মেঘনায় নিয়োগ এমডি টিপুর পেটে ১০ কোটি টাকা


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ১২:৪৮ পূর্বাহ্ন, ১৫ই জুলাই ২০২৫


মেঘনায় নিয়োগ এমডি টিপুর পেটে ১০ কোটি টাকা
ছবি: পেপার কাটিং

বশির হোসেন খান ও মোহম্মদ এরশাদ: “আমি কিছু চাই না, শুধু পরীক্ষা দিতে চাই।” ঢাকার একটি নিয়োগ পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন এক তরুণী। তাঁর গলা কেঁপে উঠছিল, চোখে পানি, হাতে হাইকোর্টের আদেশের কপি। কিন্তু তবু তিনি পরীক্ষাকক্ষে ঢুকতে পারেননি। ওই মুহূর্তের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা লাখো মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়। প্রশ্ন ওঠে রাষ্ট্র যদি আদালতের আদেশও কার্যকর করতে না পারে, তাহলে একজন সাধারণ নাগরিকের অধিকার কোথায়? অভিযোগ সূত্র বলছে, ৮০ জন নিয়োগ পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে মোট ১০ কোটি টাকা টিপু সুলতান সিন্ডিকেটের পকেটে। এই সিন্ডিকেট আরো রয়েছে দুই ব্যক্তি, যারা স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে পরিচিত। তারা হলেন মেঘনা পেট্রোলিয়ামের জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) মো. ইনাম ইলাহী চৌধুরী ও আর এমডি টিপু সুলতানের ক্যাশিয়ার ঢাকা জোনের ডিজিএম মো. লুৎফর রহমান। 


এদিকে শুক্রবার (০৪ জুলাই) রাজধানীতে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের নিয়োগ পরীক্ষা ছিল। এই প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীন। পরীক্ষা দিতে আসা অন্তত চার তরুণ-তরুণী হাইকোর্টের আদেশসহ সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে উপস্থিত হন। তাদের হাতে ছিল রিট পিটিশন নম্বর ১৭০৫/২০২৫, সংবিধানের ১০২(২)(ক)(র) ও (রর) ধারায় দেওয়া আদালতের রায়, কোর্ট ফি জমার রশিদসহ সবকিছু। তবুও গেটের সামনে ‘নাম তালিকায় নেই, প্রবেশপত্র নেই’ এই যুক্তিতে তাদের আটকে দেওয়া হয়। পরীক্ষা আয়োজনের দায়িত্বে থাকা মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড পরে জানায়, রায় পাওয়া গিয়েছিল বৃহস্পতিবার (০৩ জুলাই)। হাতে সময় ছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। টেলিটক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (বিআইএম) এর সঙ্গে সমন্বয় না হওয়ায় নতুন করে আবেদন গ্রহণ, প্রবেশপত্র তৈরি ও কেন্দ্রে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই তারা আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কি আদালতের রায় কার্যকর না করে শুধু সমন্বয় হয়নি বলেই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে? 


ভিডিওতে কান্নারত এক তরুণী বলেন, আমার কাছে কোর্টের আদেশ আছে। আমি শুধু পরীক্ষা দিতে চাই। এটা কি অন্যায় কিছু? আরেক তরুণ বলছিলেন, আমরা রাত জেগে প্রস্তুতি নিয়েছি। সকালে এসে জানলাম, তালিকায় নাম নেই। তাহলে কোর্টের আদেশের মানে কী?


আরও পড়ুন: খিলগাঁওয়ে ডিপিডিসির প্রকৌশলী জুবায়ের ফাইল বাণিজ্যে কোটিপতি


ঘটনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। কেউ মন্তব্য করেন, বাংলাদেশে এখন কোর্টও ভরসা নয়!” আরেকজন লিখেন, আমি রোল ১৯০০১৯১৯। পাশ করিনি। আমার পেছনে বসা ১৯০০১৯২০ পাশ করেছে। এটা কাকতালীয় না, সিন্ডিকেটের কাজ। অভিযোগ আরও প্রবল হয় যখন জানা যায়, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. টিপু সুলতান, জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) মো. ইনাম ইলাহী চৌধুরী ও ঢাকা জোনের ডিজিএম মো. লুৎফর রহমান একটি অদৃশ্য সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন। তাদের ইচ্ছাতেই নাকি ঠিক হয় কারা পাস করবে, কারা নয়।


একজন অভ্যন্তরীণ কর্মচারী, জাহিদ সরকার, ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি পাঁচ বছর ধরে লেবার হিসেবে কাজ করছি, সততার সঙ্গে। কিন্তু সে সততার মূল্য আমি পেলাম না, কারণ আমি কারো কাছে ঘুষ দিইনি। ১৫ লাখ দিলেই আমার চাকরি হয়ে যেত। গরিব মানুষ আমি, আমার টাকাও নাই চাকরিও নাই।


আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেঘনা পেট্রোলিয়াম সরাসরি আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করেছে। সময় না থাকাটা অজুহাত হতে পারে না। প্রয়োজনে আলাদা কেন্দ্রে পরীক্ষা নিয়ে রায় বাস্তবায়ন করা যেত। অথচ এখানে চারটি স্বপ্নকে গেটের বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পূর্বেও এমন ঘটনা ঘটেছে। আরমান হোসেনসহ ছয়জন এক রিটে হাইকোর্টের রায় পেয়েছিলেন, যাতে তাদের পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান আপিল বিভাগে গিয়ে রায় স্থগিত করায় তারা অংশ নিতে পারেননি। এবারও আদালতের রায় থাকার পর সময় না থাকার অজুহাত দেখানো হয়েছে।


আরও পড়ুন: যৌন নির্যাতনের আরেক নাম বিমান বাংলাদেশ


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রার্থী বলেন, আমার যদি নাম তালিকায় না থাকে, তাহলে আমি কীভাবে আদালতের আদেশ প্রমাণ করব? কোর্টের রায়ও যদি মানা না হয়, তাহলে এই দেশে ন্যায়বিচার কোথায়? চারজন নয়, চারটি জীবন। তাদের চোখে ছিল বিশ্বাস, হাতে ছিল আদালতের রায়, কিন্তু তারা পরীক্ষায় অংশ নিতে পারলেন না। কারণ তাদের নাম ‘তালিকায় ছিল না’। নিয়োগ পরীক্ষা নয়, এটা ছিল রাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্মকে প্রত্যাখ্যান করার নগ্ন দলিল। এ ঘটনায় শুধু মেঘনা পেট্রোলিয়ামের নয় বরং রাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। আদালতের রায় কার্যকর না হলে, প্রশাসনিক ব্যর্থতা যদি ন্যায়বিচারের ওপর চেপে বসে, তাহলে সাধারণ নাগরিক যাবে কোথায়?


ভুক্তভোগী সাগর বলেন, চারজন মানুষ কেবল নয়, চারটি পরিবার আজ হতাশায় নিমজ্জিত। এই কান্না কি রাষ্ট্রের কানে পৌঁছাবে? শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন থেকে যায় এই তরুণ-তরুণীদের জন্য কি কোনো প্রতিকার আছে? নাকি এই ভিডিও, এই কান্না, এই হতাশা ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ থাকবে? রাষ্ট্র কি পারবে এই বিশ্বাসভঙ্গের ভার বহন করতে? নাকি আমি শুধু পরীক্ষা দিতে চাই এই সরল আবেদনও আজকের বাংলাদেশে অসম্ভব হয়ে উঠেছে?


এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ বলেন,  নিয়োগে আর্থিক লেনদেন দুর্নীতি মধ্যে পড়ে। দিন দিন বাড়ছে দুর্নীতি। তাই এর লাগাম টানা দরকার।


আরও পড়ুন: ডিজিটাল প্রতারণায় মাসুদ শত কোটি টাকার মালিক

  

এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,  নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। যেহেতু এই নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাই বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।

   

এ ব্যপারে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (এইচ আর) মোহাম্মদ ইনাম ইলাহী চৌধুরীর সঙ্গে বার বার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি কল রিসিভ করেননি, এমনকি খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোন উত্তর মেলেনি। এ ব্যপারে মেঘনার জেনারেল ম্যানেজার (এ অ্যান্ড এফ) সঞ্জীব নন্দী বলেন, টাকা লেনদেনের বিষয় আমার জানা নেই।টাকা দেওয়ার প্রমাণ থাকলে দেখাতে বলেন। এ ছাড়া আমি কিছু বলতে পারি না।  এবিষয়ে এমডি সাহেব জানেন। এ ব্যপারে মেঘনার এমডি টিপু সুলতানের মুঠো ফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি। 


এ বিষয়ে  জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ঘটনা সম্পর্কে আমি অবগত হয়েছি। ইতোমধ্য মেঘনার চেয়ারম্যান ও এমডিকে পরীক্ষার্থীর ফলাফল স্থগিত রাখার জন্য বলে দিয়েছি। প্রয়োজনে পরীক্ষা আবার নেওয়া হবে। মেঘনার এমডি ঘুষ নিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে চাকরি দিচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।  

আগামী পর্বে-পদের মেয়াদ বাড়াতে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ এমডি টিপুর...


#আমি কিছু চাই না, শুধু পরীক্ষা দিতে চাই, দাবি পরীক্ষার্থীদের

#হাইকোর্টের আদেশ সত্ত্বেও ঢুকতে পারলেন না চাকরিপ্রত্যাশীরা


# প্রয়োজনে পরীক্ষা আবার হবে

- মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, জ্বালানি উপদেষ্টা 


# নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকতে হবে

ড. ইফতেখারুজ্জামান নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি  


এমএল/