যেভাবে সোমালিয়ান জলদস্যুর কবলে পড়ল বাংলাদেশি জাহাজ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:০৮ অপরাহ্ন, ১৩ই মার্চ ২০২৪

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’। সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজটি আফ্রিকার মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়ার পথে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। গতকাল দুপুর দেড়টায় জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার বিষয়টি জানতে পারে মালিক কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। জাহাজের ২৩ নাবিকের সবাই নিরাপদে রয়েছেন। জানা যায়, জলদস্যুরা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর জাহাজটি মোজাম্বিকের কাছাকাছি অবস্থান করছে।
মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুর দেড়টার দিকে ‘এম ভি আবদুল্লাহ’ জাহাজের ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ চট্টগ্রামের এসআর শিপিংয়ের কর্মকর্তাদের জানান, ‘জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিতে মাত্র ১৫ মিনিট লাগে জলদস্যুদের।’ তিনি আরও জানান, ‘জাহাজে জলদস্যুতের আক্রমণের খবর পেয়েই শিপিংয়ের কর্মকর্তারা যে কোনো মূল্যে তা ঠেকানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু এর ১৫ মিনিট পরই ক্যাপ্টেনের একটি ই-মেইল বার্তা আসে চট্টগ্রামে। সেখানে তিনি জানানো হয়- জলদস্যুরা জাহাজের দখল নিয়ে ফেলেছে।’
আরও পড়ুন: সোমালিয়ার দস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজে আছেন যে ২৩ নাবিক
জিম্মি জাহাজ থেকে গোপনে একটি অডিও বার্তা পাঠিয়েছেন চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান। ৩ মিনিট ৩৪ সেকেন্ডের ওই অডিও বার্তায় জলদস্যুদের কবলে পড়ার সম্পূর্ণ ঘটনাটি বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে জানিয়েছেন জাহাজ ও তাদের বর্তমান পরিস্থিতিও। আতিকুল্লাহ খান তার অডিও বার্তায় জানান, জাহাজটিতে খাবার পানির পরিমাণ কম। আবার জাহাজে যেসব কার্গো রয়েছে সেগুলোও বিপজ্জনক। রয়েছে অগ্নিঝুঁকিও। সোমালিয়ান জলদস্যুরা জাহাজে ওঠার পর কার সঙ্গে কী আচরণ করেছে তাও বর্ণনা করেছেন তিনি।
অডিও বার্তাটি হুবহু তুলে ধরা হলো :
‘আসসালামু আলাইকুম, আমি চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান বলছি। আজকে সকালে জাহাজের সময় আনুমানিক সাড়ে ১০টার সময় একটা হাইস্পিড বোট আমাদের দিকে আসছিল। সঙ্গে সঙ্গে আমরা এলার্ম দিয়ে ব্রিজে গেলাম। ওখান থেকে পরে সিটে চলে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার ও সেকেন্ড অফিসার ব্রিজে ছিলেন। আমরা ঝিকঝাক কোর্স করলাম। তারপর এএসএস-এ করলাম। ইউকে এমটিকেও ট্রাই করলাম। কিন্তু তারা ফোন রিসিভ করেনি। এর মধ্যে জলদস্যুরা চলে আসলো।
চলে আসার পর ওরা ক্যাপ্টেন স্যার ও সেকেন্ড অফিসারকে জিম্মি করে। আমাদের ডাকল। আমরা সবাই আসলাম। আমাদের ডেকে কিছু গোলাগুলি করল। আমরা একটু ভয় পেয়েছি। সবাই ব্রিজে বসেছিলাম। কারো গায়ে হাত তোলেনি। শুধু সেকেন্ড অফিসারকে একটু মারধর করেছে। তারপর আরেকটি স্পিডবোটে করে আরও কয়েকজন চলে আসল। এভাবে মুহূর্তেই প্রায় ১৫-২০ জন চলে আসে।
এর কিছুক্ষণ পরে একটি বড় ইরানিয়ান ফিশিং বোট নিয়ে আরও জলদস্যু চলে আসে। ইরানিয়ান ওই ফিশিং বোটটি এক মাস আগে তারা জিম্মি করেছিল। এটি দিয়ে তারা এক মাস ধরে নতুন কোনো জাহাজ জিম্মি করার জন্য সাগরে ঘোরাঘুরি করছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সামনে পড়ে গেলাম। এই ফিশিং বোটের তেল শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের জাহাজে থাকা পাম্প দিয়ে কিছু ডিজেল নিয়ে ওই বোটে দিয়েছে তারা। তেল দেয়ার পর আমাদের জাহাজে উঠে জিম্মি করা ফিশিং বোটটিকে ছেড়ে দেয়।
আরও পড়ুন: সোমালিয়ার দস্যুদের দখলে বাংলাদেশি জাহাজ, জিম্মি ২৩ নাবিক
তারপর ওরা আমাদের সেকেন্ড ও থার্ড অফিসারকে নিয়ে জাহাজের ইঞ্জিন রুমে যায়। তাদের নিয়ে গিয়ে জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়। এখন পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে কারো কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। জাহাজের কোনো ক্ষতি হয়নি। আমাদেরও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে সবাই ভয়ে আছি। ওরা খুব ভয় দেখাচ্ছে।
আমাদের জাহাজে ২০-২৫ দিনের খাবার পানি আছে। সবাইকে বলেছি, এগুলো একটু সাবধানে ব্যবহার করতে। শেষ হয়ে গেলে বিপদে পড়ব আমরা। তবে, একটা সমস্যা হচ্ছে আমাদের জাহাজে কিছু কোল্ড কার্গো আছে। প্রায় ৫৫ হাজার টন। এগুলো একটু ডেঞ্জারাসও। ফায়ারেরও ঝুঁকি আছে। মিথেন বাড়ে। লাস্ট যখন অক্সিজেন মেপেছি তখন ৯-১০ শতাংশ লেভেল পেয়েছি। এটি নিয়মিত মনিটরিং করতে হয়। কোনো কারণে অক্সিজেন লেভেল বেড়ে গেলে বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে। এটার একটু ব্যবস্থা করবেন, স্যার। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমাদের পরিবারকে একটু দেখবেন। সান্ত্বনা জানাবেন। আসসালামু আলাইকুম।’
জেবি/এজে