মণিপুরে মেইতেই গোষ্ঠীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের বন্দুকযুদ্ধে ছয়জন নিহত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১০:১০ অপরাহ্ন, ৭ই সেপ্টেম্বর ২০২৪
ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের জিরিবাম জেলায় নতুন এক সহিংসতায় ছয়জন নিহত হয়েছে বলে স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে। শনিবার সকালে ঘটনাটি ঘটে।
শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুসারে, সন্দেহভাজন কুকি বিদ্রোহীরা রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল থেকে ২২৯ কিলোমিটার দূরে জেলার নুংচাপ্পি গ্রামে হামলা চালায়। এতে ইউরেম্বাম কুলেন্দ্র সিং নামে ৬৩ বছর বয়সী এক ব্যক্তি নিহত হন।
মণিপুরে ২০২৩ সালের মে মাস থেকে হিন্দু সংখ্যাগুরু মেইতেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে কুকিদের সংঘাত চলছে। এতে এ পর্যন্ত কত মানুষ মারা গেছে, তা এখন আর নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এই সংখ্যা এখন ৩০০ জনের কাছাকাছি বলে মনে করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের শুরুতে মৃতের সংখ্যা ছিল ২০০ জনের বেশি।
শনিবার সংঘর্ষের সূত্রপাত নিংথেম খুনৌ নামে জিরিবাম সদর শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে এক জায়গায়। এদিন ভোরে সেখানে ঘুমন্ত অবস্থায় ওয়াই কুলাচন্দ্র নামে ৬৩ বছরের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে ওই ব্যক্তির স্ত্রী ওয়াই বেমচা জানান। তিনি বলেন, তিনজন সশস্ত্র সন্ত্রাসী ঘরে ঢুকে তাঁর স্বামীকে গুলি করে পালিয়ে যায়।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাকে নিয়ে ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকার ভালোভাবে নেয়নি ভারত
এরপর নুনচাপি নামে এক জায়গায় স্থানীয় গ্রামরক্ষা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আততায়ীদের বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। মণিপুরের অনেক অঞ্চলের মতোই রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই জাতিগোষ্ঠী–অধ্যুষিত ওই অঞ্চলেও সক্রিয় রয়েছে গ্রামরক্ষা কমিটি। এই কমিটি গ্রামের সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে গঠন করা হলেও এদের অধিকাংশের কাছেই রয়েছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। এসব সদস্যের সঙ্গে সশস্ত্র জঙ্গিদের গোলাগুলি শুরু হয়। এতে অন্তত তিনজন সন্দেহভাজন কুকি জঙ্গি ও গ্রামরক্ষা কমিটির এক মেইতেই সদস্য নিহত হন।
জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে পুলিশের ওপরেও গুলি চালানো হয়েছে।
শনিবার কাকচিং জেলার সুগনুতেও উত্তেজনা বেড়েছে। সেখান থেকেও গুলি ও বোমা হামলার খবর পাওয়া গেছে। তবে এখনো পর্যন্ত কারও মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
রাজধানীর ইম্পলে রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা শাখার মহাপরিচালক কে কাবিব আজ শনিবার বলেছেন, গতকাল সংঘর্ষ হয়েছে মণিপুরের উত্তর অংশের দুই জেলা চুরাচাঁদপুর ও বিষ্ণুপুরের সীমান্ত অঞ্চলে। সেখানে পরিস্থিতি আজও থমথমে। গত ২৪ ঘণ্টায় দক্ষিণ ও পশ্চিম মণিপুরের একাধিক জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে। অনেক জায়গায় সংঘর্ষ এখনো চলছে।
আরও পড়ুন: বিজিবিকে যে অনুরোধ করলো বিএসএফ
পরিস্থিতির পর্যালোচনায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শনিবার তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে একটি বৈঠক করেছেন।
রকেট হামলায় সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে একজন নিহত
এর আগে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের বিষ্ণুপুর জেলায় রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িসহ দুটি স্থানে গতকাল শুক্রবার রকেট হামলা চালিয়েছেন বিদ্রোহীরা। এ ঘটনায় রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে একজন নিহত ও অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন। কয়েক দিন ধরে কয়েক দফায় ড্রোন ব্যবহার করে হামলা চালিয়ে আসছিলেন বিদ্রোহীরা। এর মধ্যে গতকাল প্রথম রকেট হামলা চালানো হলো।
ভারতের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ইতিহাসে আগে কখনো এত ব্যাপক পরিমাণে ড্রোন হামলা চালায়নি কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তবে রকেট হামলা অবশ্য অতীতে হয়েছে।
