে মধু বিক্রি করছি। বিভিন্ন কোম্পানির কাছে এই মধু বিক্রি করে থাকি। গত বছর ছয়-সাত হাজার টাকা মণে মধু বিক্রি করেছি।

আবহাওয়া ভালো থাকায় চলতি মৌসুমে মধু সংগ্রহ বেশ ভালো বলে জানান মৌচাষি সমিতির সহ সভাপতি আব্দুর রশিদ। বাজার ব্যবস্থার পাশাপাশি সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মধু শিল্পের আরও প্রসার ঘটানো সম্ভব বলেও জানান তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের তথ্য মতে, চলতি বছর চলনবিল অঞ্চলে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ করা হয়েছে। যা থেকে প্রায় ২ হাজার টন মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন মৌচাষিরা।