সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি

সিলেটে ক্রমশ প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের নদীগুলো এখন পানিতে টুইটম্বুর। সুরমা ও কুশিয়ারায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে। এ দুই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে এলাকা। পানিবন্দি রয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। এতে জেলার বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠছে। নগরীর বেশির ভাগ এলাকার বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়েছে পানি। চরম দুর্ভোগে রয়েছে বন্যাকবলিত মানুষেরা। বন্ধ হয়ে যেতে পারে যানবাহন চলাচল। বাড়িতে খাবার কিংবা বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, আগামী ২৩ মে পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হবে, যার কারণে সিলেটের বন্যা পরিস্থতি আরও খারাপের দিকে যাবে। পাশাপাশি ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, ঘরের মধ্যে প্রতিনিয়ত পানি ঢুকে পড়ায় ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে। জেলার ১৩টি উপজেলার মধ্যে সবকটিতেই বন্যার পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এর মধ্যে প্রথম দিকে যে ছয়টি উপজেলা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে, সেসব উপজেলায় কান্নার রোল পড়েছে। এসব এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছয় উপজেলার দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট।

সিলেট নগরীর বেশির ভাগ এলাকার বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যার পানির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলোও তলিয়ে গেছে। এসব উপজেলার সড়কে পানি ওঠায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে মাছের ঘের, নষ্ট হয়েছে সবজিখেত ও ফসলি জমি।

সিলেটে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারনে নগরীর ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমাসহ জেলার দুই নদীর চার পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্ট দিয়ে বিপৎসীমার ১২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীর পানি সিলেট সদর পয়েন্ট দিয়ে বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশিদ পয়েন্ট দিয়ে বিপৎসীমার ১৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জেলার জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলায় বন্যার ভয়াবহতা চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া সিলেট সদর উপজেলাসহ নগরীর বেশিরভাগ এলাকা-ই এখন পানির নিচে। বন্যাকবলিত এলাকায় রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, বাসাবাড়ি, দোকানপাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এমনিতেই জনসাধারণের দুর্ভোগের অন্ত নেই তার মধ্যে নতুন করে যোগ হয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট।

ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন থেকে বন্যাকবলিতদের জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব এলাকায় অতিসত্ত্বর ত্রাণসুবিধা পাঠানোর ব্যবস্থা ও অত্র এলাকাগুলোকে বন্যা দুর্গত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণার জন্য জোর দাবি জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

গোয়াইনঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ বলেন, গোয়াইন ও পিয়াইন নদীর পানি অনেক আগেই বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এ উপজেলার মানুষ বন্যার কারণে ঘর থেকে বের হতে পারছেন না আবার ঘরেও থাকতে পারছেন না। এই উপজেলাকে অনতিবিলম্বে বন্যা দুর্গত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ চৌধুরী বলেন, এই মুহূর্তে প্রকৃতি খুবই বিরূপ আচরণ করছে। একদিকে অবিরাম বর্ষণ আর আরেকদিকে পাহাড়ি ঢল, এই দুইয়ে মিলে সিলেট অঞ্চলকে বিস্বাদে পরিণত করে দিয়েছে। সহসাই এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বলেও জানান তিনি।

সিলেট জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ বলেন, সিলেটের নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। গত দুদিন আগে থেকেই সবগুলো নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। বিভিন্ন জায়গায় নদ-নদীর পানি পাড় উপচে শহর-গ্রামকে প্লাবিত করে দিয়েছে।

পানির নিচে সাবস্টেশন, বিদ্যুৎহীন কয়েক লক্ষ মানুষ

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বরইকান্দি সাবস্টেশনে পানি উঠে যাওয়ায় এখান থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্দ রয়েছে। ফলে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে নগরীর ৪৫ হাজার পরিবার। বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সিলেটের বিদ্যুৎব্যবস্থা। এরইমধ্যে জেলার কয়েক লাখ মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছেন।

জানা যায়, মঙ্গলবার দুপুর থেকে বন্যার কারনে শুধুমাত্র সিলেট নগরীর ৪৫ হাজার পরিবারের কয়েক লক্ষ মানুষ বিদ্যুৎহীন হয়ে ভুতুড়ে অবস্থায় রয়েছেন। পানিতে ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎ না থাকায় পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বরইকান্দি সাবস্টেশন ও শাহজালাল উপশহরে একটি ফিডার পানির নিচে চলে যাওয়ায় এগুলো বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে বরইকান্দি সাবস্টেশনের অধীনে ৪০ হাজার গ্রাহক ও শাহজালাল উপশহরের একটি ফিডারের অধীনে ৫ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎহীন রয়েছেন।

বরইকান্দি সাবস্টেশনে মেশিন রক্ষায় পাম্প দিয়ে পানি দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন এই মেশিনটাই রক্ষা করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী জানান, বাড়িঘরে পানি ওঠায় কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, কোম্পানিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, সদর ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বেশিরভাগ এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। কিছু জায়গায় সাবস্টেশনের যন্ত্রপাতি পানিতে তলিয়ে গেছে। আবার অনেক জায়গার বাসাবাড়ির মিটার পর্যন্ত ডুবে গেছে। এ কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে। পানি না কমলে এটি স্বাভাবিক হবে না।

নগরের দক্ষিণ সুরমার উপজেলার তেললী গ্রামের বাসিন্দা শাহিন বলেন, ঘরে পানিতে আটকে আছি। তার ওপর বিদ্যুৎ নেই। মোবাইল ফোনও চার্জ দিতে পারছি না। ফলে জরুরি প্রয়োজনে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।

বিদ্যুৎহীন এলাকায় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবাও ব্যাহত হয়েছে। সবমিলিয়ে বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।

নিয়ামতপুর এলাকার বাসিন্দা ও পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. রকিবুল হাসান জুয়েল বলেন, দুদিন ধরে বাসায় বিদ্যুৎ নেই। এ অবস্থায় বিশুদ্ধ পানি সংকট দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কও চলে গেছে। পুরো এলাকার বাসিন্দারা খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছেন। বোতলজাত পানির মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানির সংকট কাটলেও বিদ্যুৎ না থাকায় লোকজন মোবাইলে চার্জ দিতে পারছেন না।

সিলেট নগরের মখন দোকান এলাকার বাসিন্দা মুজিবুর রহমান বলেন, তিনদিন ধরে ঘরে পানি। পানির কারণে ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। খাবারের কোনো সংকট না থাকলেও সবচেয়ে সমস্যা হচ্ছে বাথরুম ব্যবহারে। বিশেষত নারী ও শিশুরা বেশি সমস্যায় পড়েছেন।

বন্ধ ৭ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

মহামারি করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর চলমান বন্যার কারনে আবারো বন্দ হয়ে পড়েছে সিলেট জেলার ৭ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে করে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। বন্যার কারনে জেলার অন্তত সাড়ে ৫০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া ২০০-এর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র। ফলে জেলার অন্তত সাড়ে ৭০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

গত ১০ মে থেকে সিলেটে ভারী বর্ষণ শুরু হয়, যা এখনও চলমান। একই সঙ্গে উজান থেকে নামছে ঢল। এতে গত ১১ মে থেকেই সিলেটের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যেতে শুরু করে। আর গত সোমবার থেকে পানিতে তলিয়ে যেতে শুরু করে সিলেট নগর। এখন বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

জেলার শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া পানি নামার সময় আরও দু-একটি উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একই দশা হতে পারে।

সিলেট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ১ হাজার ৪৭৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে বুধবার দুপুর পর্যন্ত ৪০০টি পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ফলে এসব বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, জক