বৃষ্টি নামলেই কক্সবাজারে পাহাড় ধস ও জনদূর্ভোগ বাড়ছে
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৬:২৮ অপরাহ্ন, ১২ই জুলাই ২০২৪
বৃষ্টি নামলেই কক্সবাজার যেন হয়ে উঠছে জনদূর্ভোগের নগরী। যেখানে কখনও দেখা যায়নি জলাবদ্ধতা সেখানেও পানিবন্দি পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। আর পাহাড় ধসের ঘটনা বেড়েছে ভয়াবহ। ফলে বৃষ্টি নিয়ে জনমনে বেড়েছে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারি আবহাওয়াবিদ আবদুল হান্নান জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) ভোর ৬ টা থেকে শুক্রবার (১২ জুলাই) ভোর ৬ টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ৩০৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। আগামি আরও একদিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে। এতে পাহাড় ধসের আশংকা রয়েছে।
আর এই বৃষ্টিতে কক্সবাজার জেলাজুড়েই দেখা মিলে জলাবদ্ধতা। যার মধ্যে কক্সবাজার শহর জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। শহরের প্রধান সড়ক, উপসড়ক। বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়েছে ড্রেনের দুর্গন্ধযুক্ত পানি।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মো. মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন, কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কের বাজারঘাটা, এবিসি রোড, এন্ডারসন সড়ক, টেকপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকা, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, গোলদিঘিরপাড়, তারাবনিয়াছড়া, বড়বাজার, সিভিল সার্জন কার্যালয়, কক্সবাজার সরকারি কলেজ, রুমালিয়ারছড়া, কলাতলী হোটেল মোটেল জোন, সৈকতের লাবণী ও সুগন্ধা পয়েন্ট সড়ক ও তার আশে পাশের এলাকার বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার পৌরসভার ১নম্বর ওয়ার্ডের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, বাসিন্যাপাড়া, ফদনারডেইল, নাজিরারটেক এলাকা ডুবে আছে। এসব এলাকায় অন্তত ৫০ হাজার শ্রমজীবী মানুষের বসবাস। বৃষ্টির পানিতে সমিতিপাড়া সড়কটি ডুবে থাকায় মানুষের চরম দুর্ভোগ যাচ্ছে। পৌরসভার ৬, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়তলী, বৈদ্যঘোনা, ঘোনারপাড়া, বাদশাঘোনা, খাজা মঞ্জিল, লাইটহাউস, কলাতলী, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, লারপাড়াসহ কয়েকটি এলাকায় অন্তত ২০টি উপসড়কে পানির নিচে।
আরও পড়ুন: সড়ক দুর্ঘটনায় খালা-ভাগনেসহ প্রাণ হারালেন ৪ জন
তিনি বলেন, সমুদ্র সৈকতের পাশের নালা আবর্জনায় ভর্তি থাকায় পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল ও বৃষ্টির পানি সাগরে নেমে যেতে না পেরে সড়কে উপচে পড়ছে। ফলে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। তাছাড়া কলাতলী সড়ক থেকে সমুদ্রসৈকতে নামার সুগন্ধা সড়কটিও ডুবে আছে। সড়কে হাতে গোনা কয়েকটি মিনিবাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করলেও অলিগলিতে ঢুকতে পারছে না।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র বলেন, ‘গত বুধবার সৈকত সড়কের নালা পরিষ্কারের কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু ভারী বর্ষণ শুরু হওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। বৃষ্টি বন্ধ হলে শহরের নালা পরিষ্কার করা হবে। পাশাপাশি পাহাড় নিধন বন্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হবে।’
কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ.ন.ম হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘শহরের প্রধান সড়ক বহু রাস্তা উুঁচ করে ফেলা হয়েছে। হোটেল-মোটেল জোনে হাঁটু পরিমাণ পানি কেউ কল্পনাই করেনি। নালাগুলো অপরিকল্পিত হওয়ার কারণে জলাবদ্ধতা এখন প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে মোটেল শৈবালের সামনে বড় নালাটা ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এছাড়া পাহাড় ধসের ঘটনাগুলো পুরোটাই প্রশাসনিক ব্যর্থতা। দপ্তরগুলো মানুষ মারা যাওযার পর খোঁজ নেয়, তাদের আগাম প্রস্তুতি নেই।’
আরও পড়ুন: কক্সবাজারে পাহাড়ধসে শিশুসহ নিহত ২
কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম বলেন, ‘শহরের ড্রেনগুলো একেবারে সংকোচিত। ড্রেনগুলো কোথায় ১০ মিটার, কোথাও ৭ মিটার আবার ও কোথায় ৫ মিটার। আবার এসব ড্রেনে ফেলা হয় পলথিন থেকে শুরু করে সকল ময়লা-আবর্জনা। একইভাবে কউক কর্তৃক প্রধান সড়কের ড্রেন নির্মাণ কালের অনেক নির্মান সামগ্রীও রেখে দিয়েছে ঠিদাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে পানি সরতে পারছে না।’
পাহাড় ধস:
গত তিন সপ্তাহে কক্সবাজারে পৃথক পাহাড়ধসের ঘটনায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক দিনে ১০ জনের মৃত্যু হয়। গত বৃহস্পতিবার পাহাড় ধসে মারা গেছে ৩ জন। এছাড়া বৃহস্পতিবার একদিনে কক্সবাজারের ১৫ টি স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে।
এর মধ্যে কলাতলী, আদর্শগ্রাম, লারপাড়া, দরিয়ানগর, হিমছড়ি এলাকায় পাহাড় ধসলেও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. শফীকুল ইসলাম বলেন, ‘বনভুমি উজার, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে গড়ে তোলার কারণে কক্সবাজার জেলার মাটির গঠন বিন্যাসের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। তার ওপর যোগ হয়েছে নির্বিচার পাহাড় কাটা। এসব কারণে পাহাড়গুলো শুকনো ও ঝরঝরে হয়ে উঠছে। যার কারণে বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টির চাপে পাহাড়ের ওপরের অংশের শক্ত মাটির স্তর বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে ফাটল তৈরি হচ্ছে। ফলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে ওজনে বৃদ্ধি পাওয়া মাটি ভারসাম্য রাখতে না পেরে পাহাড় বিরাট খন্ড ও অংশ বিশেষ আকারে ধসে পড়ে।
আরও পড়ুন: লক্ষ্মীপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় অজ্ঞাত নারী নিহত
এদিকে বৃষ্টির কারণে চকরিয়া পেকুয়া, কুতুবদিয়া, রামু, উখিয়া, টেকনাফ এবং কক্সবাজার সদরের নিম্নাঞ্চলের প্লাবিত হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা ত্রাণ ও পূনর্বাসন কর্মকর্তা মো: জাহাঙ্গীর আলম জানান, বন্যায় তাৎক্ষণিক ভাবে সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৮' শ মেট্রিকটন চাল ও নগদ ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডে পাহাড় ধসে নিহত ৩ জনের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। পৌরসভার অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারনে শহরবাসী চরম দূর্ভোগে পড়েছে বলে জানিয়েছেন এ কর্মকর্তা। বাঁকখালি এবং মাতামুহরী নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারজানা রহমান জানান, অব্যাহত বৃষ্টির কারণে ঝিলংজা, খুরুস্কুল, ভারুয়াখালী, পিএমখালীতে বন্যার পানি প্রবেশ করে আশেপাশের এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ঝিলংজার কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। ঝিলংজার চেয়ারম্যান টিপু সুলতান ও ইউপি সদস্যদের নিয়ে বন্যা কবলিত এলাকায় গিয়ে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। সদরের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রবল বৃষ্টির কারণে কক্সবাজার পৌরসভার অধিকাংশ এলাকা বন্যাকবলিত হয়েছে। বৃষ্টির কারণে জল মগ্ন হয়ে পড়েছে পৌর এলাকার বেশিরভাগ ওয়ার্ড। বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে কক্সবাজার জেলা ৭১ ইউনিয়ন ও ৪ পৌরসভার মধ্যে ৩৫ ইউনিয়নে বন্যা হয়েছে। যেখানে গ্রামের সংখ্যা ২ শতাধিক। যেখানে প্রায় ৩৫ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
এর মধ্যে কক্সবাজার সদর উপজেলার ৫ ইউনিয়নের ২০ গ্রাম, ঈদগাও ৫ ইউনিয়নের ১২ গ্রাম, রামু উপজেলার ৬ ইউনিয়নের ২৫ গ্রাম, চকরিয়া উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের ৬০ গ্রাম, পেকুয়া উপজেলার ২ ইউনিয়নের ৬ গ্রাম, মহেশখালী উপজেলার ৬ ইউনিয়নের ১৮ গ্রাম, কুতুবদিয়ায় ১২টি, উখিয়া উপজেলার ৩ ইউনিয়নের ২৪ গ্রাম, টেকনাফ উপজেলার ৪ ইউনিয়নের ২৬ গ্রাম প্লাবিত হওয়ার তথ্য দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
এমএল/