সুবর্ণজয়ন্তী, পঞ্চাশ বছর এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


সুবর্ণজয়ন্তী, পঞ্চাশ বছর এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র

অভিজিৎ বড়ুয়া অভি: এখন চলছে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী । এই পঞ্চাশ বছর বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের রাজনীতি হয়েছে অনেক। জন্মলগ্ন থেকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র স্বাধীন হয়ছিলো। এশিয়ার এই অঞ্চলের দেশগুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র শুরু ভারতবর্ষ বিভক্তের মধ্য দিয়ে। মুসলমান আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ করে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন হয়। মুসলমান আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করার দায়িত্ব পালন করেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। সে সময় পাকিস্তানের পক্ষে গণভোটে জয়ী হতে মুসলীম লীগের ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালায়। জনগণকে পাকিস্তানের পক্ষে ভোটদিতে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল মুসলীম লীগ। পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেয়া ফরজ ঘোষণা করে ফতোয়াও জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, গণভোটের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান পাঁচশো কর্মী নিয়ে কলকাতা থেকে সিলেট এসেছিলেন। শেখ মুজিব লিখেছেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুরোধে হিন্দু রায়বাহাদুর আরপি সাহা একাধিক লঞ্চ সিলেটে পাঠিয়েছিলেন মুসলীম লীগের পক্ষে। পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন হওয়ার পর থেকে শুরু হয় এই অঞ্চলের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। একপক্ষ পাকিস্তানের, অন্য পক্ষ ভারতের পক্ষে। ভারত বিরোধী আমেরিকা জোট এই অঞ্চলের ভারতের আশেপাশের রাষ্ট্রগুলোতে প্রভাব বৃদ্ধি করতে থাকে। ভারতের একদিকে শত্রু চীন অন্যদিকে আমেরিকা সমর্থিত পাকিস্তান। আর অন্যদিকে ভারতের সাথে রাশিয়ার সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। এর পেক্ষাপটে বর্তমান বাংলাদেশ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। কারণ বাংলাদেশের একদিকে বঙ্গোপসাগর অন্য দিকে ভারতের সাথে বিশাল সীমান্ত এলাকা । এই রাজনৈতিক পেক্ষাপটে বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক নেত্রীত্বেরও ভারত বিরোধি ভূমিকা ছিলো। যার প্রমাণ, “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস বা ১৯৪৬-এর কলকাতা হত্যাকাণ্ড (এটি কলকাতা দাঙ্গা এবং গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস নামেও পরিচিত) ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের রাজধানী কলকাতায় সংঘটিত একটি ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নরহত্যার ঘটনা। আমেরিকা সমর্থিত জোটের প্রয়োজন ছিলো আজ্ঞাবহ ভারতবিরোধী পাকিস্তান সরকার ও রাজনৈতিক নেত্রীত্ব, যারা আমেরিকা জোটের ভারতবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে। ১৯৬২ সালে চীন ভারত আক্রমণ করে। রাশিয়ায় ১৯৬৪ সালে ক্রুশ্চেভকে সড়িয়ে দিলে ভারত চিন্তায় পড়ে যায় রাশিয়ানরা ভারতের প্রতি তাদের নীতি পরিবর্তন করবে কিনা সে বিষয়ে। ইন্দিরা গান্ধী তার My Truth গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “১৯৬৬ সালের অক্টোবরে দিল্লীতে আমরা ত্রিপক্ষীয় জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করি। আমি মিশর ও যুগোশ্লাভিয়ার সাথে গভীর যোগাযোগ পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করি। প্রেসিডেন্ট টিটো ও প্রেসিডেন্ট নাসেরের সাথে মিলে আমরা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক উত্তর ভিয়েতনামে বোমাবর্ষণ বন্ধ করার জন্য নিঃশর্ত আহ্বান জানাই। বোমাবর্ষণের ব্যাপারে এবারও আমার পূর্ববর্তি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ইন্দো-মার্কিন সম্পর্কে উত্তেজনার সৃষ্টি করে।”

