ডিপিডিসির মূর্তমান আতঙ্ক মাফিয়া সাহেদ বিশ্বাস
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ১১:১৯ পূর্বাহ্ন, ২৮শে অক্টোবর ২০২৪
একের পর এক অনিয়ম দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন ডিপিডিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এসি) মোহাম্মদ সাহেদ বিশ্বাস। যে ডিভিশনে চাকরি করেছেন সেখানেই দুর্নীতির রাম রাজত্ব কায়েম করেছেন। গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সিন্ডিকেট। ডিপিডিসির মিটারিং ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর দায়িত্ব যেন তিনি ছাড়তে চান না। প্রকৌশলীদের প্রশ্ন এই চেয়ারে এতো মধু। দীর্ঘ দিন তিনি এই চেয়ারে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে যত দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। তার শান্তি পাচ্ছেন অন্য পদধারী কর্মকর্তারা। সম্প্রতি দুর্নীতির দায়ে এই সিন্ডেকেটের ৪ সদস্যকে বদলি করেছে ডিপিডিসির কর্তৃপক্ষ।
সূত্র বলছে, একই পদে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকায় এই কর্মকর্তার দুর্নীতির নেটওয়ার্ক গভীরে বিস্তার লাভ করেছে। শুধু স্বেচ্ছাচারিতা নয়, ঘুষ না দিলে গ্রাহকদের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার দেখিয়ে টাকা আদায়, নয়-ছয় বুঝিয়ে বাড়তি টাকা নেওয়া ও দুর্ব্যবহার তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ নোমান দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতিমুক্ত ‘স্মার্ট ডিপিডিসি’ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ প্রতিশ্রুতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে চলেছে এই সিন্ডিকেট। বেশ কয়েকজন গ্রাহকের অভিযোগ ডিপিডিসির মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের স্পর্শকাতর এই বিভাগে থেকে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। এই ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগ জমা পড়েছে।
সূত্র বলছে, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাহেদ বিশ্বাসের পছন্দের কোম্পানী হাইটেক পাওয়ার। এই কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোবারক হোসেনের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলে মিটার সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। অভিযোগ রয়েছে এই কোম্পানীর দেওয়া পূর্বাচলে একটি প্লট তার স্ত্রীর নামে করেছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেন। এছাড়া মাঠ পর্যায় থেকে দুই প্রকৌশলী আনোয়ার-পলাশ যে টাকা তুলছেন, সেই টাকার অর্ধেক অংশ এসি সাহেদ বিশ্বাসের পকেটে যেতো। হাইটেক পাওয়ার কোম্পানির নিম্নমানের এইচটি মিটারের দাম ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা, যা বাস্তবে অন্য সব কোম্পানীর এসটি মিটার মূল্য ১ লাখ ৬০ হাজার থেকে ১লাখ ৮০ হাজার টাকা মধ্যে। এলটিসিটি মিটার একই ভাবে মূল্য রাখা হচ্ছে ৭০ হাজার টাকা, যা বাহির থেকে ক্রয় করা যায় ৪০ হাজার টাকা, যাতে গ্রহকের বাঁচবে ২৯ হাজার টাকা। কিন্তু হাইটেক পাওয়ার কোম্পানীর বাইরে গিয়েও অন্য কোম্পানীর মিটার ক্রয় করলে বিভিন্ন ত্রুটি ধরে সাহেদ বিশ্বাস আটকে দেন।
যে সব ত্রুটি ধরা হচ্ছে সে গুলো হলো, মিটারের টেস্ট রিপোর্ট ভালো না সহ নানা বাহানায় মিটার লাগাতে গড়িমসি করেন। এতে করে দিন দিন বাড়ছে গ্রাহক হয়রানি। আবার টাকা ছিলে সমস্যা সমাধান করে দেন প্রকৌশলী সাহেদ বিশ্বাস ও তার সিন্ডিকেট।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাইটেক কোম্পানীর এক কর্মকর্তা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাহেদ বিশ্বাস স্যারের সঙ্গে হাইটেক পাওয়ারের এমডির সঙ্গে স্যারের সম্পর্ক ভালো। প্রতিমাসে সাহেদ স্যারের নামে বরাদ্ধ ১৫ লাখ টাকা। সেই টাকা কোম্পানী থেকে তাকে দেওয়া হয়। তা ছাড়া সাহেদ স্যারের সঙ্গে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর সম্পর্ক খুবই ভালো ছিলো। তাই তাকে কেউ কিছু বলতে পারেন না।
