বেইজিংয়ে শির সঙ্গে যে কথা হলো পুতিনের


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


বেইজিংয়ে শির সঙ্গে যে কথা হলো পুতিনের

চীনের সঙ্গে নিজেদের সুগভীর সম্পর্কের প্রসঙ্গ তুলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, আমাদের সম্পর্কটা আদি ও অকৃত্রিম।  বেইজিংয়ে অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধন সামনে রেখে শুক্রবার চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। খবর এনডিটিভির।

পশ্চিমাদের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে দুই নেতা মিলিত হন। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আরও মজবুত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন দুই নেতা। তাদের মধ্যে নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতিসহ পারস্পরিক ও আঞ্চলিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে কথা হয়েছে।

পুতিন বলেন, আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা মর্যাদার। একেবারেই প্রাকৃতিক।

রুশ প্রেসিডেন্টের এ সফরে দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা ইস্যুসহ অন্যান্য বিষয়ে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে।
  
চীনের প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে ভ্লাদিমির পুতিন বেইজিং সফরে গেছেন। পশ্চিমাদের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যে এ দুই জুটি আরও কাছাকাছি আসছেন। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে শি জিনপিং চীন ছেড়ে কোনো দেশে সফরে যাননি। দেশটি ২০২০ সালের শুরুতে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে লড়াই করে। সেই সময় চীনের উহান শহর লকডাউনে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। উহানেই প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়।

বেইজিংয়ে আজ শীতকালীন অলিম্পিক শুরু হচ্ছে। এ আয়োজন উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে শি জিনপিং এখন ২০টির বেশি দেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি আশা করছেন, এ প্রতিযোগিতার আয়োজনের মাধ্যমে তিনি বৈশ্বিক রাজনীতিতে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে সক্ষম হবেন। 

ইউক্রেন নিয়ে আমেরিকার সাথে বিপজ্জনক রেষারেষির মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চীনের রাজধানী বেইজিং গেছেন। ইউক্রেন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পুতিনের এই চীন সফর বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে। অলিম্পিকসের উদ্বোধনের চেয়ে এই দুই নেতার মধ্যে কথাবার্তায়  বিশ্বের বেশি নজর আছে।   

নিষেধাজ্ঞায় ভরসা কেন চীন?
২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রাইমিয়া নিয়ে নেওয়ার পর আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলো যখন রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখনও প্রেসিডেন্ট পুতিন চীনের দিকে তাকিয়েছিলেন এবং সাড়া পেয়েছিলেন।

আমেরিকার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বেইজিং শুধু তেল এবং গ্যাস কেনা নিয়েই মস্কোর সাথে চারশো' বিলিয়ন ডলারের (৪০,০০০ কোটি ডলার) চুক্তি সই করে, যা সেই সময়ে রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ভরাডুবি থেকে থেকে বাঁচিয়েছিল।

অবশ্য অনেক পর্যবেক্ষক বলেন, রাশিয়ার ক্রাইমিয়া দখল নিয়ে চীন অস্বস্তিতে পড়লেও সস্তায় এবং সহজ শর্তে রাশিয়ার জ্বালানি সম্পদ কেনার সুযোগ তারা তখন হাতছাড়া করেনি। কিন্তু সম্ভাব্য আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার মুখে আবারও পুতিনকে সেই ভরসা কি দেবেন শি জিনপিং?

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট (আইপিআরআই)-এর ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক ক্রিস মিলার মনে করেন যে চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে 'অবিচল ভূ-রাজনৈতিক মৈত্রী এবং ঐক্যের' একটি বার্তা বেইজিংয়ের বৈঠক থেকে দেওয়া হবে।

আইপিআরআই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে তিনি লিখেছেন, প্রধানত আমেরিকার ইস্যুতে ২০১৪ সালের পর গত আট বছরে চীন এবং রাশিয়া দিন দিন আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে।

অভিন্ন শত্রু আমেরিকা
"স্ট্যালিন এবং মাও জে দং-এর পর দুই দেশের মধ্যে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কখনই হয়নি, এবং এর পেছনে কাজ করেছে আমেরিকার সাথে দুই দেশের রেষারেষি। দুই দেশই দেখেছে তাদের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা নীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ একটি দেশ, তাদের প্রধান সমস্যার কেন্দ্র অভিন্ন - আমেরিকা," বলছেন তিনি।

এই অভিন্ন শত্রুকে মোকাবেলার কৌশল হিসাবে ঐক্যের তাড়না থেকে ব্যবসা-অর্থনীতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক গত বছরগুলোতে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। চীন এখন রাশিয়ার তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান ক্রেতা, আধুনিক অস্ত্রের বড় ক্রেতা। রাশিয়ার রপ্তানি আয়ের ২৫ শতাংশ আসে চীন থেকে।

