ঐতিহ্যের স্মারক বহন করছে ‘বিক্রমপুর জাদুঘর’
উপজেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০২:৫১ পূর্বাহ্ন, ৩১শে জানুয়ারী ২০২৩
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার আড়িয়াল বিল। আর এই বিলের ধারেই রাঢ়িখালের বালাশুর গ্রামে গড়ে তুলেছিলেন যদুনাথ রায় বাহাদুর তার বিলাশবহুল জমিদার বাড়ি। মনোমুগ্ধকর পুরোনো বাড়িটিতে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে একই রকম দেখতে কারুকাজ সজ্জ্বিত মুখোমুখি দুটি জরাজীর্ণ প্রাসাদ।
দেখা যাবে কাচারী ঘর, দূর্গা মন্দির, লক্ষীমন্দির ও নানা প্রজাতির দূর্লভ সব ফুল ও ফলজ গাছ গাছালি। এক সময় বাড়িটিতে পূর্ণিমা তিথীতে খুব ঘটা করে পালন হতো রাশ উৎসব। বাড়িটির চারপাশ এক সময় রাতের আধাঁরে আলোয় জলমল করত। প্রথা বিরোধী লেখক ভাষা বিজ্ঞানী ড. হুমায়ূন আজাদ তার লেখা এক প্রবন্ধে বাড়িটিকে প্যারিস শহরের সাথে তুলনা করে লিখেছেন বিলের ধারে প্যারিস শহর। সকাল-সন্ধ্যায় পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ।
তার মাঝে বিশাল বিশাল পুকুর। পুকুরের চারপাশেই শ্বেতপাথরে নির্মাণ করা শানবাঁধানো ঘাট। ঘাটের চার পাশের সিঁড়িগুলো পুকুরের মাঝখানে এসে একত্রে মিলিত হয়েছে। পুকুরগুলো খুব গভীর যার কারণে সব সময়ই থাকে অথৈ পানি। জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়িটির স্মৃতি রক্ষার্থে প্রায় সাড়ে ১৩ একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিক্রমপুর জাদুঘর।
অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ও সরকারি অর্থায়ণে নির্মাণ করা হয়েছে জাদুঘর ও গেস্ট হাউজ। জাদুঘরের প্রথম তলায় দুইটি গ্যালারি করা হয়েছে। গ্যালারি দুইটির নামকরণ করা হয়েছে জমিদার যদুনাথ রায় ও বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যান্য গ্যালারি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শনিবার-বুধবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দুপুর ২ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকছে জাদুঘরটি। কোনও প্রবেশ মূল্য রাখা হয় না এখানে। ভবনে মোট ৭টি গ্যালারীতে রাখা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব ইতিহাসের সাক্ষী।
একটি গ্যালারীতে নতুন মাত্রায় যোগ হয়েছে রঘু রামপুর ও নাটেশ্বর থেকে প্রাপ্ত কিছু মহামূল্যবান নির্দশন। এসব নির্দশন বিক্রমপুরের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যবহন করছে। বছরের এই সময় দর্শনার্থীর ভিড় জমে এখানে। প্রতিদিন শত শত দর্শক আসছে জাদুঘর পরির্দশন করতে। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে জাদুঘর প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠানমালার আয়োজন হয়ে থাকে।
