বিতর্কিত নিয়োগ ডিপিডিসির এমডি নির্বাচনে আইনি প্রশ্ন

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে বি এম মিজানুল হাসানকে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। কিন্তু এ নিয়োগকে ‘বেআইনি, অস্বচ্ছ ও সংবিধানবিরোধী’ বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে শুরু হয়েছে আইনি বিতর্কও।
বিজ্ঞাপন
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ গত ২২ অক্টোবর ডিপিডিসির এমডিকে চিঠি দিয়ে জানায়, বি এম মিজানুল হাসানকে তিন বছরের জন্য চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ৫ অক্টোবর ডিপিডিসির ৩৮৭তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের আলোকে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এ পদের জন্য মেধাতালিকায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছিলেন যথাক্রমে সাব্বির আহমেদ, মো. শরিফুল ইসলাম ও বি এম মিজানুল হাসান। কিন্তু সাব্বির আহমেদের ‘কানাডাভিত্তিক অ্যালায়েন্স পাওয়ার’-এর অভিজ্ঞতা বিতরণ খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় বলে তাঁকে বাদ দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। ফলে শরিফুল ইসলাম ও মিজানুল হাসানকে নিয়ে নতুন তালিকা করা হয়। ২২ অক্টোবর বিকেল ৩টায় এই দুজনের সাক্ষাৎকার নেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। ওই দিনই বি এম মিজানুল হাসানকে নিয়োগের সুপারিশ করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
সূত্র বলছে, ডিপিডিসির এমডি নিয়োগের বৈধতা নিয়ে ঢাকা জেলা জজ আদালতের আইনজীবী তাহমিমা মহিমা বাঁধন বিদ্যুৎ বিভাগ ও ডিপিডিসির চেয়ারম্যান বরাবর লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন। তাঁর দাবি, বোর্ড সভায় কোনো চূড়ান্ত নিয়োগ অনুমোদন হয়নি; হয়েছিল শুধু সংক্ষিপ্ত তালিকার অনুমোদন।
বিজ্ঞাপন
এ ব্যাপারে তাহমিমা বাঁধন অভিযোগ করেন, মন্ত্রণালয় ‘বোর্ডের সিদ্ধান্তের আলোকে’ বাক্যাংশটি ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
এ বিষয় আইনজীবী শাহ আলম বলেন, বি এম মিজানুল হাসানের কর্মজীবন ট্রান্সমিশন খাতকেন্দ্রিক (পিজিসিবি), বিতরণ বা গ্রাহকসেবা ব্যবস্থাপনায় তাঁর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির শীর্ষ পদে তাঁর নিয়োগ বাস্তবতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। তিনি আরও জানান, লিখিত, প্রেজেন্টেশন ও মৌখিক সাক্ষাৎকারে শীর্ষে থাকা দুই প্রার্থীকে বাদ দিয়ে তৃতীয় স্থানে থাকা প্রার্থীকে নিয়োগ দিয়ে সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মেধাভিত্তিক নিয়োগের নীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বোর্ড সভার কার্যবিবরণীতে সরাসরি অনুমোদন না থাকলেও প্রশাসনিক পরামর্শ ও উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়। সাবেক এমডি একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী বলেন, “যদি লিখিত ও ভাইভা নিয়ে শেষে মন্ত্রণালয় নিজের মতো করে নিয়োগ দেয়, তাহলে এটা কেবল প্রশাসনিক অনিয়ম নয় সরকারি অর্থ, সময় ও জনআস্থার অপচয়ও।” তিনি আরও বলেন, “বোর্ড সভা ও নিয়োগ কমিটি যদি শুধু আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়ায়, তবে স্বচ্ছতার ধারণা অর্থহীন হয়ে যায়।”
বিজ্ঞাপন
প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি প্রজ্ঞাপনের ভাষা ও বোর্ড সভার কার্যবিবরণী মিল না থাকে, তাহলে এটি অফিশিয়াল ভুল উপস্থাপনা হিসেবে গণ্য হতে পারে। আদালত চাইলে এমন প্রজ্ঞাপন বাতিল ঘোষণা করতে পারে। তাঁরা মনে করেন, “স্বৈরাচারী মনোভাবে নিয়োগ দিলে প্রশাসনের নীতি, মেধার মূল্যায়ন ও সরকারি অর্থ সবই অর্থহীন হয়ে পড়ে।”
এ ব্যাপারে আইনজীবী তাহমিমা বাঁধন বলেন, “মেধা উপেক্ষা মানে সংবিধান উপেক্ষা। বোর্ড যেহেতু মূল্যায়ন করেছে, তাই মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ বাধ্যতামূলক।” তাঁর মতে, স্বচ্ছতা, যোগ্যতা ও ন্যায্য প্রতিযোগিতা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মূল ভিত্তি; তাই এই নিয়োগ বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করা উচিত।
বর্তমানে ডিপিডিসির তিনজন পরিচালকই পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) থেকে আসা। বি এম মিজানুল হাসানও ওই প্রতিষ্ঠান থেকেই। ডিপিডিসির অভ্যন্তরে অনেকেই মনে করেন, বিদ্যুৎ বিতরণ খাতে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। বোর্ডের কয়েকজন সদস্য বলেন, নেতৃত্বে কারিগরি দক্ষতা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাবেই সংস্থাটির কার্যক্রমে স্থবিরতা এসেছে। তাঁদের মতে, ৩৮৭তম বোর্ড সভায় প্রার্থীদের মধ্যে সর্বাধিক যোগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিকেই পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
বিজ্ঞাপন
আগেও ডিপিডিসিতে বিতর্কিত নিয়োগ: এর আগে সরকার গিয়াস উদ্দিন জোয়ারদারকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সদস্য পদে নিয়োগ দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ আমলে ডিপিডিসির পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) হিসেবে কর্মরত ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি। তবে সরকার এক দিনের মধ্যেই তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে। বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব নূর মোহাম্মদ ডিপিডিসির ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্বে আছেন। তাঁর আগে এমডি ছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান। সেই নিয়োগেও এমন বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল, যাতে তিনিই নিয়োগ পান যদিও ডিপিডিসির ইতিহাসে কোনো সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আগে এমডি হননি। সেই সময় আওয়ামী লীগের দোসর মোজাম্মেল বাবু ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শেখ হাসিনার নির্দেশে নিয়োগ পান আবদুল্লাহ আল নোমান। চেয়ারে বসেই ঘুষের দোকান খুলে বসেন। বাবু পরিচিত স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে খ্যাত প্রকৌশলীদের নিয়ে নোমান সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন।








