আস্থাশীল, টেকসই পুঁজিবাজার গড়তে চাই: সায়েম সোবহান আনভীর
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৫:৫১ পূর্বাহ্ন, ১লা ডিসেম্বর ২০২২
রূপকথা নয়, রূপান্তরের বাংলাদেশ। ক্ষুধা, দারিদ্র্যের বৃত্ত ভেঙে, সব আশঙ্কা পেছনে ফেলে বর্তমান বাংলাদেশ অপরাজেয়-অপ্রতিরোধ্য এক নতুন বাংলাদেশ। শ্যামল-সুন্দর নদীতীরের কোটি মানুষের অদম্য শক্তির উন্মাদনাই স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে রূপান্তরের বাংলাদেশের নতুন পরিচয়। অর্থনীতি, উদ্যোগ, শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যে প্রশ্নাতীত সাফল্যের হাত ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অপূর্ব মেলবন্ধন এখন বাংলাদেশ।
তবে মহামারি করোনাভাইরাসের আঘাত শেষ না হতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির থাবা পুরো বিশ্বের অর্থনীতিকে টালমাটাল করে দিয়েছে। এর উত্তাপ লেগেছে বাংলাদেশেও। এরই মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ঝড়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট অর্থনীতিকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে সর্বস্তরের মানুষের জীবনযাপনে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ এখন চরম ভোগান্তিতে রয়েছে। তাদের আয় নেই, অথচ খরচ বেড়েছে।
মূল্যস্ফীতি আর বাড়তি খরচের এই ক্রান্তিকালে সাধারণ মানুষ ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ আয়ের কেন্দ্র হতে পারত পুঁজিবাজার। একটি পরিণত, আধুনিক ও স্থিতিশীল পুঁজিবাজার থাকলে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও একে মোকাবেলার শক্তি পেত মানুষ। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেটি করা সম্ভব হয়নি।
তবে এখনো সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। আমাদের সামনে সুযোগ এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সমৃদ্ধ-স্বনির্ভর সোনার বাংলা গড়তে হলে আর্থিক খাতের অন্যতম অংশ পুঁজিবাজারকে আমূল বদলে দিতে হবে। এ অবস্থায় ত্রাতা হয়ে এগিয়ে আসতে চাই আমরা। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে বসুন্ধরা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এবিজি লিমিটেড চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার বা কৌশলগত বিনিয়োগকারী হওয়ার আগ্রহ দেখায়। আনন্দের বিষয় হলো, আমরা সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছি। এখন আমাদের লক্ষ্য থাকবে, কিভাবে এই পুঁজিবাজারকে সর্বসাধারণের জন্য সমান সহায়ক আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়।
দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপ শুধু ব্যবসা নয়, মানুষের ভালো-মন্দ বিবেচনায় রাখে। আমাদের স্লোগানই হলো ‘দেশ ও মানুষের কল্যাণে’। আমার বড় ভাই বসুন্ধরা গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান সাদাত সোবহান তানভীর এই স্লোগানটি ঠিক করে দিয়েছিলেন।
সেই থেকে আমরা সবাই এই বাক্যটিকে ব্রত হিসেবে নিয়েছি। আমাদের একটি বড় লক্ষ্য হলো, দেশের মানুষের কল্যাণ সাধন করা। নানাভাবে আমরা তা করে যাচ্ছি। তবে আর্থিক খাত তথা পুঁজিবাজারের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে কিছু কাজ করার সুযোগ পেয়ে ভালো লাগছে। আশা করি, এখানেও আমরা লক্ষ্য পূরণে সমর্থ হব।
এরই মধ্যে আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। সিএসইকে প্রযুক্তিবান্ধব করে তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগানো হচ্ছে। বিশেষ করে আধুনিক কারিগরি ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে উন্নত ও প্রযুক্তিবান্ধব করে পুঁজিবাজারকে দেশের প্রত্যেকটি মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দেওয়া আমাদের অন্যতম লক্ষ্য, যাতে করে মানুষ তাদের সঞ্চিত ৫-১০ হাজার টাকাও দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করতে পারে। এখান থেকে মুনাফা করতে পারে। কোনো ব্যাংকেও যেন অলস টাকা পড়ে না থাকে। অলস টাকা অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক বিষয় নয়।
