কুষ্টিয়ায় শিশুদের পোশাক তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছে নারীরা


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৪:৩৩ অপরাহ্ন, ২৮শে জানুয়ারী ২০২৪


কুষ্টিয়ায় শিশুদের পোশাক তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছে নারীরা
ছবি: জনবাণী

কুষ্টিয়া শহর সমাজসেবা সমন্বয় পরিষদের ব্যাতিক্রমী উদ্যোগে শিশুদের জিরো সাইজ থেকে শুরু করে ছয় মাসের শিশুদের অত্যাধুনিক মানের পোশাক তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছে সমাজসেবায় প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত অসহায়, বেকার,অস্বচ্ছল নারীরা। 


বিনা খরচে প্রশিক্ষন শেষ করে সেখানেই কর্মসংস্থান পাওয়া নারীদের কাছে এ যেনো এক ভাগ্যের লটারীর মত। হয়ে উঠছেন একজন নারী উদ্দোক্তা। প্রতিমাসে আনুমানিক ৪ হাজার শিশুদের জিরো সাইজের পোশাক প্রস্তুত করছেন এই সমন্বয় পরিষদের আওতাধীন নারী শ্রমিকেরা। সমাজসেবা সমন্বয় পরিষদের অর্থায়নে এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।


আরও পড়ুন: কুষ্টিয়ায় ট্রাক থামিয়ে ড্রাইভার ও হেলপারকে মারধর, টাকা লুট ও গাড়ি ভাংচুর


সেলাই এবং প্যাকিটিং সহ বাজারজাত প্রস্তুতি সম্পন্ন করা পর্যন্ত প্রতিপিস পোশাক তৈরি করে ২০ টাকা করে পারিশ্রমিক পাচ্ছেন নারী শ্রমিকেরা। শহর সমাজসেবা সমন্বয় পরিষদের আওতাধীন কুষ্টিয়া শহরের আমলাপাড়া এলাকায় অবস্থিত দক্ষতা উন্নয়ন  প্রশিক্ষন কেন্দ্র (অফিস-২) এ  ৩ জন প্রশিক্ষক এবং মোট ১৩ জন নারী শ্রমিক প্রতিদিন শিশুদের পোশাক তৈরিতে কাজ করছেন।  


প্রশিক্ষক যারা আছেন তারা উন্নত মানের কাপর ডিজাইন করে সেগুলো কেটে দিচ্ছেন। আর সেই ডিজাইন রুপে কাটা কাপরগুলো সেলাই করে, সেগুলোর বোতাম লাগিয়ে সম্পন্ন কাজ শেষ করে প্যাকিটিং করে বাজারজাত সম্পন্ন করে পিস প্রতি পারিশ্রমিক পাচ্ছেন নারী শ্রমিকের উদ্দোক্তারা।  প্রতিদিন গড়ে ২০-২৫ টি করে পোশাক সেলাইয়ের কাজ সম্পন্ন করতে পারে একজন নারী শ্রমিক। 


প্রতিদিন একজন কর্মী প্রায় ৪০০-৫০০ টাকা উপার্জন করতে পারছে। এতে একজন মহিলা কর্মী প্রতিমাসে প্রায় ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারছেন। স্বাবলম্বী হচ্ছেন অসহায়, গরীব ও বিধবা নারীরা। সারা বাংলাদেশে মোট ৮০ টির বেশি সমন্বয় পরিষদ রয়েছে। কিন্তু এই রকম ব্যাতিক্রম ধরনের উদ্যোগ কুষ্টিয়াতেই প্রথম নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। 


জানা গেছে, ২০২১ সাল থেকে এই কার্যক্রম শুরু করেন কুষ্টিয়া শহর সমাজসেবা সমন্বয় পরিষদ। প্রথমে পায়ে চালানো সেলাই মেশিন দিয়ে এই


কার্যক্রম শুরু করলেও এখন প্রায় ১২ টি ডিজিটাল সেলাই মেশিনে এই কাজগুলো করছেন নারী শ্রমীকেরা। তাদের এই নতুন ডিজাইনের পোশাকের চাহিদা এখন দিন দিন বেড়ে যাওয়ার কারনে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা এবং বেসরকারি সংস্থা থেকে পোশাকের অর্ডার পাচ্ছেন তারা। চলতি মাসে সূর্যের হাসি নেটওয়ার্ক থেকে ৬ হাজার ৯ শত ১৭ পিস পোশাকের অর্ডার পেয়েছেন তারা। এর আগে ৩ হাজার ৩ শত ৫৮ পিস পোশাক সেখানে দিয়েছিলেন তারা। 


এ ছাড়াও জাপান টোবাক্কো ইন্টারন্যাশনালের ২৪০ জন চাষী পরিবারের নারীদের এই পোশাক তৈরির প্রশিক্ষন দিয়েছেন কুষ্টিয়া শহর সমাজসেবা সমন্বয় পরিষদের প্রশিক্ষকেরা।  প্রতি বছরে ২ বার করে এই  প্রশিক্ষন হয় ৬ মাস পর পর।  প্রথমত জানুয়ারী মাস থেকে জুন আর জুলাই মাস থেকে ডিসেম্বর মাস। প্রতি ৬ মাস পর পর ১০০ জন করে দুইবারে ২০০ জনকে এই পোশাক তৈরির প্রশিক্ষন দেয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের সমন্বয় পরিষদ। আরও বেশি প্রশিক্ষন কর্মশালা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন  সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষরা। 