 ১৯৭০-৭১ সালে এই অঞ্চলের রাজনীতির সমীকরণের পরিবর্তন আসে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে সূচনা হয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। সেই সময় শ্রদ্ধেয় ইন্দিরা গান্ধীকে আমরা দেখি সরাসরি আমেরিকা জোটের বিরোধিতা করে বাংলাদেশকে সর্মথন ও সহযোগীতা করতে। শুরু হয় আমেরিকা বিরোধি জোটের বাংলাদেশ, ভারত, রাশিয়া ও অন্যান্য রাষ্ট্রের। একই সময়ে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বিশসালা শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগীতার চুক্তি স্বাক্ষর করে।

এরপর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সকলকে হত্যা ও ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেস সরকারের পতন এবং আমেরিকা বিরোধি জোটের, শক্তি আবার বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আমেরিকা বিরোধী, চীন বিরোধী এবং ভারতের পক্ষের শক্তির উত্থান জোটের পতন সূচিত হয়। পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আমেরিকা জোটের সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আরোহণ করে। সে ধারবাহিকতায় ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক পট পরির্বতনের পরে ধর্মান্ধ গোষ্ঠি, সরকার গঠন করে। ভারত আমেরিকার সম্পর্ক উন্নয়ন হয়। নতুন মেরুকরণ চীন ঠেকাও। ভারতের সাথে আমেরিকা জোটের সুসম্পর্ক শুরুর পরপর পাকিস্তান আর বাংলাদেশের ভারত বিরোধী সরকারের প্রয়োজনীতা আমেরিকা জোটের কাছে কমে আসে। পূর্বের ভারতবিরোধী রাজনৈতিক সরকারের পরিবর্তে ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারের প্রয়োজনীয়তা আমেরিকা জোটের কাছে প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বর্তমান সরকার ছিলো উপযুক্ত পছন্দ। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশের সাথে চীনের ও রাশিয়ার সম্পর্ক দৃঢ় হতে থাকে। যা ভারত ও আমেরিকার কাছে চিন্তার বিষয় হয়ে উঠে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধেয় শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপরিবারে খুনীদের আশ্রয়, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে না দেয়ার নীতি বর্তমান সরকার খুব একটা ভালভাবে গ্রহণ করে নি। এরসাথে অধ্যাপক ডঃ ইউনুসের বিষয়ে আমেরিকার তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন পক্ষপাত এবং বিশ্ব ব্যাংকের পদ্মা সেতু বিষয়ের মতন বিভিন্ন বিষয়ের ফলে আমেরিকা ও বর্তমান সরকারের সম্পর্কে শৈথিল্য পরিলক্ষিত হতে থাকে। আর এর বিপরীতে চীন রাশিয়া জোটের সাথে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের সুসম্পর্ক এগিয়ে যেতে থাকে। ভারত সরকারের বিভিন্ন বিষয়, তিস্তা নদী, প্রতিশ্রুতি দিয়েও উন্নয়ন প্রকল্পে অংশগ্রহণ ও অর্থায়ন না করা ও ভারতের বিভিন্ন কোম্পানীর ভূমিকা, মায়ানমার বিষয়ে ভারতের ভূমিকার ফলে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার, ভারত সরকারের উপর বিরক্ত হতে শুরু করে।  এই সব আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণের পরিণাম, ২০২১ সালে আমেরিকা সরকারের, বাংলাদেশের গর্বিত বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানের উপর নিষেধাজ্ঞা, সম্প্রতি আয়োজিত গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানো। পাশাপাশি এবার মানবাধিকার দিবসে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানের সময় টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের মারা যাওয়ার ঘটনায় র‌্যাবকে দায়ী করে বাহিনীর সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া। যা এই সরকারকে সতর্কীকরণ হিসাবে গন্য।  

এইসব পেক্ষাপটে আশংখা সৃষ্টি হয়। উদাহরণ স্বরূপ ইরানের বিষয় যদি আমরা দেখি, ১৯৪১-৫৩ সাল পর্যন্ত ইরানে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে যে সোনালী অধ্যায় শুরু হয়েছিলো ব্রিটেনের হস্তক্ষেপের কারণে ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ফলে ১৯৫৩ সালে তার অবসান ঘটে ও ধস নামে। তাছাড়া সমসাময়িক সময়ে জন এফ কেনেডি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধগুলো নতুনভাবে পরিচালনা করার নীতি গ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি পিস কর্পস নামে সেনাদল গঠন করে সদস্যদেরকে বিশ্বের সকল দেশে পাঠিয়ে দেন, কারণ স্নায়ুযুদ্ধের বিষয়গুলো ঢেলে সাজানোই ছিলো তার বিশ্ব রাজনীতি। এরপর আমেরিকা বিরোধী ইরান সরকারের বিরুদ্ধে অবরোধের নামে অর্থনীতি ধ্বংসের নীতি এখনো চলমান।

