চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক বন্ধত্বের নয়, স্বার্থ ও ভূ-রাজনীতি


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক বন্ধত্বের নয়, স্বার্থ ও ভূ-রাজনীতি

প্রতিকূল আবহাওয়া, জ্বর, সাপের কামড়, মৃত্যুকে জয় করে বাংলার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী প্রাচীন বাংলার শ্রেষ্ঠ  বৌদ্ধ দার্শনিক, প্রখ্যাত মহাপণ্ডিত  ১০৪২ খ্রিষ্টাব্দে দৃঢ় তবে শান্ত পাদবিক্ষেপে হিমালয়ের হীমশীতলতাকে উপেক্ষা করে, মৈনাকগীর পেরিয়ে চীনের তিব্বতের রাজা লহা-লামা-চং-ছুপ এর আমন্ত্রণে পৌঁছালেন চীনের তিব্বত। রাজা ও রাজ্যবাসী ‘রাগদুন’ বাদ্যযন্ত্রের সুরের মূর্ছনার এক মহানুষ্ঠানের মাধ্যমে পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে হো-বো-জে উপাধিতে ভূষিত করেন। যিনি চীনে তিব্বতে প্রচার করলেন বুদ্ধের শান্তি, প্রজ্ঞা, মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষার বাণী। তিনি বাংলার পাল সাম্রাজ্যের, বিক্রমপুরের অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান । রচিত হলো চীন আর বাংলার সম্পর্কের সুত্রপাত বন্ধুত্ব, শান্তি, প্রজ্ঞা, মৈত্রীর। চীন-বাংলাদেশ ঐতিহ্যগত সম্পর্ক হাজার বছর আগের। ২৫০০ বছরেরও বেশি চীন-বাংলার যোগাযোগ ছিল ওল্ড সাউথ সিল্ক রুটের মাধ্যমে। একটি প্রচলিত মত চট্টগ্রাম নামটির উৎপত্তি চীনা শব্দ "শি দা গ্যাং" থেকে যার অর্থ "পশ্চিমের মহান বন্দর"। চীনের মিং রাজবংশের অভিযাত্রী ঝেং হে সাতজন কমান্ড নিয়ে ভারত মহাসাগরে সমুদ্রযাত্রা করে অন্তত দুবার বাংলায় এসেছিলেন। সেই সময় বাংলার বুদ্ধবিহারগুলো বিখ্যাত ছিল বুদ্ধের দর্শন শিক্ষার জন্য। অনেক চীনা ছাত্র প্রকৃত বৌদ্ধ দর্শন শিখতে এদেশে এসেছিলেন। ফা জিয়ান, জুয়ান জাং এবং ই জিং উল্লেখ যোগ্য। ৬৪৮ সালে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর  একজন সাহাবী, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, যিনি চীনে ইসলামের প্রবর্তন করেছিলেন, তিনি ব্রহ্মপুত্র হয়ে বাংলা হয়ে চীন গিয়েছিলেন, যার প্রমাণ লালমনিরহাটে নিজের দ্বারা নির্মিত একটি মসজিদ , যা স্থানীয়ভাবে আবি ওয়াক্কাস মসজিদ নামে পরিচিত।  ১৩শ শতাব্দীতে বাংলায় মুসলমানদের বিজয়ের পর, জেনারেল বখতিয়ার খিলজি তিব্বত আক্রমণ করার চেষ্টা করেন। মিং চীন এবং বাংলার সালতানাত ১৫শতকে এবং সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ মিং রাজবংশে দূত পাঠান ১৪০৫, ১৪০৮ এবং ১৪০৯ সালে । কিন্তু বর্তমানে চীনের বন্ধুত্ব কি আসলে বন্ধুত্ব, না এটি ভূ-রাজনীতির বা অর্থনীতির বা সমুদ্র-রাজনীতি কৌশল বা অংশ? চীনের বন্ধুত্ব কতটুকু আসল আর কতটুকু তার নিজ স্বার্থকে চরিতার্থ করার কৌশল?

‘তথাকথিত বাংলাদেশের’ প্রতি তীব্র ও কর্কশ ভাষায় আক্রমণ চালায় চীন, পাকিস্তানের প্রতি চীনের সমর্থনে নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদে বিতর্কে অংশ নিয়ে ।

“ভারত পাকিস্তানকে বিভক্তি করে ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’ গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে।”- হুয়াং হুয়া অভিযোগ করেন । শুধু তাই নয়, তিনি বিশ্ববাসীর কাছে আহ্বান জানান, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন পাকিস্তানের পাশে থাকে। জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ১৯৩১ সালে অধিকৃত চীনের মানচুকো প্রদেশে জাপান স্বাধীন রাষ্ট্রে গঠনের যে চেষ্টা চালায়, তার সঙ্গে তুলনা করেন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে  চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পাকিস্তানকে, বংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সামরিক সরবরাহ এবং রাজনৈতিক সমর্থন করেছিল এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে বিশ্ব মতামতকে উপেক্ষা করেছিল। প্রতিবেশী ভারতে পালিয়ে আসা এক কোটি শরণার্থীর আর্তনাদ ও যন্ত্রণা না শুনতে চীনের সিসিপি তাদের কান বন্ধ করে রেখেছিল। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘে সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আবেদন করলে চীন স্বতঃস্ফূর্তভাবে দুইবার জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদে ভেটো দেয়। কিন্তু তখন বাংলাদেশের ভারতীয় শরণার্থী শিবির থেকে প্রত্যাবর্তনকারীদের পুনর্বাসনের জন্য আন্তর্জাতিক খাদ্য সহায়তা এবং বাজেটের প্রয়োজন ছিল। জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে চীনা নেতারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তার অনুরোধ শুনবেন। অবশেষে, চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু শেখ মুজিবের নির্বাচিত সরকারকে নয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার পরিবারের সকলের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর। ‘এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষায় এক অভূতপূর্ব সাফল্য সাধিত হয়েছে’। (১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর চীনের মন্তব্য)।

