পদ্মা সংযুক্ত ৮৫ নদী পানি শূন্য


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


পদ্মা সংযুক্ত ৮৫ নদী পানি শূন্য

গুরুদাসপুর প্রতিনিধি: তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যুমুনা’।এই শ্লোগানই ছিল বাঙ্গলা দেশের ঠিকানা বা পরিচিতি। সেই ঠিকানার একটি প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে নিজ অস্তিত্ত্ব হারিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই।এক সময়ের কুল কিনারহীন পদ্মা নদির নদীর বুকে জেগে ঊঠেছে বড় বড় চর। সেই সাথে পদ্মার সাথে সংযুক্ত প্রধান শাখা-প্রশাখা নদী বড়াল, আত্রাই ও গড়াইসহ অন্তত ৮৫টি নদী পানিশুন্য হয়ে পড়েছে। শুকনো নদ-নদীতে চাষ হচ্ছে বোরো ধান। এসব নদীতে পানি না থাকায় মৎস্যজীবীরা বেকার হয়ে পড়েছে।

অপরদিকে এ অঞ্চলে দ্রুত নিচে নামছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর। আগামীতে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।নাটোর,সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার চলনবিলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ২২টি নদী এবং শতাধিক জোলা খাল সবগুলোর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় একদিকে মৎস্যজীবীরা বেকার হয়েছেন, পরদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক নেমে যাচ্ছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি জমিতে সেচ কার্যক্রম।

এছাড়া যমুনা, পদ্মা, আত্রাই, বড়াল, নন্দকুঁজা, গুমানী, ভদ্রাবতী মুসাখাঁনসহ অন্যান্য নদীর কোলের (নদীর যেখানে গভীর পানি থাকে) পানি শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিলে ৮টি উপজেলা নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রামের প্রায় ১৫ হাজার, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুরা, ফরিদপুর উপজেলার প্রায় ১৪ হাজার, এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, শাহজাদপুর এবং উল্লাপাড়া উপজেলার ১১ হাজার মৎস্যজীবী বেকার হয়ে পড়েছেন। নাটোর, পাবনা, এবং সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে এতথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

তবে সূত্রমতে, যারা মুসলিম সম্প্রদায়ের জেলে তারা বর্ষা মৌসমের ৪-৫ মাস মাছ শিকারের পরে খরা মৌসমে অন্য পেশার কাজ-কর্ম করতে পারে। হিন্দু সম্প্রদায়ের জেলেরা তারা বেশির ভাগ লোকই বেকার হয়ে পড়েন।

সিংড়া উপজেলার সেরকোল শ্রীরামপুর জেলে পাড়ার বারু হাওলাদার জানান, প্রত্যেক বছর জানুয়ারি মাসে নদীর পানি কমে গেলেও নদীর (কোল বা দহ) পানি তেমন একটা কমে না। কিন্তু এ বছর জানুয়ারির শুরুতেই পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই সব জায়গার পানিও প্রায় শুকিয়ে গেছে। তারা নদীগুলো সরকারি ভাবে খনন করার দাবি জানান।

চলনবিলের পুঠিমারী গ্রামের কৃষক মোক্তার আলী জনবাণীকে জানান, চৈত্র মাস আসতে না আসতেই শ্যালো এবং মটরগুলোতে পানি পাওয়া যায়না। এতে করে আমরা ঠিকমত পানি সেচ দিতে পারছি না। অল্প পানি উঠায় আমাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে জানা যায়, নারদ নদসহ আত্রাই, বারনই, নন্দকুজা, বড়াল, মুসাখাঁন, খলিশাডাঙ্গা, পচাঁবড়াল, গদাই, নাগর ও পদ্মা (কিছু অংশ)- এই ৮টি নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে পানীয় জলের সংকট প্রকট হয়েছে। শুধু মাত্র নাগর, আত্রাই এবং পদ্মার কিছু অংশে পানি রয়েছে।

নাটোরের লেখক ও গবেষক খালিদ-বিন বাচ্ছু বলেন,এটা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। এখনি প্রস্তুতি না নিলে আগামীতে সুপেয় পানির সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করবে।’ অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে খোলা জায়গা ও জলাধার কমে যাওয়া এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে অতিরিক্ত চাপের কারণে এই সংকট বলে মনে করেন তিনি।

নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী জলি, গুরুদাসপুর পৌর মেয়র শাহনেওয়াজ আলী, চাট্মোহরের বড়াল বাঁচাও আন্দোলনের আহবায়ক মিজানুর রহমান্‌শাপলা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আশরাফফ উজ জামান এবং রাজশাহীর রুলফাও সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আফজাল হোসেন পানির সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, খরা মৌসুম এলেই নিরাপদ পানির সংকটে পড়তে হয়। এসময় পৌর এলাকা সহ নদি অববাহিকা এলাকার টিউবওয়েল অকেজো হয়ে গেছে।

সরকার যদি পানি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে নদী থেকে দূষণমুক্ত পানি উত্তোলন ও প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলো সংরক্ষণে এখনি উদ্যোগ না নেয়, তাহলে সামনে কঠিন বিপদ অপেক্ষা করছে।’

নাটোর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী আলঅমগীর হোসেন জানান, চলমান অর্থ বছরে নাটোরে তিনটি প্রকল্পে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ কাজ করছেন তারা। এগুলো হলো, সমগ্রদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ, পল্লী পানি সরবরাহ, অগ্রাধিকারমূলক গ্রামীণ পানি সরবরাহের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২ হাজার ৯০৪ টি সাবমার্সেবল পাম্প যুক্ত টিওয়েল,৭৯ টি সাধারণ টিউবওয়েল। জেলার ৫২টি ইউনিয়নে ৫২টি করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছারাও বরাদ্দ পেয়েছেন স্থানীয় সাংসদ সদস্যরা ৫০টি পর্যন্ত।

সূত্র জানায়, রাজশাহীর তুলনায় নাটোর জেলায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর তুলনা মূলক ভাবে ভাল। খরা মৌসুমে রাজশাহীর নিকটবর্তী পবা উপজেলায় ১৯৮৫ সালে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ছিল গড়ে ২০ ফুট ৬ ইঞ্চি। ১৯৯৫ সালে ৩০ ফুটের নিচে ও ২০১০ সালে পানির স্তর নেমে দাঁড়ায় প্রায় ৬৬ ফুটে।

বরেন্দ্র নাটোর রিজিয়নের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল মতিন জানান, এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় জেলার হাতিয়ান্দহ ইউনিয়নের আচলকোট মৌজায় ২০১৩ সালে ১৩ জুলাই স্থিতিশীল পানির গভীরতা ছিল ১২ফিট ২ ইঞ্চি, ২০১৪ সালের ১৩ জুলাই মাসে পানির গভীরতা নেমে দাঁড়ায় ১৩ ফিট ১ ইঞ্চিতে। অর্থাৎ প্রতিবছর প্রায় ১ফিট করে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।

বিএডিসি নাটোর রিজিয়নের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, জেলায় ২০০ টি গভীর নলকুপ দ্বারা সেচের জন্য পানি উত্তোলন করা হয়। এসব নলকূপের প্রতিটার পিছনে ব্যয় হয়েছে ৩০-৩৫ লক্ষ টাকা করে। চলতি অর্থবছরে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নাটোর জেলায় ৮০ কিমি. ইউপিভিসি পাইপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ সেচনালা নির্মাণের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার ৫৯০ হেক্টর জমিতে ভূপরিস্থ পানির দ্বারা সেচ প্রদান করা সম্ভব হবে।

তিনি আরোও বলেন,শ্যালো মেশিন মাটির ওপর থেকে ২৬ ফুট নিচ পর্যন্ত পানি তুলতে পারে। পানির স্তর অব্যাহত নিচে নামতে থাকলে একসময় শ্যালো টিউবওয়েলে পানি উঠবে না। সেচের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার না করে বিকল্প উৎস ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে সেচ কমিটির নীতিমালা মানার তাগিদ দেন তিনি ।

রাজশাহী পরিবেশ অধিদফতর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাহমুদা পারভীন জানান, ‘নাটোরসহ রাজশাহী অঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে বোম-মোটর সংযুক্ত গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে। এছাড়াও নির্বিচারে গাছপালা ধ্বংস করার কারণে এ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে।’ 

এসএ/