এই তো গত ২০ জানুয়ারি শুক্রবার বালাশুর প্লাটুনের আয়োজনে বিক্রমপুর জাদুঘর প্রাঙ্গলে অনুঠিত হয়েছে বিক্রমপুর পিঠা উৎসব-২০২৩। দিনব্যাপী পিঠা উৎসবে দুরদুরান্ত থেকে গুনীজনদের পদচারনায় বিক্রমপুর জাদুঘর প্রাঙ্গণ মূখরীত হয়ে উঠে। আপনিও ঘুরে আসতে পারেন: মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার রাঢ়িখাল ইউনিয়নের বালাশুরে অবস্থিত জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়িটি। যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে বিক্রমপুর জাদুঘর। বিক্রমপুর সমন্ধে অনেক অজানা তথ্য হয়ত এই জাদুঘর ভ্রমণের মধ্যে দিয়েই জানতে পারেন। দেখতে পাবেন শতশত বছর আগে জমিদার পরিবারের ব্যবহারিক সব আসবাবপত্র, ধাল-তলোয়াল, ৪শত’ বছরের কাঠের নৌকা, কামানের অংশ বিশেষ, মূল্যবান পাথরের ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র। যা কি’না যুগযুগ ধরে মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের জনপদের ঐতিহ্যের স্মারক বহন করছে। কি ভাবে আসবেন: ঢাকার গুলিস্তান বা পোস্তাঘোলা থেকে শ্রীনগর হয়ে দোহারের যাত্রীবাহী বাসগুলো কিছুক্ষণ পরপরই ছেড়ে আসছে এদিকে।
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে আসতে সময় লাগবে প্রায় ৪০-৬০ মিনিট। নামতে হবে ভাগ্যকুলে বালাশুর চৌরাস্তায়। এখান থেকে যে কোনও রিক্সা কিংবা ইজিবাইকে করে প্রায় ১০ মিনিটের রাস্তা শেষে জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়ি (সাবেক) অথাৎ বিক্রমপুর জাদুঘর। এসব পরিবহনে সর্বমোট ভাড়া লাগবে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এছাড়াও সময় পেলে দিনব্যাপী ঘুরে আসতে পারেন একই এলাকার রাঢ়িখালের শ্রীনগর-দোহার সড়ক সংলগ্ন জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর পৈত্রিক বাড়িটিও। এখানে বিজ্ঞানীর স্মৃতি চারণে গড়ে তোলা হয়েছে স্যার জেসি বোস কমপ্লেক্স ও পিকনিক কর্নার।
পর্যটকদের জন্য সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু কমপ্লেক্স ও জগদীশ চন্দ্র বসু জাদুঘরটি খোলা রাখা হয়। প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি মাত্র ২০ টাকা। ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে বিখ্যাত ঘোলের স্বাদ নিতে আসতে পারেন পদ্মা নদীর তীর ঘেষা ঐতিহ্যবাহী ভাগ্যকুল বাজারে। বিখ্যাত ঘোল ও সু-স্বাদু দইসহ বাহারী সব মিষ্টি পাওয়া যাবে ভাগ্যকুল বাজারের কয়েকশত বছরের পুরনো গোবিন্দ্র মিষ্টান্ন ভান্ডারে। এছাড়াও এছাড়াও দর্শনার্থীরা দেখতে পারেন বিখ্যাত আড়িয়াল বিলে পাশে দক্ষিণ এসিয়ার সবচেয়ে উঁচু শ্যামশিদ্ধিতে অবস্থিত মঠটিও। মঠটি দেখতে প্রতিদিন শতশত পর্যটক আসছেন এখানে। অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন শ্রীনগর কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক লেখক মুজিব রহমান জানান, বিক্রমপুরের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এক সময় পূর্ব বঙ্গ বা সমতটের রাজধানী ছিল আদি বিক্রমপুর। আর এই মাটিতেই জন্মগ্রহন করেছেন অনেক নামকরা ব্যক্তিবর্গ।
বিক্রমপুরের মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে হাজার বছর আগের নৌকা, কাঠের ভাস্কর্য, পাথরের ভাস্কর্য, টেরাকোটাসহ অসংখ্য অমূল্য প্রত্নতত্ব বস্তু। এসব অতীত ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে প্রদর্শনের জন্য অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন এখানে বিক্রমপুর জাদুঘর। “আমরা আলোর পথযাত্রী” শ্লোগানকে সামনে রেখে দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনটি এই অঞ্চলে কাজ করে যাচ্ছে।
আরএক্স/