দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান নির্বাহী প্রকৌশলী হাদী


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬:০৪ অপরাহ্ন, ১লা জুলাই ২০২৪


দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান নির্বাহী প্রকৌশলী হাদী
ছবি: জনবাণী

১৬ বছরের কর্মজীবনে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান ঢাকা পাওয়ার ড্রিস্টিবিউশন কোম্পানী (ডিপিডিসি) লিমিটেডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: রাজিবুল হাদীর (আইডি ১১০৯০)।  তিনি ছাত্রজীবনে ছিলেন শিবিরের ক্যাডার। বিএনপি- জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে নানা অপকর্মে জড়িয়ে তিনি।


অভিযোগ উঠেছে, ডিপিডিসির মুর্তিমান আতঙ্কেও আরেক নাম হাদী। অপ্রতিরোধ্য এক সিন্ডিকেট গড়ে তিনি এখন ডিপিডিসি’র ত্রাস। তবে শেষ রক্ষা হচ্ছে না হাদীর। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা পড়েছে হাদীর সম্পদের ফিরিস্তি। যার তদন্তে বেরিয়ে আসতে পারে দুর্নীতির কালো বিড়াল। ডিপিডিসি এবং দুদক সূত্রে জানা গেছে, রাজিবুল হাদী বর্তমানে ‘ডিপিডিসি এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছেন। হাদী যেখানেই যান, গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি। দেশের স্বার্থ ক্ষুন্ন করে অর্থের লোভে চীনাদের হয়ে কাজ করেন। যোগ্য ঠিকাদারের পরিবর্তে অযোগ্য ঠিকাদারের সঙ্গে মিলে কাজ করেন। এজন্য কমিশন হিসেবে বিপুল টাকা নেন তিনি।


জিটুজি’র মতো স্পর্শকাতর এবং ড্রিম প্রকল্পে দুর্নীতিবাজদের পদায়ন করা নিয়ে এখন জোড়ালো প্রশ্ন উঠছে প্রকৌশল সমাজে। তারা  প্রকল্পের কাজের গুনগত মান, দেশের টাকা সাশ্রয়ের বিষয়েও প্রশ্ন তুলছেন। প্রকৌশলীরা বলছেন, ডিপিডিসিতে যোগ্য প্রকৌশলীদের জিটুজি প্রকল্পে পদায়ন না করাতে ভবিষ্যতে এই প্রকল্পের কাজের গুনগত মান, টেকসই হবে না। এই প্রকল্পে গুটিকয়েক দুর্নীতি পরায়ন প্রকৌশলীর কারনে কাজের ব্যয় আরও অনেক বেড়ে যাবে। ব্যয় বেড়ে গেলে তা রাষ্ট্রের জনগণের অতিরিক্ত করের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।


অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ডিপিডিসি’তে গত ১৬ বছর ধরে কর্মরত তিনি। যশোরের নাজির, সংকরপুর তার গ্রামের বাড়ি। ২০০৭ সালে তিনি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড ডিজাইন পরিদপ্তরে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে তার চাকরি জীবন শুরু হয়। ২০০৮ সালের ৯ জুলাই তিনি ডিস্ট্রিবিউশন প্লানিংয়ে (দক্ষিন শাখা) সহকারী ম্যানেজার (নির্বাহী প্রকৌশলী) হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে ডিপিডিসিতে কাজ শুরু করেন। এরপর থেকেই বদলে যেতে থাকে তার ভাগ্য। ২০১৪ সালে তিনি সাব ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার (কোম্পানি সেকেটারীয়েট) হিসেবে কাজ শুরু করেন। রাজিবুল হাদী ডিপিডিসির খিলগাঁও ডিভিশনে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে ১৭ এপিল ২০১৮ থেকে ৪ জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। পরে তাকে ৪ জুলাই ২০১৯ সালে জি টু জি প্রকল্পে বদলি করা হয়। খিলগাঁও ডিভিশন একটি সুত্রে জানা যায়, তৎকালীন সময় তিনি গ্রাহকদের সঙ্গে অসদাচরণ, গ্রাহক হয়রানি এবং নতুন বিদ্যুৎ সংযোগে গ্রাহকরা ঘুষ না দিলে সংযোগ না দিতে বিভিন্ন রকম টালবাহানা করতেন। পরবর্তীতে হাতে টাকা পেলে সে গ্রাহকের সংযোগ দিতো। এমনকি বিদ্যুৎ বিলের কিস্তি করাতে গেলেও তিনি সেখান থেকে উৎকোচ দাবি করতেন। খিলগাঁও ডিভিশনের তৎকালীন কর্মচারী এক সিবিএ নেতা হাদীর এসব বিষয়ে বলতে গিয়ে জানান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রীর রেফারেন্সে এক বিদ্যুৎ গ্রাহক উচ্চচাপ বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য আবেদন করলে ওই গ্রাহকের কাছ থেকেও সে পরবর্তীতে এক লক্ষ টাকা ঘুষ নেয় এবং তাকে সংযোগ প্রদান করে। এই নির্বাহী প্রকৌশলীর অনিয়ম ও স্বেচ্চারিতার কারনে তৎকালীন সময় বেশ কয়েকজন বিদ্যুৎ গ্রাহক তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ তুলে ডিপিডিসির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে প্রধান কার্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিশেষ কারনে তাকে অনিয়মের দায়ে বরখাস্ত না করে খিলগাঁও ডিভিশন থেকে প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে জিটুজি প্রকল্পে বদলি করে। দুর্নীতির অনিয়মের কারনে বদলি বা স্থানান্তর হওয়া হাদীর নতুন কিছু নয়। সংশ্লিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ২০০৮ সালে দক্ষিন শাখা ডিস্ট্রিবিউশন প্লানিংয়ের সহকারী ম্যানেজার (নির্বাহী প্রকৌশলী) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ঘুষ-দুর্নীতি হুমকি ও অসদাচরণের জন্য রাজীবুল হাদীকে ওএসডি করে টঙ্গী স্টোরে সংযুক্ত রাখে ডিপিডিসি। 