অভিযোগ সূত্র বলছে, প্রকৌশলী সাহেদ বিশ্বাস এর অনিয়ম, সেচ্ছাচারিতা, মিটারিং কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন বাণিজ্য আর সিন্ডিকেট সদস্যদের নিয়ে দুর্নীতির সংবাদ প্রচারিত হলেও এখনো তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। সাহেদ বিশ্বাস পছন্দ মাফিক মিটার কোম্পানীর কাছ থেকে গ্রাহককে বাধ্য হয়েই কিনতে হয় মিটার। আর এই কর্মকর্তার মন জোগাতে ডিপিডিসির ৩৬টি ডিভিশনের (কাস্টমার সার্ভিস) প্রকৌশলীরা বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ঐ মিটার কোম্পানির মিটার কিনতে বাধ্য করে। এভাবেই প্রতি মাসে সাহেদ বিশ্বাস মিটার কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা কমিশন পায়। আর উচ্চচাপ গ্রাহকদের মিটার কেনা থেকে কমিশন পায় প্রতি মাসে ৭/৮ লাখ টাকা।
সম্প্রতি মিটারিং ডিভিশনের ছয় সিন্ডিকেট নিয়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশের পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অনেকটা দায়সাড়া ভাবে চার জনকে বদলি করে। কিন্তু ঐ সিন্ডিকেটের দুর্নীতির মূল হোতা ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুনিম ইসলাম এবং উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেনকে এখনো বদলি করেনি। সূত্র জানায়, এই দুই কর্মকর্তা ডিপিডিসির এক নির্বাহী পরিচালকে তাদের বদলি ঠেকাতে ১০ লাখ টাকা উৎকোচ দেয়। সূত্র জানায়, ঐ নির্বাহী পরিচালকের চাপের মুখে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঐ দুই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
এদিকে মিটারিং ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এসি) মোহাম্মদ সাহেদ বিশ্বাসের বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকান্ডে সংস্থাটির প্রকৌশলী ও অন্যান্য কর্মকর্তারা ক্রদ্ধ রয়েছে। আর অন্যদিকে বিদ্যুৎ গ্রাহকরা মানসম্মত বৈদুত্যিক মিটার কিনতে না পেরে অর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আর অন্যদিকে উচ্চচাপ (এইচটি) বিদ্যুৎ সংযোগগুলো মিটার কমিশন করতে গিয়ে মিটারিং ডিভিশনের প্রকৌশলীরা টাকা না পেলে গ্রাহককে নয়-ছয় করে মিটারগুলো চালু করেনা। এক পর্যায় গ্রাহক বাধ্য হয়েই মিটারিং ডিভিশনের প্রকৌশলীদের ঘুষ দিয়ে সংযোগ নিতে হয়।
সূত্র আরো জানায়, মিটারিং ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এসি) মোহাম্মদ সাহেদ বিশ্বাস প্রতিমাসে মিটার কোম্পানির কাছ থেকে আদায়কৃত কমিশনের টাকা দিতেন সাবেক বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমানকে। আর এই তথ্য নিশ্চিত করেছে মিটারিং ডিভিশনর এক প্রকৌশলী। সেই কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি এইচআর কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে , মিটারিং ডিভিশনের এই কর্মকর্তা বছরের পর বছর একই জায়গায় থেকে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তাই মোহাম্মদ সাহেদ বিশ্বাস যত অনিময়ই করুক না কেনো কর্তৃপক্ষ এগুলো আমলেই নেয়না।
