‘এক কাপ চায়ে তুমি’ কবি সজলের তৃতীয় প্রয়াস


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৫:২৭ পূর্বাহ্ন, ১৯শে ফেব্রুয়ারি ২০২৩


‘এক কাপ চায়ে তুমি’ কবি সজলের তৃতীয় প্রয়াস
‘এক কাপ চায়ে তুমি’ বইয়ের প্রচ্ছদ

বন্ধু সজলের কবি হয়ে ওঠা সাম্প্রতিক। তবে লেখার প্রবণতা ওঁর মাঝে আগে থেকেই ছিল। আমরা যখন  ব্যাংকে কাজ করতাম, ছুটির দিনে এখানে-ওখানে আড্ডা দিতাম। ভরা মজলিশে ও সহসা দু'চার লাইন আওড়াত, স্বরচিত। আমরা সমস্বরে বাহবা দিতাম। ব্যাংক ছাড়ার পর এই কবি আত্মাই ওকে পুরোপুরি জুড়ে বসলো। ভোরে ফোটা অজস্র শিউলীর মত ডায়েরির পাতা ছেয়ে যেতে লাগলো কবিতায়। বিগত দুই বইমেলায় কবিতাগুলো ঠাঁই নেয় ডায়েরির পাতা থেকে বইয়ের মুদ্রিত পাতায়। এই ধারাবাহিকতার চলমানতায় ‘এক কাপ চায়ে তুমি’ কবি সজলের তৃতীয় প্রয়াস। 


বিচ্ছিন্নভাবে ইটেরা পোড়া মাটির খন্ড মাত্র। কিন্তু ওস্তাগর যখন চুনাপাথর আর বালি সহযোগে একের পর এক ইট গাঁথেন, তখন তা রূপ নেয় সুরম্য ভবনের। তাতে মানুষ বসত করে। কবিতাও তেমনি। প্রথমে বোধের সঞ্চার। অতঃপর শব্দকোষের ক্রম সঞ্চিতি। পরিশেষে ভাবের পূর্ণতাপ্রাপ্তি এবং কবিতার আত্মপ্রকাশ। কবিগণ কবিতার জনক। তাই তাঁরা প্রিয়বরেষু।


বলা হয়ে থাকে ভাষা ভাব প্রকাশের মাধ্যম। ভাষার আরও একটি উপযোগিতা আছে। এটি ভাব বিকাশেরও মাধ্যম। মানুষ যখন থেকে ভাষা উদ্ভাবন ও এর ব্যবহার করতে শিখেছে, তার অব্যবহিত পরেই কবিতারও যাত্রা শুরু। পৃথিবীতে যতদিন ভাষা থাকবে, ততদিন কবিতাও বিরাজ করবে। কবিতায় কোন একটি বিশেষ ভাবকে ধারণ করা হয়। কবিতা সার্থক হয়ে ওঠে সেই ভাবটির উত্তরোত্তর বিকাশে। কবিতার অন্তর্গত ভাবটুকুর একটা শ্বাশত রূপ ও আবেদন থাকে। এর ফলে কবিরা বিনাশপ্রাপ্ত হন, কিন্তু কবিতারা বেঁচে থাকে।


‘এক কাপ চায়ে তুমি’ কাব্যগ্রন্থে মোট উনচল্লিশটি কবিতা সন্নিবিষ্ট হয়েছে। গ্রন্থটির নামকরণ রোমান্টিক আবহের অনুঘটক। সজল মূলত রোমান্টিক কবি। তাঁর কবিতার উপজীব্য প্রেম। বইটিতে সর্বাধিক ষোলোটি কবিতাই প্রেমের। এই প্রেম উপস্থাপিত হয়েছে দুইটি আঙ্গিকে। প্রথমটি অনুরাগনির্ভর। এখানে কবি প্রেমের সফল পরিণতিতে অনুপ্রাণিত, উজ্জীবিত। তবে প্রেমে সাফল্য তাঁকে প্রগলভ করেনি, ভাসিয়ে নিয়ে যায় নি বল্গাহীন কোন উদ্দামতায়। বরং হৃষ্টচিত্ত কবি তাঁর অর্জন ও প্রাপ্তিতে প্রেয়সীর নিকট কৃতজ্ঞ,  সমর্পিত। দ্বিতীয় আঙ্গিকে উপস্থাপিত প্রেম বেদনার নিষ্পেষণ বেদীতে সকাতর। লক্ষণীয় বিষয়, কবির যাতনা উৎসারণের কারণ প্রেমিকার বিয়োগ অথবা প্রত্যাখ্যান নয়। অযাচিতভাবে কবি মর্মাহত হন প্রেয়সীর উপেক্ষায়, তাঁর জীবন থেকে প্রেয়সীর প্রত্যাহার অথবা অন্তর্ধানে। কবির ব্যর্থতা তাঁকে হতাশায় নিমজ্জিত করে, বিচ্যুত করে সুস্থির জীবনযাপন থেকে। সজলের প্রেমের প্রকাশ বড় আধুনিক। প্রেম ছিল,আছে, থাকবে। কবি সজল প্রেমকে তাঁর সমসাময়িক ফ্রেমে তুলে এনেছেন। 