সুত্র বলছে, একসময়ে শিবির থেকে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বর্নচোরা হন তিনি। এক-এগারোর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতেই তিনি অতীতের পরিচয় পাল্টে ফেলেন। এজন্য যশোরে সরকার দলীয় এক সাংসদের ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে রাম-রাজত্ব কায়েম শুরু করেন ডিপিডিসিতে। সরকার দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবের ফাঁকা আওয়াজ দেখিয়ে রাজীবুল হাদী ডিপিডিসির কর্মকর্তাকে জিম্মি করে রাখেন। তিনি তার অধীনস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনেকের চাকরি খাওয়ার হুমকি দিয়েছেন। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একাধিক প্লট, রূপায়নে ফ্ল্যাট ও যমুনা ফিউচার পার্কে একাধিক দোকান রয়েছে। ঢাকা শহরে বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে রয়েছে ফ্ল্যাট রয়েছে। তিনি ডিপিডিসির কর্মকর্তা হয়েও টিবিইএ’র প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। তার ২টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে এমা কনস্ট্রাকশন ও বেসিক। এই কোম্পানী অন্য নামে নামে থাকলেও মূল মালিক হচ্ছেন রাজীবুল হাদী। যশোরে ও ঢাকায় তার স্ত্রীর নামেও বিপুল পরিমান স্থাবর অবস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে।


আরও পড়ুন: সাংবাদিকের হাড্ডি-মাংস এক করে ফেলতে চান হাদী


সূত্র বলছে, হাদী চাইনিজ বেসরকারি কোম্পানীগুলোকে বিভিন্ন কাজের নকশা, ড্রইং ডিজাইন করে দেন। ডিজাইনে নয়ছয় করে প্রকল্পের শতশত কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করেন। তিনি সম্প্রতি সিনম নামে একটি চাইনিজ কোম্পানীকে দুই শত কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ পেতে সহায়তা করেন। যার বিনিময়ে তিনি সেখান থেকে ৫ভাগ কমিশন নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।


আরও পড়ুন: কালো টাকায় ডিপিডিসির হাদীর সম্পদের পাহাড়


এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং ডিপিডিসি’র পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মো. হাবিবুর রহমান দৈনিক জনবানীকে বলেন, তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবো। দুর্নীতিবাজ যে হউক কোনো ছাড় নয়। 


এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ বিভাগের উপ সচিব এবং ডিপিডিসি’র পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এরাদুল হক বলেন, দুর্নীতি হলেই ব্যবস্থা। খোঁজ নিয়ে দেখছি। 


এ ব্যাপারে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মোরশেদুল আলম খান বলেন, অল্প সময় হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবন শুরু করেছি। এখনো সবার সম্পর্কে তেমন জানি না। তিনি বলেন, দুর্নীতি হলে অবশ্যই অ্যাকশনে যাবো। 


জেবি/এসবি