গত বছর দুই দেশের মধ্যে ব্যবসার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৫ সালে ছিল ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সাল থেকে পাইপলাইন দিয়ে চীনে রাশিয়ার গ্যাস যাচ্ছে। দ্বিতীয় আরেকটি পাইপলাইন বসানোর চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

পুতিন-শি ঘনিষ্ঠতা
রাশিয়া আর চীনের নেতারা তাদের সম্পর্ক নিয়ে তাদের আবেগ প্রকাশে কোনও দ্বিধা করেন না। চীনের সবচেয়ে প্রভাবশালী কূটনীতিক ইয়াং জিয়েচি সম্প্রতি রুশ-চীন সম্পর্ককে "ইতিহাসের সর্বোত্তম" বলে বর্ণনা করেছেন। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাবরভ এই সম্পর্ককে "২১ শতকের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার একটি মডেল" বলে মন্তব্য করেছেন।

শি জিন পিং রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে তার 'সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু' সম্বোধন করেন। পুতিনও চীনের প্রেসিডেন্টের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তার মতে, চীনা নেতা একজন 'অত্যন্ত মেধাবী' বিশ্বনেতা।

দুই প্রেসিডেন্ট নিয়মিত নিজেদের মধ্যে কথা বলেন। ২০১৩ সাল থেকে তারা দুজন কখনও মুখোমুখি আবার কখনও ভিডিও কনফারেন্সে ৩৭ বার কথা বলেছেন। বেইজিংয়ে শুক্রবারের বৈঠকটি হবে তাদের মধ্যে ৩৮তম।

চীনের নিজের স্বার্থ
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, শুধু সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বা রাশিয়ার চাওয়া নয়, ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিনের পক্ষ নিয়ে আমেরিকাকে কোণঠাসা করার পেছনে চীনের নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ক্রিস মিলার বলেন, ইউক্রেন নিয়ে আমেরিকার আপোষহীন অবস্থান দেখে চীন তাইওয়ান নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে।

"ইউক্রেন নিয়ে আমেরিকা যে কট্টর অবস্থান নিয়েছে, সেটাকে বেইজিং একটি বার্তা হিসাবে দেখছে। চীন মনে করছে তাইওয়ান বা দক্ষিণ চীন সাগরের ইস্যুতেও যে তারা এমন কঠোর অবস্থান নেবে, সেই ইঙ্গিত আমেরিকা দিচ্ছে," বলছেন মিলার।

সুতরাং আমেরিকা ইউক্রেন নিয়ে রেষারেষিতে সফল হোক চীন তা চায় না।

ফলে, মিলার মনে করেন, ইউক্রেনের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকলেও বা সেদেশে রুশ সামরিক অভিযানে অস্বস্তি বোধ করলেও, কোনও যুদ্ধ বাধলে চুপ করে থাকা চীনের জন্য এ দফায় শক্ত হবে।

তবে এই সংকট নিয়ে চীনা নেতারা যেসব কথা বলছেন বা চীনা সরকারি মিডিয়াতে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তাতে আক্রমণ করা হচ্ছে শুধু আমেরিকাকে। ইউক্রেনের কথা তারা বলছেন না।

চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং ই গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে টেলিফোন করে বলেছেন যে পূর্ব ইউরোপে নেটোর সম্প্রসারণ নিয়ে রাশিয়ার উদ্বেগ যথার্থ এবং তাকে বিবেচনা করতে হবে।

খুব শক্ত কথা এখনও চীন বলেনি, তবে গবেষণা সংস্থা কার্নেগির মস্কো সেন্টারের গবেষক আলেকজান্ডার গাবুয়েভকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ইউক্রেন নিয়ে সৃষ্ট টানাপোড়েনে চীনের গভীর স্বার্থ জড়িয়ে আছে, এবং চীন সময় ও সুযোগমত তৎপর হবে।

গাবুয়েভের মতে, দুই দিক থেকে চীনের স্বার্থ জড়িয়ে।

"প্রথমত, ইউরোপে কোন বড় সংকট তৈরি হলে আমেরিকা সেখানে এতটাই জড়িয়ে পড়বে যে চীনকে কোণঠাসা করার দিকে নজর রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আর দ্বিতীয় লাভটি হচ্ছে, রাশিয়া চীনের আরও কাছাকাছি চলে আসতে বাধ্য হবে এবং চীনের শর্ত মেনেই তাদের আসতে হবে।"

তবে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন বিশ্ব ব্যবস্থায় আমেরিকান প্রাধান্যকে চ্যালেঞ