২২ হাজার কোটি লোপাট হুন্ডিতে করে দুবাই পাঁচার


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ১১:৫৫ পূর্বাহ্ন, ১৭ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫


২২ হাজার কোটি লোপাট হুন্ডিতে করে দুবাই পাঁচার
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

# প্রকল্পের আওতায় স্কোপে টুইন টাওয়ারের মধ্যে বঙ্গবন্ধু যাদুঘর, হাতিরঝিলে

৫ তারকা হোটেলে সংস্থান ছিল যা বিদ্যুৎ বিতরণের সাথে সম্পর্কিত নয়

# প্রকল্পে পিডি’র হাতে আলাদীনের চেরাগ

# বিপু’র আশির্বাদে এমডি হয়েছে পিডিরা

# তদন্তে মাঠে দুদক, ব্যয়বহুল প্রকল্প

# ৪০ টি উপকেন্দ্র সক্ষমতা মাত্র ১০%

# দুর্নীতিবাজরা ১২ কোটি টাকা হরিলুট

# ব্যবস্থা নিতে হবে

- ড. ইকবাল মাহমুদ সাবেক চেয়ারম্যান, দুদক 

# নিমূল করা কঠিন

- ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি


শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তার তত্ত্বাবধানে গত ১৭ বছরে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি খাতের বিপুল অর্থ ডাকাতির তথ্য-প্রমাণ সামনে আসছে। এর মধ্যে অন্যতম বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত। এই বিভাগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যয়বহুল একটি প্রকল্প জিটুজি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লিমিটেড। অভিযোগ উঠেছে, বড় অংকের এই প্রকল্প থেকে সরকার প্রধান থেকে শুরু করে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) পর্যন্ত লোপাট করেছে ২২ হাজার কোটি টাকা। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর একে একে বেরিয়ে আসছে জিটুজি প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র। সেই দুর্নীতির টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পাচারের তথ্যও পাওয়া গেছে।


দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বিভিন্ন সংস্থার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ এ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি দায়িত্বে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাগজে-কলমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে তিনি থাকলেও হাসিনার দোসর হিসেবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। সূত্র জানিয়েছে, মাথার ওপর শেখ হাসিনার আশির্বাদ নিয়ে প্রতিমন্ত্রী বিপুর নেতৃত্বে প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে।


প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, জিটুজি প্রকল্পে যে যখন পিডি হিসেবে ছিলেন স্বল্প সময়ের মধ্যেই হাতে আলাদীনের চেরাগ পাওয়ার মত ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। পরবর্তীতে তারা পেয়েছেন ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ। এর পরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। এই চক্রের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নসরুল হামিদ বিপু দুবাইতে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য গড়েছে বলে তথ্য পেয়েছে দুদক। 


দুদক সূত্র জানিয়েছে, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও আওয়ামী পরিবারের লোকজন ডিপিডিসিতে অপ্রয়োজনীয় ও বাস্তবতাবর্জিত প্রকল্প যেমন পিডিএসডি, এএমআই, এক্সপানশন এন্ড স্ট্রেন্দেনিং অব পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্ক (জিটুজি) প্রকল্প গ্রহণ। সম্প্রতি দুবাইয়ে অবস্থানরত সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর কাছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছে ডিপিডিসির দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ডিপিডিসি থেকে এক্সপানশন এন্ড স্ট্রেন্দেনিং অব পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্ক (জিটুজি) প্রকল্পের লোকাল এজেন্ট ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা প্রতি মাসে দুবাইতে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।


অভিযোগ সূত্র বলছে, জিটুজি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পটি প্রণয়ন ও অনুমোদনের ক্ষেত্রে কাজ করেছেন ডিপিডিসির কিছু কর্মকর্তা। এদের মধ্যে ভূমিকা পালন করেছেন সাবেক প্রধান প্রকৌশলী দিলীপ সেন, সিরাজউদ্দৌলা ও প্রকল্প পরিচালক ফজিলাতুন্নেসা যিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ডিজাইন) ও প্রধান প্রকৌশলী (পিএন্ডডি), নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিবুল হাদী, এক সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এছাড়া সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর লোকাল এজেন্টও এই প্রকল্প গ্রহণের পেছনে জড়িত ছিলেন। 


