বিসিএসআইআরে ৬ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনায় ‘ভাগ বাটোয়ারা


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ০৪:২৯ অপরাহ্ন, ১৩ই জুলাই ২০২৫


বিসিএসআইআরে ৬ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনায় ‘ভাগ বাটোয়ারা
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

#আগে ভাগ, পরে নাটক

#সাজানো টেন্ডার, গোপন সুবিধাভোগী

#যন্ত্র কেনা হলেও ব্যবহার হয় না

#ইফতারের টেবিলে অগ্রিম ঘুষ লেনদেন

# চূড়ান্ত সভা ছিল কেবল আনুষ্ঠানিকতা


বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর) প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি কেনার টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, দরপত্র জমা দেওয়ার আগেই নির্দিষ্ট চারটি প্রতিষ্ঠানকে গোপনে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়, আর তার বিনিময়ে হাতবদল হয় মোটা অঙ্কের ঘুষ। মূল্যায়ন কমিটির চূড়ান্ত সভা বসে ২৩ এপ্রিল, তবে অভিযোগ বলছে, সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবে হয়েছিল এক মাস আগেই, ২৩ মার্চ, রাজধানীর ধানমন্ডির অ্যামব্রোসিয়া রেস্তোরাঁয় আয়োজিত এক ‘ইফতার বৈঠকে’।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, ওইদিন চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে অগ্রিম ঘুষ হিসেবে নেওয়া হয় ৬০ লাখ টাকা, আর পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে আনতে ঠিক হয় প্রায় ১ কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারার পরিকল্পনা। গোপন সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন টেন্ডার কমিটির সদস্য সচিব ও গবেষণা সমন্বয়কারী ড. মো. নুরুল হুদা ভূঁইয়া, ঢাকা গবেষণাগারের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. মো. হোসেন সোহরাব, ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার অ্যানালিটিক্যাল রিসার্চ (ইনারস)-এর পরিচালক ড. মো. সেলিম খান, সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার সত্যজিৎ রায় রনি, উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. বেনজির আহমেদ এবং কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি কাজী আব্দুল্লাহ আল মামুন।


অভিযোগ অনুযায়ী, টেন্ডার ডাকা হয় ৮টি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে। কিন্তু যন্ত্রপাতির স্পেসিফিকেশন এমনভাবে বানানো হয়েছিল, যাতে চারটি নির্ধারিত কোম্পানি ছাড়া কেউ টেকনিক্যাল যোগ্যতা অর্জন করতে না পারে। এটিই টেন্ডার কারচুপির পরিচিত কৌশল— ‘সুবিধাভোগী বান্ধব শর্ত সংযোজন’, যেখানে দরপত্রের শর্তপত্র এমনভাবে লেখা হয়, যেন নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কেউ অংশ নিতে না পারে। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এত বড় অঙ্কের টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হলেও, সেগুলোর অনেক সময় কোনো ব্যবহার হয় না। যেমন, ‘পেশেন্ট বেড পরিবহনের জন্য’ কেনা একটি বিশাল লিফট এখনও অচল পড়ে আছে— কিনে ফেলা হলেও কখনও ব্যবহার শুরুই হয়নি। অথচ এর বিল পরিশোধ করা হয়ে গেছে আগেই, পুরোপুরি। এই ঘটনায় অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই অতীতে নানা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। 


ড. হোসেন সোহরাবের বিরুদ্ধে রয়েছে অনুমোদনহীন কাজের আদেশ ও নিরীক্ষা আপত্তি সত্ত্বেও বিল প্রদানের অভিযোগ। ড. সেলিম খানের নাম জড়িয়েছে ১০ কোটি টাকার অডিট আপত্তি ও গাছ বিক্রির অনিয়মে। সত্যজিৎ রায় রনি চাকরির বয়সসীমা পেরিয়ে গেলেও বহাল, এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলাও রয়েছে। মো. বেনজির আহমেদ নিয়োগে কোটি টাকার দুর্নীতিতে জড়িত থাকার পাশাপাশি, দুদকের চিঠি গায়েব করার অভিযোগেও অভিযুক্ত। আর কাজী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে একাধিক পদোন্নতি ও মানবসম্পদ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার।


দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র বিশ্লেষণ করে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয় দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা হয় না, প্রভাবশালী কর্মকর্তারা থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।


একজন সাবেক গবেষণা কর্মকর্তা বলেন, গবেষণার নামে যা চলছে, তা মূলত কিছু গোষ্ঠীর অর্থ বানানোর উৎসে পরিণত হয়েছে। যন্ত্রপাতি কেনা হয়, কিন্তু ব্যবহার হয় না। অথচ বিল হয়ে যায় শতভাগ।


সরকার প্রতিবছর গবেষণা উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও, সেই অর্থের বড় অংশ চলে যাচ্ছে টেন্ডার কারচুপি, অপ্রয়োজনীয় যন্ত্র কেনা ও অস্বচ্ছ বিল পরিশোধে। এ অবস্থায় নিরপেক্ষ তদন্ত, দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে সরকারের গবেষণা খাতের প্রতি জনআস্থা আরও কমে যাবে।


এ বিষয় বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ এর চেয়ারম্যান ড. সামিনা আহমেদের মুঠো ফোন কল দিলে তিনি রিসিপ করেননি। এমকি ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে উত্তার মেলেনি। 


আরএক্স/