বইটির একটা বড় অংশ ব্যাপ্ত চিন্তামূলক (Thought Provoking)কবিতায়।এরা সংখ্যায় তেরটি। এইসব কবিতার বিষয়বস্তু মন ও মননভিত্তিক। কবি কখনও স্বপ্নকে মুখোমুখি করেছেন কঠিন বাস্তবতার, কখনও বা যান্ত্রিক জীবন ও অস্থির সময়ের যুগপৎ মিথষ্ক্রিয়ায় আবেগ ও অনুভূতির অসারতাকে প্রতিভূ করেছেন। সজল ব্যঙ্গ করতেও ছাড়েননি মানুষের নির্লজ্জ স্বার্থপরতাকে অথবা সমতাকামী গলাবাজির অন্তরালে আধিপত্যবাদ কায়েমের মানসিকতাকে। তিনি মানুষে মানুষে সম্পর্ক এবং বন্ধুত্বকেও সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস পেয়েছেন। 


কাব্যগ্রন্থটিতে নীতিকবিতা এসেছে দু'টি (জীবনের গল্পকথা ও উপলব্ধি) এবং ওড মাত্র একটি (একাকী)। সংখ্যায় সীমিত হলেও মানের বিচারে তিনটি কবিতাই যথার্থ। ‘জীবনের গল্পকথা’য় কবি ভঙ্গুর জীবনে আপনজনের অপরিহার্যতাকে প্রতিপাদ্য করেছেন। আবার ‘উপলব্ধি’ কবিতায় প্রতিকূল পরিবেশের উপর্যুপরি সমাপতনকে সহজভাবে গ্রহণ করার মানসিকতার মধ্যে জীবনের সার্থকতাকে খুঁজে পেয়েছেন। নতুন করে বিনির্মাণের আবশ্যকতায় পুরাতনকে বিসর্জন দিতে হয়, কিন্তু তা ঘটে এক নীরব কান্নার মধ্য দিয়ে। কবি তার আখ্যান দিয়েছেন ‘একাকী' ওডে।


বইটিতে প্রকৃতিভিত্তিক রচিত কবিতা তিনটি। ‘একটি অভাগা নদী', ‘একটি সবুজ প্রান্তর' ও ‘গল্পগুলো জীবন্ত'। এক্ষেত্রে নদীটি যেন গোটা প্রকৃতিরই প্রতিনিধি। কালের বিবর্তনে প্রকৃতি নিঃশেষিত হচ্ছে, ইট-পাথরের কৃত্রিম সভ্যতা প্রতিনিয়ত গ্রাস করছে তাকে। জীর্ণ-শীর্ণ অভাগা নদী সেকথাই জানান দেয়। অন্যদিকে সবুজ প্রান্তরটি কালে কালে তার বুকে বয়ে যাওয়া ঘটনাবলীর বোবা সাক্ষী হয়ে পড়ে থাকে। দিন শেষে কুশীলবরা ফিরে যায় আপন নিবাসে। অতঃপর প্রান্তরের সঙ্গী হয় চিরচেনা ঘাস আর মন হুহু করা বৃক্ষরাজি।পরিশেষে ‘গল্পগুলো জীবন্ত' কবিতায় কবি বলেছেন মাটি, মানুষ, ও প্রকৃতির সখ্যতার কথাও। বৃহত্তর ক্যানভাসে মানুষ তো প্রকৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, প্রকৃতিকে সাথী করেই সে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। আবহমান বাংলায় প্রকৃতি ও মানুষে এই আত্মীয়তা শ্বাশ্বত, চিরন্তন।


সজল মনির তাঁর কাব্যিক অভিযাত্রা শুরু করেছেন পরিণত বয়সে। সে হিসেবে তিনি একজন নবীন অভিযাত্রী। কিন্ত কবিতার প্রতি নিষ্ঠা নিখাদ। বিষয়বস্তু নির্বাচন ও রচনার ধারবাহিকতা সে ইঙ্গিত বহন করে। সময়ের সাথে সাথে তাঁর কলম বলিষ্ঠ হবে, তিনি হয়ে উঠবেন জনমানুষের কবি। দেশ, সমাজ, ও জাতির মানসপটে রাখবেন কালোত্তীর্ণ ছাপ, এই প্রত্যাশা করি। কামনা রইলো, ‘এক কাপ চায়ে তুমি' বহুল প্রচারিত হোক, উত্তরোত্তর সাফল্যে কবি ব্রতী হোন নতুন রচনাসম্ভারে।


লিখেছেন: ময়েজ শরীফ