এই বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাস হতে আশঙ্কা জাগে যে, দীর্ঘদিন বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের শাসন চলছে, উন্নয়ন বান্ধব রাজনৈতিক নেত্রীত্বের সরকার ক্ষমতায় থাকার ফলে এবং বাংলাদেশের প্রভূত অথনৈতিক উন্নয়নের পেক্ষাপটে, আঞ্চলিক চীন, পাকিস্তান, শ্রীলংকার সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টির কারণে বর্তমান সরকারকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উৎখাতের তৎপরতা শুরু হবে। মানবাধিকার যারা সর্বদায় অবমাননা করে সেই আমেরিকা আজ মানবাধিকার রক্ষার নামে বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন বিধিনিষেধ দেয়া শুরু করেছে। এটি আর কিছু নয় এই সরকারকে আজ্ঞাবহ, নতজানু করার চেষ্টা।

সুতরাং বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাস আর আমেরিকার জোটের অতিত কর্মকাণ্ডকে স্মরণে রেখে আমাদের সর্তক হতে হবে। বাংলাদেশে যদি কোন অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটে তাহলে তা হবে ভয়াবহ। নারী স্বাধীনতা, গনতান্ত্রিক চর্চা, সাহিত্য চর্চা ব্যাহত হতে পারে। আমেরিকার বিরোধিতা করার রাষ্ট্রগুলোর পরিণতি কারো ভাল নয়। তাদের হয় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে, নয়তো অর্থনৈতিক অবরোধে পড়তে হয়েছে। তাই আমাদের নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু সে সুযোগে বিশ্ব রাজনীতির কুটকৌশলের কারণে কোন রাজনৈতিক দূর্বিত্তায়নকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আনা হবে বিপদজনক। রাজনৈতিক দূর্বিত্তায়নের ফলে ১৯৭১ সালের পরবর্তী  জাতির পিতার স্বপরিবারে হত্যা, অগণতান্ত্রিক অপ শক্তির উত্থান, সাড়া দেশে বোমা হামলা, জঙ্গি তৎপরতার উত্থান, বাংলাভাই-জনযুদ্ধ-বিপ্লবি কমিউনিষ্ট পার্টি-সর্বহারার উত্থান, রগকাটা, ব্রাশফায়ারে হত্যা, গ্রেনেট হামলা, লুটপাটের মহাউৎসবের অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। যদি আফগানিস্তানের মতন রাজনৈতিক দূর্বিত্তায়ন বিশ্ব রাজনৈতিক খেলার অংশ হিসাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে, তাহলে শুরু হবে ভয়াবহ অন্ধকার যুগের।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার বর্তমান বক্তব্য, “আমেরিকা গণতন্ত্রের জন্য কথা বলে আর খুনিদেরকে আশ্রয় দেয়, প্রশ্রয় দেয়। কেন আমি জানি না। তারা নাকি বিশ্বের সব থেকে গণতান্ত্রিক দেশ! … আমেরিকার মতো জায়গা, যারা সব সময় ন্যায়বিচারের কথা বলে, গণতন্ত্রের কথা বলে, ভোটাধিকারের কথা বলে, তারা মানবাধিকারের কথা বলে, কিন্তু আমাদের যে মানবধিকার লঙ্ঘন হয়েছিল, আমরা যে ন্যায় বিচার পাইনি.. তারপর যখন এই বিচার হল, সেই খুনিদের আশ্রয় দিয়ে বসে আছে। নূরকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে কানাডা, আর খুনি রাশেদ এখনও আমেরিকায়। তাদের কাছ থেকে আমাদের আইনের শাসনের সবকও শুনতে হয়, গণতন্ত্রের কথাও শুনতে হয়, ন্যায়বিচারের কথাও শুনতে হয়, সেটিই আমার কাছে অবাক লাগে।” যাতে বা উনার বক্তব্যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের দীর্ঘশ্বাস যেন প্রতিধ্বনিত হয়।

এসএ/