প্রবেশপত্রের সাগরে এক নুড়ি পাথর সরকারি চাকরি


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


প্রবেশপত্রের সাগরে এক নুড়ি পাথর সরকারি চাকরি

আব্দুল্লাহ আল দেলোয়ার হোসেন: শুরুতেই বলে রাখি, নিজেকে মেধাবী প্রমাণ করতে নয়, বরং আমার গল্প শুনে যদি কেউ উৎসাহী হয়ে ভালো কিছু করতে চেষ্টা করে তবেই আমার লেখা গল্প সার্থক। ছবরি ক্যাপশন দেখে হয়তো অনেকেই বুঝে গেছেন গল্পটা আসলে কি?

এবার আসি মূল গল্পে, সময়টা ২০১৯ তখন আমি North Bengal Institute of technology তে একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের পেশাগত জীবন শুরু করি। অবশ্য তার আগে কিছু দিন আমার শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ মহোদয় স্যারের সার্ভে কোম্পানিতে আনঅফিশিয়ালি সার্ভে কাজ করেছি। যাই হোক ছাত্রদের পড়াতে খুব মজা লাগছিলো কারণ ছোটবেলা থেকেই অনেকটা স্বপ্ন ছিলো বড় হয়ে শিক্ষক হব। অবশ্য শিক্ষার্থীরা ও আমার ক্লাস করতে অনেক মজা পেত, কারণ আমি ওদের মন কি চাইতো সহজেই বুঝতে পারতাম। কি ভাবে পড়ালে বুঝতে পারবে সেটা সবসময় মাথায় রাখতাম। যেহুত আমার একাডেমিক সিলেবাসে খুব একটা ঘাটতি ছিলো না তাই ওরা যেভাবে চাইতে সেভাবে পড়া তাম।আর ঘাটতি  থাকবেই বা কেন? কারণ তার কিছু দিন আগেই দীর্ঘ ১৮ মাস এক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছি। যদিও সেই যুদ্ধে কাঙ্খিত সাফল্য লাভ করতে পারিনি। তবে যা পেয়েছি তা নিয়েই আজকের গল্প।

যেহেতু টার্গেট ছিলো সরকারি চাকরি তাই সুযোগ পেলেই যে কোন নিয়েগে প্রায় আবেদন করতাম হোক না সেটা একজনের পোস্ট। চাকরির পাশাপাশি নিজেও চাকরির জন্য পড়তাম ছাত্রদেরও পড়াতাম। হঠাৎ LGED-263, DM-172, HED-172 নিয়োগ আসলো ঠিক সেই সময়ে আমি ক্লিনিকে ভর্তি কারণ আমার HBAG  হয়েছিলো। একই দিনে আমার BBA চাকরির পরিক্ষাও ছিল দিতে পারিনি। খুব খারাপ লেগেছিল কারণ টানা ২২ দিন আমি কোনকিছু খেতে পারিনি, সোজা দাড়াতে পারিনি, কোনটা সকাল কোনটা বিকাল বুঝতেও পারতাম না। একদম মুমূর্ষু অবস্থা, বাসায় কান্নাকাটির রোল পড়ে গেছে। মনে মনে ভাবছিলাম আমি হয়তো আর কোন দিন ঘুরে দাড়াতে পারবো না, এমনকি বাঁচবোও না। কারণটা হলো একই রোগে আমরা বাবাকে হারিয়েছি। যাইহোক মহান আল্লাহ তায়ালা সুস্থ করে দিলেন।

এবার পড়াশোনা খুব মনোযোগ দিলাম। ২৪, ২৬ জুলাই -২০১৯ প্রিলি পরিক্ষার তারিখ ঠিক হল এবং ২৪ জুলাই থেকেই আমার কলেজে পরিক্ষা শুরু হল, এখন পরিক্ষার ডিউটি করতে হবে আমাকে পরিক্ষা দিতে দিবে না। অবশ্য শুধু আমাকে না আমার সব সহকর্মীরায় পরিক্ষা দিতে যাবে, আর সবাই চাকরির পরিক্ষা দিতে গেলে ছাত্রদের পরিক্ষা কে নিবে? তাই সিদ্ধান্ত হলো চাকরির পরিক্ষা দিতে গেলে চাকরি ছেড়ে চলে যেতে হবে।এমন কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো!

