সীমাহীন চাওয়া, সীমাবদ্ধ মানুষ

যার যা আছে, সে সেটার চেয়ে আরেকটু বেশি চায়। যার অনেক আছে, সেও কম চায় না। যার কিছুই নেই, সেও বহু কিছু চায়—তা বলা যায় না। তবে কারো কারো চাওয়া পূরণে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়।
বিজ্ঞাপন
কখনো সমাজের এক–দুইজনের চাওয়া মেটাতে বহু মানুষের ন্যায্য অধিকার কেড়ে নিতে হয়। যাদের চাওয়া শুধু লবণ–ভাত, তাদের চাওয়া পূরণেই সবচেয়ে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়। সমাজ–সংসার ন্যায্যতা তৈরি করেনি, মানবতাও আগলে রাখেনি; বরং বৈষম্যকে দীর্ঘায়িত করেছে। যার আছে তার পাহাড় উঁচু, যার নেই সে বালুকণার চেয়েও নিচু।
বেহিসাব কামনার কারণে কত শত মানুষের বাসনা অপূর্ণ থেকে যায়—তা রঙিন চশমায় ধরা পড়ে না। শীতের রাতে হাড়জিরজিরে শরীরের কাঁপুনি আঁধার ভেদ করে আলো হয়ে ওঠে না। বিবেকের দেখার যে শক্তি থাকার কথা তা অনেকের মধ্যেই নেই। শক্তি যার যত বেশি, তার লোভ তত চওড়া। পরিশ্রম করে, বৈধ পথে অর্জন করার মানসিকতা বহু মানুষের মধ্যেই অনুপস্থিত। সবাই শক্তি প্রদর্শন করতে চায়; দেখিয়ে দিতে চায় সেও যে “কিছু একটা।” দখল করতে চায় রাজ্য, কিন্তু ভাজ্য হতে দিতে চায় না কিছুই। সবটুকুই প্রত্যেকের চাই।
মানুষ বহুলাংশে অসুখী। এই অসুখের একমাত্র কারণ— তার চাওয়া সীমাহীন। আশা করার সময় সে বাস্তবতা ভাবে না, যোগ্যতাও মাপে না। উৎসের প্রাচুর্য বা সামর্থ্যও গণনা করে না। স্বার্থকে পতাকা করে দাঁড়িয়ে থাকে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: অন্যের সফলতা দেখেও আনন্দ
কে বঞ্চিত হলো, কে পদদলিত হলো কিংবা কে মরল—তা নিয়ে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। তার যা চাওয়া, তা লাগবেই। যেকোনো মূল্যে স্বার্থ হাসিল করতে হবে। লোভ পূরণে প্রয়োজনে বিবেক বিক্রি দেবে, আত্মসম্মানের নিলাম করবে এবং আত্মসমর্পণ করবে
অসত্যের কাছে—তবুও ইন্দ্রিয়সুখ চাই। এই করতে করতে মনের সুখের সন্ধান অনেকের কাছেই আর থাকে না।
বিজ্ঞাপন
মানুষের চাহিদা যদি কমত, অভিযোগ যদি শূন্যের দিকে নামত এবং ঈর্ষা–হিংসা থামত তবে সুখ হয়ে উঠত অপ্রতিরোধ্য। তখন আর নিজের দোষ কপালকে দিতে হতো না; কর্মফল অস্বীকারের সুযোগও থাকত না। নিজেদের পাপ–অপরাধ এড়িয়ে
যেতে চাইলেও তা সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। মুহূর্তের জন্যও অস্বস্তি থেকে মুক্তি মিলবে না। যে আরও চায়—আরও চায়—তার কখনোই দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তি নেই। সচেতন মানুষ যত অসচেতনভাবে নিজেকে বিক্রি করে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের এই অধঃপতন দেখে পশু সমাজেও হাসাহাসি হয়। শয়তানের শয়তানি ছাড়িয়ে যাওয়া দেখে শয়তানও ভ্রূকুটি কাটে।
বিজ্ঞাপন
আমরা বোধহয় শান্তি চাই। তবে সুখ যে কেবল সম্পদে বন্দী নয়—এই মহান সত্য আমরা বেমালুম ভুলে যাই। ভুলে যাই মানুষ হিসেবে আমাদের করণীয়। বরণীয় ব্যক্তিদের আদর্শ বানানোর বদলে তেলমালিশ করি কথিত রাজনৈতিক বড়
ভাইদের! ‘সহমত ভাই’ হয়ে ওঠে প্রজন্মের জাতীয় স্লোগান। অনৈতিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার পায়তারা করে ফায়দা লুটতে চাই। যেকোনো উপায়ে অর্জিত সম্পদের সঞ্চয়কে মনে করি জীবনের পরম ব্রত।
অথচ কত সম্ভাবনা নিয়ে জন্মেছিল মানুষ! সে আলোর উৎস হতে পারত, আদর্শে ছাপ রাখতে পারত। অমিত সম্ভাবনার মানুষ লোভের কোপে মানুষের তবকা থেকে অকালে ঝরে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় মরিয়া হয়ে ওঠে। এভাবেই সীমাহীন চাওয়া মানুষকে করে তোলে সীমাবদ্ধ—নিজেরই কাছে পরাজিত।
বিজ্ঞাপন
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক