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের মানুষ ব্যাংক-বীমার পাশাপাশি পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করে, যা তাদের আয়ের ভিন্ন একটি উৎসও বটে। এই আয় থেকে বছর শেষে বা হলিডেতে ঘুরতে বাড়তি টাকা ব্যয় করতে পারে তারা। কিন্তু আমাদের পুঁজিবাজারে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের বড় দুটি ধসের ঘটনা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে। মানুষ চরমভাবে ঘাবড়ে গেছে। এমনকি পুঁজিবাজারের নাম শুনলেই অনেকের মনে নেতিবাচক প্রশ্নের উদয় হয়। বেশির ভাগ মানুষই এখন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আস্থা পায় না। এমনকি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আমাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে ভয় পায়। মূলত পর্যাপ্ত তথ্যের ঘাটতি, দুষ্টচক্রের কারসাজির ভীতি ও অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ায় এমনটি হচ্ছে।
দুটি ঘটনা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কগ্রস্ত করলেও তাদের আস্থা ফেরানোর খুব কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। আমরা সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা করে, সহজ পদ্ধতিতে মানুষের মনে হারানো ভরসার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে চাই। তারা যেন আবারও পুঁজিবাজারকে বিশ্বাস করে, বিনিয়োগ করে। এটি যেন তাদের কায়ক্লেশের সংসারজীবনে নিয়ামকের ভূমিকা রাখে। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার বা কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে এবিজি লিমিটেড সবার আগে তথ্যের সহজ প্রাপ্তি নিশ্চিতে কাজ করবে। পাশাপাশি সিএসইর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পুঁজিবাজারের নিয়মিত লেনদেনে নজরদারির ব্যবস্থা করবে। যেন কেউ কৌশলে বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নিতে না পারে। এ জন্য অবশ্যই পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সহযোগিতা প্রয়োজন হবে।
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে (এনএসই) দৈনিক গড়ে ২২ হাজার ৭২৪ কোটি রুপি লেনদেন হয়। অথচ বাংলাদেশের দুটি স্টক এক্সচেঞ্জে দৈনিক গড় লেনদেন হাজার কোটিরও নিচে। এখন অনেকেই বলবেন, তাদের জনসংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটি, ওদের অর্থনীতির পরিধি বড়, ওদের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানির সংখ্যা বেশি। কিন্তু আমাদের জনসংখ্যাও তো সাড়ে ১৬ কোটি ছাড়িয়ে। আমরা তো বিনিয়োগের জনসংখ্যার আনুপাতিক হারের দিক থেকেও পিছিয়ে আছি! তাহলে আমাদের লেনদেন কেন তাদের সাত ভাগের এক ভাগ হবে না? আমাদের পুঁজিবাজারে কেন বড় মূলধনী কম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হবে না? আমাদের পুঁজিবাজারে কেন বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে না? কেন আস্থা ফেরানো যাবে না? আমি মনে করি এটা সম্ভব।
এনএসই নিয়ে একটি তথ্য জানাই, ২০২১ সালে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যেও বিশ্বের বৃহত্তম ‘ডেরিভেটিভ এক্সচেঞ্জ’ হয়েছিল ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (এনএসই)। আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিউচারস ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (এফআইএ) পরিচালিত পরিসংখ্যানে ওই তথ্য উঠে এসেছিল। পাশাপাশি ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব এক্সচেঞ্জেসের পরিসংখ্যানেও ট্রেডের সংখ্যার ভিত্তিতে নগদ ইকুইটিতে এনএসই বিশ্বের চতুর্থ স্থানে রয়েছে। আমরা আছি তালিকার একেবারে শেষের দিকে।
আরএক্স/