সামনে কুরবানির ঈদ বেতন, বোনাস, সাথে মিডটার্ম পরিক্ষার ডিউটি ও খাতা কেটেছি সব মিলে মোটা অংকের টাকা পাব। যেই টাকা দিয়ে মা, ভাই, বোন, দুলাভাইসহ সবাইকে ঈদের নতুন জামা কিনে দিব আরো কত পরিকল্পনা ছিল। এখন ভাবসি এভাবে চাকরি ছেড়ে চলে গেলে কোন টাকায় পাবোনা আর এসব ভাবতেই চোখে জল ছলছল করে মাটিতে পড়তে লাগলো। আবার ভাবছি এত বড় নিয়োগ সামান্য কিছু টাকা আর সাময়িক আনন্দের জন্য মিস করা ঠিক হবে না। শুরু হলো জীবনের ত্যাগ স্বীকার ও রিক্স নেওয়া। কারণ চাকরির পরিক্ষায় পাশ করবো কিনা জানিনা। এদিকে এতগুলো কষ্টের টাকা হাতছাড়া। অবশ্য পরে কিছু টাকা আমি পেয়েছিলাম। আমার একাডেমিক শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ করে অবশেষে ঝাঁপিয়ে পড়লাম জীবন নামের যুদ্ধে।

যাইহোক চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরিক্ষা ২ টা দিলাম। প্রিলিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো হল। বাসায় ফিরে ৩ দিন সময় কাটালাম। মা একদিন বললো কিরে বাবা তোমার অফিস যাবে না? আর কত ছুটি কাটাবা?

এদিকে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি মা কে বলতে পারছি না।কারণ বললে কষ্ট পাবে।  তাছাড়া এবার ঈদের প্লান মা কে অলরেডি বলেছি। মা কে বললাম,মা আমি ঢাকায় একটা ভালো কলেজে চাকরির সুযোগ পেয়েছি ওখানে যাবো দেখা করতে। ওরা ৪ মাস আগে ট্রেনিং করাবে তারপর ভালো বেতন দিবে। মিথ্যা বলেছিলাম, যদিও সেই কেলেজে Institute of science trade and technology.  আমি আগে জবের অফার পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সুযোগ নেই। মা বললেন, যা ভালো হয় তাই কর। ছোটবেলা থেকেই মা বাবা ভাই আমার সিদ্ধান্তকে কোনদিন না করেনি, আর আমিও তাদের অসম্মান হয় এমন কাজ আজও করিনি। তাদের মনে এই বিশ্বাস ছিলো যে, তাদের সন্তান কোনদিন খারাপ কাজ করবে না। আজও সেই বিশ্বাস আছে। 

পরের দিন বুকভরা আশা আর দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমালাম সেই যুদ্ধ ক্ষেত্র গাজীপুরে মাত্র ২০ হাজার টাকা নিয়ে। ১০ দিন পর কুরবানির ঈদ। ঈদের ৩ দিন আগে মা ফোন করে বললো বাবা বাড়িতে কবে আসবা। আমি অনেকক্ষণ নির্বাক থেকে বললাম ঈদে ছুটি নাই এখনো ট্রেনিং শেষ হয়নি। মা আর কিছু বললেন না। ঈদের আগের রাতে ফোন দিয়ে বললো অফিস থেকে গরু কিনছে কিনা? ঈদের বাজার করছে কিনা? আমি ঈদের জামা কিনছি কিনা? আরো অনেক কিছু। আমি কিছু বলতে পারিনি শুধু হ্যা হ্যা করেছি। আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ঈদের দিন সকাল ৯ টায় মা ফোন দিলেন কি করসি? কি খাইছি? আমি বললাম অনেক কিছু খেয়েছি। আসলে খাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা হয়নি, আমি মেসের সবাইকে বলেছিলাম ঈদে বাড়ি যাবো না কারণ ঈদের পর রিটেন পরিক্ষা হবে। তাই আমার সাথে অনেকেই ঈদে মেসে ছিল তাদেরও পরিক্ষা ছিল তাই। প্রায় ১৫ জন হবে তাছাড়া মেস মালিক ও ঈদ এবার এখানেই করছেন কুরবানির মাংস খাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা হয়নি। 