মণিপুরে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে সংঘাত চলছে। এই জাতিগত সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংঘাত ও সংঘর্ষ মাঝেমধ্যে কিছুটা কমলেও হঠাৎ করেই বেড়ে যাচ্ছে। যেমন গত কয়েক দিনে ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। তারপর গতকাল রকেট হামলা চালানো হলো।
আরও পড়ুন: তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান হতে হবে, কঠোর বার্তা ড. ইউনূসের
মণিপুর পুলিশ জানিয়েছে, গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে স্থানীয়ভাবে তৈরি একটি লঞ্চার ব্যবহার করে ময়রাং শহরে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মাইরেম্বাম কোইরেং সিংয়ের বাড়িতে রকেট হামলা চালানো হয়। রকেটটি সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সীমানায় আঘাত হানে।
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা বলছেন, বাড়ি থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে রকেটটি আছড়ে পড়ে। এ ঘটনায় ৭২ বছর বয়সী কে রাবেই সিং নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর পাঁচ আত্মীয় আহত হয়েছেন।
এর আগে শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) ভোরে বিষ্ণুপুর জেলার ত্রংলাওবি গ্রামে আরও রকেট হামলা চালানো হয়। অবশ্য সেখানে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
কুকি জনগোষ্ঠী-অধ্যুষিত চূড়াচাঁদপুরের পাহাড় থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের কোনো এলাকা থেকে রকেটগুলো ছোড়া হয় বলে জানিয়েছেন এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই প্রথম আমরা মণিপুরে বিদ্রোহীদের নিজেদের তৈরি রকেট হামলা চালাতে দেখলাম। রকেটগুলো মোটামুটি চার ফুট লম্বা।’
রাজ্যে কিছুদিন পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত থাকলেও গত রোববার থেকে উত্তেজনা বেড়ে চলেছে। ড্রোন ও রকেট হামলার পাশাপাশি গুলি চলছে এবং গ্রেনেড হামলা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দূরের গ্রাম থেকে তাঁরা গোলাগুলি ও বোমার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন।
মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং বলেছেন, ড্রোনের ব্যবহার প্রমাণ করে যে রাজ্যে ত্রাসের আবহাওয়া তৈরি হয়েছে এবং সন্ত্রাসী হামলা চলছে।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, নিরাপত্তা বাহিনী উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। উপত্যকার জেলাগুলোর বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের মোতায়েন করা হয়েছে। বিশেষ করে এই মুহূর্তে তারা চূড়াচাঁদপুর সীমান্তবর্তী বিষ্ণুপুর ও কাংপোকপি জেলার সীমান্তবর্তী ইম্ফল থেকে পশ্চিমের দিকে যেতে শুরু করেছে।
বিস্ফোরক বহনকারী ড্রোন ব্যবহার করে আক্রমণের বিষয়টি তদন্তের জন্য পুলিশ, সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই কমিটি সাম্প্রতিক হামলা নিয়ে তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, রকেট হামলার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও এই প্রতিবেদনে থাকবে।
সরকারি দায়িত্বে থাকা বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এবং নিরাপত্তা দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দু-একজন বলেছেন, মণিপুরে পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। কোনোভাবেই রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার আর পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
আরও পড়ুন: হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে হবে, না হলে মানুষ শান্তিতে থাকবে না: ইউনূস
এ অবস্থায় মণিপুরের অখণ্ডতার সমন্বয়কারী কমিটি এবং রাজ্যে মেইতেইদের শীর্ষ সংস্থা ‘কোকোমি’র তরফে এক বিবৃতিতে ইম্ফল উপত্যকার পাঁচটি জেলায় ‘পাবলিক ইমার্জেন্সি’ বা সামগ্রিক ও স্থানীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকার এ রকম কোনো ঘোষণা এখনো দেয়নি।
কোকোমির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জনগণের জীবন রক্ষায় সরকারকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। এবার নিজেদের রক্ষা করার জন্য জনসাধারণকে তাঁদের নিজস্ব পন্থা নির্ধারণ করতে হবে।
ধারণা করা হচ্ছে, এই বিবৃতির মাধ্যমে জনসাধারণকে আবার অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার আবেদন জানাল মেইতেই সমাজের শীর্ষ সংগঠন। এ ঘোষণার ফলে সহিংসতা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
পরিস্থিতির বিচারে মণিপুর সরকার রাজ্যজুড়ে সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ শনিবার থেকে বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় সরকার।
এমএল/