জীবনের পরোয়া না করে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


জীবনের পরোয়া না করে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা

উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র শেখ হাসিনা। একজন সংগ্রামী রাজনৈতিক নেত্রী, একজন সাহসী যোদ্ধা, বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তির আলোকবর্তিকা, একজন মমতাময়ী মানবিক নেত্রীর নাম শেখ হাসিনা।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ৫ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সন্তান হলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

পিতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে পাওয়া নিখাঁদ দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক বুৎপত্তি তাকে অমিত সক্ষম করেছে। ধৈর্য্যশীলতা, স্মরণশক্তি, কৃতজ্ঞতাবোধ, নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যথার্থ সিদ্ধান্ত প্রদান শেখ হাসিনাকে কিংবদন্তী নেতায় পরিণত করেছে।

১৯৭৫ সালে যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, সে সময় বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন কেবল শেখ হাসিনা এবং তাঁর বোন শেখ রেহানা। সপরিবারে পিতার মৃত্যুর পর প্রবাসজীবন বাধ্যতামূলক হয়ে যায় শেখ হাসিনার জন্য। পরিবারের সকল সদস্য নিহত হাওয়ার ছয় বছর পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে প্রবাস থেকে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। দেশে ফিরে এসেছিলেন একটি স্বপ্নের বাংলাদেশের নির্মাতা হওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে দলের দায়িত্বভার গ্রহণের পরই পদক্ষেপ নেন দলকে সুসংগঠিত করার। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক জিয়া ক্ষমতা দখল করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা কর্মিদের উপর  দমন পীড়ন, জেল জুলুম, হত্যা করার পাশাপাশি দলকে ভেঙে খন্ড-বিখন্ড করেছিলো। 

স্বাধীনতাবিরোধি রাজাকারদের নিয়ে সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে পদদলিত করে পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশ পরিচালনা করে  বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিলো। একদিকে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের দুঃশাসন কাল, অন্যদিকে তার পৃষ্ঠপোষকতায় জাতির জনকের খুনিদের আস্ফালন, সব মিলিয়ে রাজনৈতিক পথ ছিল ভীষণ কন্টাকময়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে হত্যার হুমকীসহ জীবন নিয়ে সব শঙ্কাকে তুচ্ছ করে নিজ দেশে তিনি ফিরে আসেন। 

সেদিন ছিলো রবিবার, রাজধানী ঢাকা মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মিছিল। শুধু মিছিল আর মিছিল। বিকাল ৪ টায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। সেদিন শুধু ঢাকার তেঁজগাও বিমান বন্দর নয়, ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের মতই তার কন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে সমগ্র ঢাকা নগরী জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। প্রচ- ঝড়-বৃষ্টিও মিছিলের গতি রোধ করতে পারেনি। স্লোগানেও ভাটা পড়েনি। লাখো কণ্ঠের স্লোগান নগরীকে প্রকম্পিত করেছে। শহরাঞ্চল থেকে মানুষ ট্রাকগাড়ির শরণাপন্ন হয়ে ছুটে এসেছিলো বিমানবন্দরের রাস্তায়। পথের মোড়ে মোড়ে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আহাজারি, ‘কী দ্যাখতে আইল শেখের মাইয়া, মা নাই, বাপ নাই, ভাইও নাই। আহারে, ক্যামুনে জানি জাগব ওর পরানে।’ কেঁদেছেন অনেকেই। অনেকের চোখে আগুনের হলকা, কণ্ঠে স্লোগানের মর্মবিদারি ভাষা। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আর প্রচ- ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ মানুষের মিছিলে ঢাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। 

বিমানবন্দর থেকে একটি ট্রাকে করে জাতীয় নেতৃবৃন্দক সাথে নিয়ে জনস্রোতের ঢেউ পেড়িয়ে তিনি মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ের জনসমুদ্রের মঞ্চে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদলেন, সেই সাথে জনসমুদ্র হু হু করে কেঁদে উঠলো ঠিক যেনো বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলরাশি সৈকতে মাথা ঠুকে আছড়ে পড়ছে।

কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগর পরিণত হয় জনমানুষের অরন্যে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখতে সেদিন বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের গন্তব্য ছিল ঢাকা। স্বাধীনতার অমর স্লোগান, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, পিতৃ হত্যার বদলা নেব। শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’।

সেদিন জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা দীপ্ত কন্ঠে বললেন- বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি, আমি আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেলসহ সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।

পঁচাত্তরের পনের আগস্ট ভাগ্য গুনে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনাকে সব সময় ধাওয়া করে গেছে কোনো না কোনো বুলেট বোমা। কমপক্ষে ২০ বার তাঁকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বাঁচলেও স্বৈরাচারী শাসকদের জেল-জুলুম-অত্যাচারের হাত থেকে তিনি রক্ষা পাননি। কিন্তু ভরসার জায়গা ছিল দেশের মানুষ ও তাদের অফুরন্ত ভালোবাসা এবং আল্লাহ পাকের অশেষ রহমত। মানুষের ভালোবাসাকে সম্মান করেই পনের আগস্ট এর বিয়োগান্তক বেদনাকে বুকে ধারণ করে শোককে শক্তিতে পরিণত করে বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন লড়াই-সংগ্রাম করে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। 

শত বাধা-বিপত্তি এবং হত্যার হুমকিসহ নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা ভাত-ভোট এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ অর্জন করেছে গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতা। বারংবার হামলার পরেও অবিচল দাঁড়িয়ে থেকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আজ বিশ্বের বুকে পরম গৌরবের গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন। 

গণমানুষের জীবনঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য সাধারণের যাপিত জীবনের সমস্যা ও সংকট তিনি সমানুভূতিতে অনুভব করেন। চতুর্থবারের মত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি শপথ গ্রহণ করেন ৭ জানুয়ারি, ২০১৯। তাঁর রাজনৈতিক সত্ত্বাটিও অসাধারণ। তিনি নেতাকর্মীদের পাশে থেকেছেন সর্বাবস্থায়, সর্বাত্মক। রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করেছেন সকল সংকট ও আঘাতের। কখনো ষড়যন্ত্র বা অপকৌশল আশ্রয়ী হননি।

দলীয় প্রধান হিসাবে এই দীর্ঘ সময় চলার পথে অনেক চড়াই-উৎরাই, ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে আজকের এই অবস্থানে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর সফল নেতৃত্বের কারণেই আওয়ামী লীগ চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের এই শাসন আমলেই দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের নতুন মাত্রা সূচিত হয়েছে। তিনি দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন এবং সকল শ্রেণীপেশার মানুষের কল্যাণে যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছেন। দরিদ্র দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করেছেন । বাংলাদেশকে ‘রূপকল্প ২০৪১’ এর বাস্তবায়ণের মাধ্যমে একটি উন্নত, আধুনিক, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

কেবল রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই তিনি অনন্য নন, তাঁর রয়েছে অসাধারণ মানবিক গুণাবলি। তিনি বিশ্ব নেতা। প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধানের বাইরেও তিনি একজন আটপৌরে অভিভাবক। অবসরে বই পড়েন, লেখালেখি করেন। জাতির পিতার স্মৃতি রক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি নিসর্গপ্রেমী। ফুল, পাখি, প্রকৃতি ভালবাসেন। কৃষি খামার, বাগান করায় উৎসাহ দেন। নিজের হাতে রান্না করেন প্রধানমন্ত্রী হয়েও। তিনি পোশাক-পরিচ্ছদ-ব্যবহার্যে রুচিশীল, মার্জিত কিন্তু বিলাসী নন। দেশি শাড়ি পরিধান করেন। বিলাস-বাহুল্যবর্জিত সাধাসিধে জীবনযাত্রা এবং পোশাকে-আশাকে তাঁর অতুলনীয় বাঙালিয়ানা তাঁকে মাটির মানুষের, দুঃখী মানুষের প্রিয় নেতা হিসেবে অসামান্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসনে বসিয়েছে।

এস/ ওআ/