শহর সমাজসেবায় প্রশিক্ষন নিয়ে সেখানেই কর্মরত নারী উদ্দোক্তা রাফেজা ইসলাম বৈশাখী জানান, ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল এই কাজ শেখার। তারপর এখানে ভর্তি হয়েছি, এখান থেকে সম্পূর্ণ কাজ শিখেছি। প্রশিক্ষণ শেষে এখান থেকে আমাকে সার্টিফিকেট দিয়েছে। এখন এখান থেকে আমি প্রতিমাসে কাজ করে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা ইনকাম করছি। আমি এখন নিজে থেকে স্বাবলম্বী। আর এখানে অনেক সেফটির সাথে থেকে কাজ করা যায়। 


আরও পড়ুন: কুষ্টিয়ায় নাবালক শিশু হত্যার দায়ে একজনের যাবজ্জীবন 


আরেকজন নারী শ্রমিক উদ্যোক্তা বলেন, আমার বাবা একজন কাটিং মিস্ত্রি বাবার কাছ থেকে অনেকটা শিখছি। বাবা অসুস্থ মা ও বিছানায় পড়ে আছে। আমাদের পারিবারিক অবস্থা খুবই খারাপ। অভাব অনটনের মধ্যে জীবন কাটছিলো। তখন আমি ভাবছিলাম কিছু একটা করবো।অনেক জায়গায় কাজের জন্য ছুটছিলাম কাজও পাচ্ছিলাম না। তারপর এক আন্টির মাধ্যমে এখানে আসি। এখানকার প্রশিক্ষক আপুরা খুবই ভালো। তারা আমাকে অনেক কাজ বুঝিয়ে দিয়েছে। আমি এখন কাজ করছি। আশা করি কাজ করে নিজের পায়ে দারাতে পারবো। 


প্রধান প্রশিক্ষক হাসনা জাহান জানান, এখানে বিগত চার মাস যাবত সূর্যের হাসি নেটওয়ার্কে আমরা অর্ডার পেয়েছি। প্রথমত আমরা ৬ জন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। ৬ জন থেকে এখন আমাদের বর্তমানে কর্মী আছে ১৩ জন। তার মধ্যে দশজন অফিসে কাজ করে এবং তিনজন বাড়িতে কাজ করে। এখানে প্রতি মাসে যারা কাজ করেছে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার টাকা আয় করতে সক্ষম হয়েছে। এরা কুষ্টিয়া শহর সমাজসেবা সমাজসেবা থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েছে আবার এখানেই কাজের সুযোগ পেয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে ২০ থেকে ৩০ জন মত কাজ করার মত সক্ষমতা আছে। আমাদের প্রশিক্ষণটাও চালু আছে পাশাপাশি পোশাক তৈরির কার্যক্রমও চালু আছে।


কুষ্টিয়া শহর সমাজসেবা সমন্বয় পরিষদের সাধারন সম্পাদক ও শহর সমাজসেবা অফিসার মো. জহিরুল ইসলামের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আসলে আমাদের এই সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি আগে আমরা ম্যানুয়াল মেশিনে চালাতাম। তারপরে এখানে আমি যোগদান করার পর থেকে ২০২১ সাল থেকে এই কার্যক্রমকে বেগমান করার চেষ্টা করেছি। ২০২১ সালে আমরা প্রথম জাপান টোবাকর প্রায় ২৫ জন চাষী পরিবারের নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। তারপরে আমাদের সাথে সূর্যের হাসি নেটওয়ার্ক যোগাযোগ করেন এবং তারা জানতে পারে আমরা অন্যান্য কার্যক্রমে বিভিন্ন সংস্থার সাথে সহযোগিতার ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। তারা তাদের ইচ্ছা পোষণ করেন যে এই ধরনের শিশুদের পোশাক জিরো সাইজ থেকে শুরু করে ছয় মাসের শিশুদের পোশাক তারা নিবেন। আমরা কিছু পোশাকের স্যাম্পল পাঠায় তারা পছন্দ করেন। তারপর তারা ৬০০ পিস পোশাকের অর্ডার দেন। আমরা সঠিক সময়ে পোশাকগুলো সরবরাহ করতে সক্ষম হই। তারপর আবারও ৩৩০০ পিস পোশাকের অর্ডার দেন আমরা সেগুলোও সঠিক সময়ে পৌঁছাতে সক্ষম হই। বর্তমানে আমরা প্রায় সাত হাজার পিসের অর্ডার নিয়ে কাজ করছি। আমাদের এখান থেকে আগে যারা কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তাদেরকে আমরা সনদ দিয়েছি। সনদ দিয়েই আমরা তাদেরকে ছেড়ে দেয়নি তাদেরকে মনিটরিং করেছি তাদের সাথে যোগাযোগ করেছি এবং বর্তমানে তাদেরকে শহর সমাজসেবা অধীনস্থ সমন্বিত পরিষদের ব্যানারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এসব মেয়েরা প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা ছোটখাটো উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো তাদেরকে আমরা তাদের স্বপ্নপূরণে ইনভেস্ট করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ভবিষ্যতে এটি আরো বড় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।  


আরএক্স/