ধরা-ছোয়ার বাহিরে গডফাদার: গ্রাহকের মিটার স্থাপন করতে গেলেই দশ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু বাস্তবে মিটারের টেষ্ট রিপোর্ট সঠিক না, ওয়্যারিং এ সমস্যা আছে, মিটার কার কাছ থেকে নিয়েছেন ইত্যাদি অযুহাতে মিটার চালু করতে গ্রাহককে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দিতে হয়। ইতিমধ্যে কিছু গ্রাহক পলাশ ও আনোয়ারের নামে সাহেদ বিশ্বাসের কাছে অভিযোগ করেও কোন উপকার পায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রাহক বলেন, সাহেদ বিশ্বাসের আচরণ খুবই খারাপ। তিনি নিজেকে মিটারিং দপ্তরের রাজা মনে করেন। এমনি কি তার দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, কি বলব উনি নিজেকে সবজান্তা মনে করেন। কারণ মিটারিং সংক্রান্ত কিছু হলেই সবাই তাকে ফোন করেন এবং ভাল মানুষ মনে করেন। বাস্তবে সাহেদ বিশ্বাস বড় দুর্নীতিবাজ এবং কি কি করেন আমরা জানি। তবে বলতে পারি না। তার আচরণ অশিক্ষিত লোকের মত বলে উল্লেখ্য করেন এই গ্রাহক। সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। এইচটি/এলটিসিটি মিটার বিক্রির টাকা প্রতিদিন পলাশ ও আনোয়ার হিসাব করে সাহেদ বিশ্বাসকে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ দুর্নীতির গডফাদার ধরাছোয়ার বাহিরে থেকে যায়। শাস্তি হচ্ছে সহযোগীদের। এইচটি/এলটি সিটি মিটার নষ্ট/টেম্পারিং ধরা পড়লে জরিমানার ৫০ পার্সেন্ট এ মিমাংসা হয়। মিমাংসা হলে বিল হবে কম। নতুবা ৩ গুন হারে জরিমানা গুনতে হয় গ্রাহকদের।
রাজস্ব হারাচ্ছে ডিপিডিসি: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিপিডিসির ৩৬টি ডিভিশন থেকে বিদ্যুৎ চুরির ঘটনায় জব্দকৃত মিটার টেম্পারিং ও বাইপাস করে বিদ্যুৎ চুরির মিটার জব্দ করে পরীক্ষা করার জন্য মিটারিং ডিভিশনে পাঠানো হয়। জব্দকৃত ওই মিটারে গ্রাহক কী পরিমাণ বিদ্যুৎ চুরি করেছে, তা রিপোর্ট নেওয়ার জন্য পাঠানো হয় মিটারিং ডিভিশনে। এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে গ্রাহকের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়। এ-জাতীয় বেশিরভাগ কাজের জন্য আনোয়ার-পলাশ ওই শ্রেণির গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে রিপোর্ট নয়-ছয় করে দেন। তাতে করে ডিপিডিসি হারাচ্ছে রাজস্ব।
প্রকৌশলীদের টাকায় সাহেদ বিশ্বারে বাসার বাজার: অনিয়ম ও দুর্নীতির মূল হোতা ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুনিম ইসলাম এবং উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন, সাব-ডিভিশনাল (এসডি) প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরী, সহকারী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ আলামিন রুটিন করে মিটারিং বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাহেদ বিশ্বাসের বাসায় বাজার করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিদিনই বাজারের তালিকায় রয়েছে ইলিশ, বোয়াল, আইরসহ সামদ্রিক মাছ। তা ছাড়া গরু ও মুরগি মাংস রয়েছে তালিকায়। মুদি-মনোহারীর বাজার করেন মিটারিং বিভাগের প্রকৌশলীরা।
এ ব্যাপারে হাইটেক পাওয়ারের এমডি মোবারক হোসেনের মুঠো ফোন কল দিলে তিনি ফোন রিসিপ করেননি।
এ ব্যাপারে ডিপিডিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এসি) মোহাম্মদ সাহেদ বিশ্বাস এর মুঠো ফোনে সন্ধ্যা ৬.২৬ মিনিটে কল দিলে তিনি ব্যস্ত আছি, মিটিং করছি বলে কল কেটে দেন।
এ বিষয় ডিপিডিসির জেনারেল ম্যানেজার (আইসিটি অ্যান্ড মিটারিং) মো. রবিউল হাসান বলেন, সাহেদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসছে, সেগুলো আমরা খতিয়ে দেখব। অনিয়ম করলেই ব্যবস্থা।
এ ব্যাপারে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলাম বলেন, অভিযোগ খতিয়ে দেখব। প্রমান পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিবো। তিনি আরো বলেন, নির্ধারিত কোনো কোম্পানীর মিটার ব্যবহার করা হয় কিনা সেটা তদন্ত করা হবে। তিনি অনেকদিন হলো একই দপ্তরে আছেন, সেই বিষয় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করে সিন্ধান্ত নিবো।
এ ব্যাপারে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান বলেন, বিষয়টি দেখা হবে।
জেবি/এসবি