প্রকল্পের কোটি কোটি টাকার লোপাট
৪ বহুতল ভবনের মালিক বিআইএম’র তানভীর
মো. রুবেল হোসেন
প্রকাশ: ০২:০৪ অপরাহ্ন, ১৪ই জুলাই ২০২৫

মো. রুবেল হোসেন: রাজধানীর আদাবর এলাকায় নির্মাণাধীন একাধিক বহুতল ভবন ঘুরে দেখতে গেলে স্থানীয়রা জানান ‘ভবনগুলোর মালিক একজন সরকারি কর্মকর্তা, নাম তানভীর হোসাইন।’ অনুসন্ধানে জানা গেল, এই তানভীর হোসাইন হচ্ছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (বিআইএম) এর প্রকল্প পরিচালক। যিনি বর্তমানে চারটি বহুতল ভবন নির্মাণে সরাসরি সম্পৃক্ত। সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে অল্প সময়ে এত বিপুল সম্পদের উৎস কী সেই প্রশ্নে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তানভীর হোসাইন।
তানভীর হোসাইন নিজেকে “অবৈধ সম্পদ মুক্ত” বলে দাবি করেন। অথচ তার পরিবারের নামে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি কোটি টাকার ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রভাবশালী মন্ত্রীর ছত্রচ্ছায়া এবং একটি চার সদস্যের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন এই সম্পদ সাম্রাজ্য।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট কে শক্তিশালীকরণ প্রকল্প শুরু করে সরকার, যার প্রাথমিক বাজেট ছিল প্রায় ১৪৭ কোটি টাকা। এরমধ্যে ভবন নির্মাণ ৮৫ কোটি, প্রশিক্ষণ ও বিদেশ ভ্রমণ বাবদ ৬২ কোটি টাকা। ৬২ কোটি টাকার মধ্য থেকে ৫৬ কোটি টাকা ভবন নির্মাণ খাতে প্রতিস্থাপন করলেও তা কোথায় ব্যয় করা হয়েছে তার কোন হদিস নেই। ২০২২ সালে আরও ১৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ আনে তাতে সব মিলে প্রকল্প ব্যয় দাড়ায় ১৫৪ কোটি টাকা। তানভীর হোসাইন তৎকালীন সময় উপ-প্রকল্প পরিচালক হিসেবে প্রেষণে যোগ দেন। পরে সরকারের ঘনিষ্ঠ মহলের অনুকূল্যে তিনি প্রকল্প পরিচালকের চেয়ার বাগিয়ে নেন।
প্রকল্পটি ছিল প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, নতুন ভবন নির্মাণ, সফটওয়্যার ও গবেষণাগার সরঞ্জাম কেনা ইত্যাদি নিয়ে। দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় নিয়োগ, কেনাকাটা ও ঠিকাদারির ক্ষেত্রে সরাসরি অনিয়ম হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে প্রকল্পের বড় অংশের বরাদ্দ ভাগ হয়ে গেছে সিন্ডিকেটের মধ্যে।
তানভীর হোসাইনের ভাইয়ের নামে গঠিত ‘সরদার ট্রেডার্স’ এবং মায়ের নামে করা ‘হালিমা ট্রেডার্স’ নামের প্রতিষ্ঠান দুটি বিআইএম প্রকল্পে নিয়মিত ঠিকাদারি করেছে। তবে কাগজপত্রে এদের মালিকানায় তানভীরের নাম নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও ঠিকাদারি তালিকায় এসব প্রতিষ্ঠানের একাধিক সরকারি প্রকল্পে অংশগ্রহণের প্রমাণ মিলেছে।
একাধিক সূত্র বলছে, দরপত্র ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছে। এর বিনিময়ে প্রকল্পের ভেতরে ঘুষ-বাণিজ্য চলে। যদিও তানভীর হোসাইন বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত নই। এটা নিছক কাকতালীয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এলাকার মেট্র মার্কেটের গলিতে আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতার অফিসে নিয়মিত বৈঠকে বসেন তানভীর হোসাইন। এই বৈঠকে তার সঙ্গে আরও তিনজন অংশ নেন, যারা সবাই শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রভাবশালী অবস্থানে রয়েছেন।
এই চারজনের সিন্ডিকেট মিলে প্রকল্প অনুমোদন, ঠিকাদারি বরাদ্দ এবং নিয়োগ বাণিজ্যে সম্পৃক্ত। শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তানভীর এখন মন্ত্রণালয়ে কাউকে পাত্তা দেন না। সিন্ডিকেটই তার ছত্রচ্ছায়া।