বর্তমানে চীন বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিচ্ছে কারণ বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের পাশে হওয়ায় বাংলাদেশ ভারত মহাসাগরে সহজে প্রবেশাধিকারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী এবং বঙ্গোপসাগরের কাছে একটি বড় সামরিক ঘাঁটি তৈরিতে সহায়তা করছে। ২০১১ সালে সরবরাহ করা সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেমের জন্য চীন বাংলাদেশে একটি রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধা স্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশ ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সমস্ত চীনা সামরিক রপ্তানির প্রায় ১৭% সংগ্রহ করেছে। ২০১৬ সালে, বাংলাদেশ তার নৌশক্তি বৃদ্ধির জন্য চীন থেকে ২০৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে দুটি সাবমেরিন কিনেছে। দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক পারস্পরিক সম্পর্কের একটি বড় শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চীনই একমাত্র দেশ যার সাথে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনী ট্যাংক, মিসাইল লঞ্চার, ফাইটার এয়ারক্রাফট এবং বেশ কিছু অস্ত্র সিস্টেম সহ চীনা অস্ত্রে সজ্জিত। এছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে চীন। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যাবাসিত অফিসারদের অন্তর্ভুক্ত করেছিল যারা চীনা অস্ত্রের সাথে পরিচিত ছিল। চীনা অস্ত্রের সাথে এই পরিচিতির কারণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চীন থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে পছন্দ করে। চীনা অস্ত্রের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা সেনাবাহিনীকে প্রতিরক্ষা সম্পর্কের চীনের প্রধান সমর্থক করে তুলেছে। তবে ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা স্থাপন এবং বাংলাদেশের সাথে চীনের অন্যান্য সামরিক কর্মযজ্ঞ, চীন কর্তৃক ভারতের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ । বেইজিং ভারতকে একটি শক্তিশালী ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বাংলাদেশ এখন চীনা কক্ষপথে চলে এসেছে।

বাংলাদেশের জন্য, চীনা বিনিয়োগ লাভজনক, কারণ অবকাঠামো উন্নয়ন । বাংলাদেশ ২০৪০ সালের মধ্যে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। বর্তমানে ১০ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়ে চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। চীন বাংলাদেশে সেতু, রাস্তা, রেলপথ, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি জিনপিংয়ের সফরের সময়, চীন বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। উন্নয়ন অংশীদারিত্বের মাধ্যমে চীন নিজেকে বাংলাদেশের জনগণের মঙ্গল ও দেশের অগ্রগতি কামনা করে এমন বন্ধু হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। চীন বুদ্ধিমত্তার সাথে তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য বাংলাদেশকে সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ রিজিওনাল কো-অপারেশনে একটি পর্যবেক্ষক হিসেবে তার প্রবেশকে সমর্থন করে এবং ঢাকাকে বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ -এ যোগ দিতে রাজি করায়। চীন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের চীনে পড়ার জন্য বৃত্তি প্রদান করছে এবং বাংলাদেশীদের চীনা ভাষা শিখতে উৎসাহিত করছে। চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের বৃদ্ধির অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, চীন বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে জনসমক্ষে মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকে চীন দক্ষতার সঙ্গে বাংলাদেশে একটি ধারণা তৈরি করেছে যে তারা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ এবং অ-হস্তক্ষেপ করছে। বাংলাদেশের বন্দরগুলি চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ চীনের শক্তি বজায় রাখার জন্য মালাক্কা প্রণালীর উপর নির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশের বন্দরগুলো লাভজনক বিকল্প পথ। চীনের ইউনান প্রদেশের সাথে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে, এর বন্দরগুলিতে সহজেই জ্বালানি সংস্থান সরবরাহ করা যায়।

পরিশেষে বলা যায়, আসলে চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি আদৌ বদলায়নি। ভারত-মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বেইজিংয়ের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য চীন বাংলাদেশকে কেবল একটি মঞ্চ হিসেবে দেখে। বাংলাদেশে চীনের স্বার্থ হলোঃ রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খর্ব করার জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় একটি কৌশলগত অবস্থান তৈরি করা। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ভারতের সকল স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াই করা। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ। চীন সমুদ্রপথে বিশেষ করে মালাক্কা ও হরমুজ প্রণালী, ওভারল্যান্ড বাণিজ্য রুট প্রতিষ্ঠা করে "সামুদ্রিক সিল্ক রোড" পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, যা চীনকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্ত এবং উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে সহযোগিতার প্রসার ঘটাতে সাহায্য করবে। চীন বাংলাদেশকে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক প্রসারিত করার বিকল্প মাধ্যম হিসেবে দেখে। সর্বশেষ চীন তার বিশাল বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বজায় রাখার জন্য তার রপ্তানি পণ্যের বাজার হিসেবে বাংলাদেশকে দেখে। 

লেখক: অভিজিৎ বড়ুয়া অভি।

এসএ/