আপু খালা সহ গ্রামের বন্ধুরা ফোন করতে লাগলো কিরে তুই কই? আমি কারো কোন কথার উত্তর না দিয়ে ফোন বন্ধ করে রাখলাম। জীবনে প্রথমবার ঈদের দিনে ৮ ঘন্টা পড়ালেখা করলাম। প্রিলির রেজাল্ট হলো ২টা পরিক্ষাতেই পাশ করলাম। রিটেন পরিক্ষার জন আরো মনোযোগ দিলাম। পিএসসি নন ক্যাডর বই অর্ধেকের বেশী পড়লাম। দেখতে দেখতে রিটেন পরিক্ষা ২টাই হলো। এদিকে ৪ মাস চলে গেছে টাকও শেষ। আর বসে থাকা যায় না এবার ২য় কর্মস্থলে যোগ দিলাম। হযরত ফাতেমা (রাঃ) মহিলা মাদরাসায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম। ইংরেজি আর অংক ক্লাস নিতে হবে। ক্লাসে অল্প দিনেই শিক্ষার্থীসহ সকল হুজুরদের মনজয় করলাম। পাশাপাশি ২টা টিউশনিও শুরু করলাম আবারো ভালো  উপার্জন করতে লাগলাম। কিন্তু বেশি দিন স্হায়ী হলো না। পরিক্ষা হয়ে মাদরাসা বন্ধ হলো বেতন ও বন্ধ। 

জমানো টাকা আর কয়দিন চলে? এদিকে সফলতা কি এতোই সহজ যে চাইলেই পাওয়া যায়। এ সময়ের মাঝে আরো অনেক চাকুরির পরিক্ষা দিলাম কোনটাতেও নাম আসছিলা।বারবার ফেল ফেল আর ফেল। মনে মনে ভেঙে পড়তে লাগলাম আমার দারদ হবে না। এদিকে টাকার কথাও বাসায় বলতে পারিনা। নিজেও না চলার মতো এক অবস্থা দাড়ালো। অনেক বড় ভাই, বন্ধু, রুমমেট, স্যার মানসিকভাবে সাপোর্ট দিতে লাগলেন। অনেকে আর্থিক ভাবে টাকা ধার দিয়েছেন যাদেরকে কোনদিন ভুলবো না। উনাদের নিয়ে একদিন লিখবো ইনস আল্লাহ। এমনিতে লেখা অনেক দীর্ঘ হচ্ছে। এমন করুন অবস্থার মাঝে রিটার্ন পরিক্ষার রেজাল্ট হলো ২ টাতেই নাম আসলোHED প্রিলি পরিক্ষা হলো।মনে আশার আলো সঞ্চার হলো। LGED ভাইভার ডেট হলো ভাইভা পরিক্ষা ভালো হলো। যদিও এর আগে EGCB,BWDB,SGFL. ভাইভা পরিক্ষায় নাম না আসাতে খুবই হতাশায় দিন পারকরছিলাম। এদিকে পিএসসি’র ভাইভা পর রেজাল্ট হবে আশায় আশায় দিন পার করতে লাগলাম। হঠাৎ সেই আশা নিরাশা হয়ে গেলো।শুনলাম রিট হয়েছে, আর এই রিট জীবন তামা তামা করে দিলো। যাই হোক এ যেন শেষ হয়েও হয়না শেষ। এখন কি করবো কি হবে কিছু বুঝতে পারছি না।

হঠাৎ আমার সেই ঢাকার কলেজ Institute of science trade and technology আবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখেই পুরাতন এক স্যারের নাম্বার ছিলো উনাকে ফোন দিলাম।উনি আমার কথা শুনেই বললেন আপনি আগামীকাল থেকেই জয়েন করতে পারবেন কোন সমস্যা নেই। যাই হোক জয়েন করলাম নতুন পরিবেশ, সাজানো ক্যাম্পাস, সাথে ২টা ইউনিভার্সিটি ভালোই লাগছিল।কিন্তু কি আর বলবো সুখের দিন নাকি বেশি স্হায়ী হয়না। শুরু হল করোনার থাবা। তাও ভালোই চলছিলো হঠাৎ এমডি স্যার মারা যাওয়াতে কলেজে বেতন বন্ধ হয়ে গেল। আবারো কষ্ট করে দিন পার করতে লাগলাম। অবশেষে আর পারলাম না। ভাবিলাম শিক্ষকতা পেশায় বাদ দিব।

আমার এক বাল্যবন্ধুর কাছে অটোক্যাড (বিল্ডিং গ্রাফিক্স ডিজাইন) প্রফেশনালি শিখতে শুরু করলাম। মাত্র ৭ দিনে 2D শেষ করলাম। এবার 3D পালা। ওরে বাবা কি বলবো 3D তে এত কাজ দেখেই ভালো লাগছিল কিন্তু এত জটিল আমার জানা ছিলোনা। ভাবলাম এটা আমার দারা হবেনা। সারারাত কাজ করে বন্ধুর সহযোগিতায় 3D মোটামুটি শিখে ফেললাম। বিভিন্ন কোম্পানিতে সিভি দিতে লাগলাম। অবশেষে এক কোম্পানির স্বয়ং এমডি একটা চাকরি দেয়ার আশ্বাস দিলেন। তবে সেটা কবে কে জানে?