‘বিআইএমকে শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। নিয়ম অনুযায়ী এই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করে অর্থ ও দায়িত্ব হস্তান্তর করার কথা। তবে এখনো তা হয়নি। প্রকল্প অফিস সূত্র জানায়, “হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করছেন তানভীর হোসাইন, যাতে কিছু হিসেব গোপন রাখা যায়। পরিকল্পনা কমিশনের একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পে ব্যয় উপযোগিতা অনুপাতে যথেষ্ট অসংগতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টদের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।
বিপুল সম্পদের পাহাড়:
তানভীর হোসাইনের নামে এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের নামে ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে যেসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে তা নিম্নরূপ:
আদাবরে দুটি ছয়তলা ভবন (আংশিক ভাড়া ও বিক্রয় চলছে)। মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে একটি করে আটতলা নির্মাণাধীন ভবন। দক্ষিণ খান ও সাভারে প্লট (নামজারি প্রক্রিয়াধীন)। বনানীতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট (আংশিক মালিকানা দাবি করেছেন)। অন্তত তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৪ কোটির বেশি টাকা জমা। দুইটি গাড়ি :একটি ব্র্যান্ড নিউ এসইউভি এবং একটি নোয়া মাইক্রোবাস।
তানভীর হোসাইন দাবি করেছেন, আমি এককভাবে কিছুই করিনি, সব কিছুই অংশীদার ভিত্তিতে। কিন্তু সরকারি চাকরি করে মাত্র কয়েক বছরে এত বিপুল সম্পদের উৎস কী—সে প্রশ্নে নিরুত্তর তিনি।
প্রকল্প চলাকালে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৩৪ জনকে, যাদের অনেকে নিয়মিত বিআইএম ক্যাম্পাসে কর্মরত থাকলেও কোনো অনুমোদনপ্রাপ্ত পদে ছিলেন না। শিল্প মন্ত্রণালয়ের কোনো নিয়োগ বোর্ড বা লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগপত্র ইস্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রকল্পের সাবেক একটি ভিজিটিং অফিসার জানান, “ফাইল পাস করাতে চাইলে ভাগ বাটোয়ারার অঘোষিত নিয়ম মানতে হতো।” এদের মধ্যে কিছু নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বিআইএমের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে ১৩৪.৩৪ কোটি টাকার একটি নতুন আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প, যার ডিপিপি প্রস্তুত হচ্ছে বর্তমানে। এই প্রকল্পের পরিচালকের পদ পেতে তানভীর হোসাইন এখন থেকেই বিভিন্ন মহলে তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে একাধিক দপ্তরে সুপারিশপত্র পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
তানভীর হোসাইনের এসব সম্পদের উৎস সম্পর্কে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কোনো অনুসন্ধান শুরু করেনি। যদিও গণমাধ্যমে এসব তথ্য উঠে এসেছে, সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি বা পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
একজন দুর্নীতি বিশ্লেষক বলেন, দুদক শুধু কাগজে কলমে জিরো টলারেন্সের কথা বলে, বাস্তবে বড় কর্মকর্তাদের দুর্নীতি তদন্ত হয় না বললেই চলে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআইএম যেন এক ব্যক্তির হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তানভীর হোসাইনের মতো একজন প্রেষণ কর্মকর্তা কীভাবে এত অল্প সময়ে সম্পদের পাহাড় গড়লেন, কাদের ছত্রছায়ায়, কারা এই সিন্ডিকেটে সেই প্রশ্ন এখন জনমানুষের। প্রকল্পের অর্থ লোপাট, ঠিকাদারি বাণিজ্য, নিয়োগ দুর্নীতি সব মিলিয়ে এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুধু কথার কথা।
এসডি/