বিদ্যুৎ খাত সূত্রে জানা গেছে, জিটুজি প্রকল্প থেকে বর্তমানে যে সকল উপকেন্দ্র চালু করা হয়েছে তাদের মোট সক্ষমতা মাত্র ১০% ব্যবহার হচ্ছে। জিটুজি প্রকল্পের মাধ্যমে যে ৪০ টি উপকেন্দ্র চালু হবে তার সম্পূর্ণ ব্যবহার ভবিষ্যতে সম্ভবপর হবে না। এই প্রকল্পের জন্য ইউরোপ থেকে ক্যাবল ও লিফট ক্রয়ের কথা। কিন্তু চায়না থেকে আনা হয়েছে। তবে সেগুলোর মূল্য সমন্বয় করা হয়নি। অথচ ইউরোপের তুলনায় চায়নার যন্ত্রপাতির মূল্য ২০-৩০% কম। এর ফলে ডিপিডিসি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য নিয়োগকৃত পরামর্শক হিফাব এই মালামাল সমূহ তার অগোচরে আনা হয়। তিনিও এটি গ্রহণ করতে  অনিহা প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে এ মালামাল গ্রহণ না করায় ফজিলাতুন্নেসাকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি প্রধানের সুপারিশে পরবর্তীতে মালামাল গ্রহণ করা হয়। তখনকার সময় ফজিলাতুন্নেসা প্লানিং এর ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বে ছিলেন। তার সুপারিশের কারণে পুরষ্কার হিসেবে সাবেক বিদ্যুৎ সচিব হাবিব রহমান ও সাবেক এমডি পুরস্কার হিসেবে অনেক সিনিয়র কর্মকর্তাদের ডিঙ্গিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব ভাগিয়ে নেন। তারপর আর ফজিলাতুন্নেসাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি চলেন দামি গাড়িতে। থাকেন আলিশান বাড়িতে। এ ছাড়াও তার নামে রয়েছে একাধিক বাড়ি ও গাড়ি। তার ব্যাংক হিসেব খুঁজলেই বের হবে তার অবৈধ লেনদেন।  


এদিকে, জিটুজি প্রকল্পের আওতায় স্কোপে টুইন টাওয়ারের মধ্যে বঙ্গবন্ধু যাদুঘর, হাতিরঝিলে ৫ তারকা হোটেল এর সংস্থান ছিল যা বিদ্যুৎ বিতরণের সাথে সম্পর্কিত নয়। প্রকল্পে বিভিন্ন কাজে সাব-কন্ট্রাক্টর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আওয়ামী ঘরানার লোকদের। প্রকল্পের লোকাল এজেন্ট ও  প্রকল্প পরিচালক ফজিলাতুন্নেসা, নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিবুল হাদী ও সাবেক প্রকল্প পরিচালকরা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দুবাইয়ে পাচার করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। নির্বাহী প্রকৌশলী মশিউর রহমান জড়িত ছিলেন। সূত্র বলছে, ৪৩ তম শিপমেন্টের ক্ষেত্রে জার্মানির পরিবর্তে চায়না থেকে রিপ্যাকেজিং করে মালামাল শিপমেন্ট করা হয়েছে। জিটুজি প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাজিবুল হাদী ও অপর আরেক নিবাহী প্রকৌশলী মশিউর রহমানের মাধ্যমে পিএলআই করে সেই মালামালসমূহ গ্রহণ করা হয়েছে। এভাবে ৬০ কোটি টাকার মালামাল জার্মানির পরিবর্তে চায়না থেকে আনা হয়েছে। সাধারণত চায়নার মালামাল এর মূল্য ইউরোপ (জার্মানি) এর মালামালের চেয়ে ২০-৩০% কম হয় বিধায় প্রকল্পের ওই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা প্রায় ১২ কোটি টাকা হরিলুট করে নিয়ে যায়। 


এ বিষয় প্রকল্প পরিচালক ফজিলাতুন্নেসাকে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও উত্তর মেলেনি। এমনকি তিনি বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে হুমকি ধামকি দিয়েছেন। যাতে নিউজ প্রকাশ না করা হয়। 

   

এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতিবাজরা যতই ক্ষমতাধর হউক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।  


এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দুর্নীতিবাজরা সক্রিয় থাকে। তাই তাদের নিমূল করা কঠিন। তবে দিন দিনে বাড়ছে দুর্নীতি। 


আরএক্স/