আকিজ গ্রুপে একটা সাইট ইন্জিনিয়া পোস্টে ভাইভা দিলাম। অতি ফরলাম ড্রেসআপ আর সিভি দেখে বললেন স্যার আপনিতো একজন শিক্ষক,  ছায়ায় বসে ক্লাস নেন। আপনি রোদে এসব চাকরি করতে পারবেন না। আপনি অন্য চাকরি দেখুন, আমরা শারিরীক পরিশ্রম করতে পারে এমন মানুষ খুজতেছি। যাই হোক মন খারাপ করে চলে আসালাম।

এখন আর অটোক্যাডের কাজও ভালো লাগছে না। গাজিপুর একটা ফার্মে ক্যার্ডের অফিসিয়াল ভাইভা দিলাম। তিনি বললেন আপনাকে আমাদরে পছন্দ কিন্তু আপনার ৫+ বছর এখানে জব করতে হবে। আর আপনার সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে। আমি কোন কিছু না বলে চলে আসলাম উত্তরায়। সারাদিন খাওয়া নাই। আর চৌরাস্তা টু আব্দুল্লাহপুরের জ্যামে জীবন শেষ। সারা রাত আর ঘুৃম হল না।পরের দিনও একই অবস্থা চিন্তায় ঘুম নাই আর খাওয়ার ইচ্ছেও করেনা। এর মধ্যে হঠাৎ শুনলাম রেজাল্ট হবে। কিসের রেজাল্ট টানা ৩ দিন রেজাল্টের নামে নাটক চললো সাথে খাওয়া ও ঘুমহীন রাত পার করতে লাগলাম। এভাবে  চলার পর ৮ জুন ২০২১ সন্ধায় রেজাল্ট হল।এক রুমমেট ছোট ভাই বললো ভাই LGED ফাইনাল রেজাল্ট হলো আপনার কি অবস্থা? এতো নিঃশব্দ হয়ে গেলাম। সেদিন ২ টা ছোট ভাই নিয়ে উত্তরা দিয়া বাড়ি ঘুরতে বের হয়ছি। মনের অবস্থা এমনতেই ভালো না। ভাবলাম মনটা হালকা করে আবার কাজ শিখবো। ছোট ভাইয়ের ফোন নিয়ে রেজাল্ট চেক করতে লাগলাম দেখি লিস্টে আমার নাম নেই। যাই হোক আবারো রেজাল্ট দেখতে লাগলাম ২য় নিজের রেজিষ্ট্রেশন নম্বর চোখে পড়লো।নিজের চোখকেই যেন আজ বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আনন্দে চোখ দিয়ে অঝরে বৃষ্টি নামতে লাগলো। প্রমথে মা'কে ফোন করলাম রেজাল্ট শুনে মা ও কাঁদতে লাগলো এবার ভাইয়ের সাথে কথর বলাতে ভাই ও কাঁদলো। এক এক করে বোন দুলাভাই, খালা, খালু সবাই ২য় বার আমার জন্য কান্না করলো। এ কান্না সুখের কান্না।এদিকে আমার auto CAD. চাকরির জন্য সেই এসডি স্যার ডাকলেন। আমার কলেজও আবার চালু হলো।আমি আর কোন দিকেও গেলাম না।বাড়ি ফিরলাম হাতে মিষ্টি নিয়ে।

এর মাঝে DM. ভাইভা হলো এখানে EEDতে আবারো সুপারিশ প্রাপ্ত হলাম।যেই ২ চাকরির পরিক্ষার জন্য জীবনের ১ম রিক্স ও ত্যাগ স্বিকার করেছিলাম। আল্লাহর রহমতে ২টাতেই সফল। আরো ২ টা ভাইভা দেয়ানি। তবে বলে রাখি আজ পর্যন্ত ৫০+ চাকরির আবেদন করেছি। তবে আশা হারায়নি। এতো গেল কেবল প্রফেশনাল লাইফের কথা পারিবারিক,  একাডেমিক, হোস্টেল, সংগ্রামী জীবন, নিয়েও আরো অনেক কথা অধরায় রয়