মাদকে আসক্ত ঢাকার অধিকাংশ পথশিশুরা

রাজধানী একটি জীবন্ত মহানগরী যা প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের স্বপ্ন এবং সংগ্রামের সাক্ষী হয়। কিন্তু এই উজ্জ্বল আলোর পিছনে লুকিয়ে আছে এক অন্ধকার ছায়া পথশিশুরা। এই শিশুরা, যারা শহরের ফুটপাত, সেতুতলা এবং বর্জ্যভূমিতে জীবন কাটায়, তাদের মধ্যে অধিকাংশই মাদকের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত। গবেষণা অনুসারে, ঢাকার পথশিশুদের প্রায় ৫০ শতাংশ মাদক আসক্ত, যা তাদের জীবনকে এক অসম্ভব যন্ত্রণার কাব্যে পরিণত করেছে। এই প্রতিবেদনটি সেই অদৃশ্য যুদ্ধের গল্প বলবে শুধু তথ্য নয়, বাস্তবতার কঠোর সত্যতা।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে পথশিশুদের সংখ্যা আনুমানিক ৪ লাখ ৪৫ লাখ, যার মধ্যে ঢাকায় একাই ৩ লক্ষেরও বেশি। এর মধ্যে মাদক আসক্তির হার অসম্ভব উচ্চ ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৩ শতাংশ পথশিশু মাদকের শিকার। ২০২৫ সালের একটি নতুন গবেষণায় এই সংখ্যা আরও ভয়াবহ হয়েছে ৬ থেকে ৯ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ৭০ শতাংশ মাদক আসক্ত হয়ে পড়ছে।
গ্লু স্নিফিং-এর মতো সস্তা মাদকের প্রতি আকর্ষণ এদের মস্তিষ্ককে ধ্বংস করছে, যা শুধু ব্যক্তিগত নয়, সমাজের একটি বিষাক্ত চক্র তৈরি করছে। ঢাকার রাস্তায় দাঁড়ালে প্রথমে চোখে পড়ে ট্রাফিকের হুঙ্কার, দোকানপাটের উচ্ছ্বাস। কিন্তু একটু নিচু চোখ ফেললে দেখা যায় একটি ছোট্ট হাত, যা প্লাস্টিকের বোতলে গ্লু ঢেলে নিশ্বাস নিচ্ছে। এই শিশুরা, যাদের বয়স ৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে, তাদের দিনরাত একই যন্ত্রণায় কাটে: ক্ষুধা, ঠান্ডা, এবং মাদকের অতল আকর্ষণ। একটি সাম্প্রতিক মেড্রিক্সিভ গবেষণায় দেখা গেছে, এদের ৪৩.৩৩ শতাংশ সিগারেট দিয়ে মাদক শুরু করে, যা পরে হেরোইন, ওপিয়াম এবং মারিজুয়ানায় পরিণত হয়।
বিজ্ঞাপন
কল্পনা করুন ৮ বছরের রাহাতের জীবন। সে গাজীপুরের একটি গ্রাম থেকে এসেছে, যেখানে তার বাবা-মায়ের মারামারি এবং দারিদ্র্য তাকে রাস্তায় ঠেলে দিয়েছে। ঢাকার মিরপুরের একটি ফুটব্রিজের নিচে সে থাকে, যেখানে রাতে ২০-৩০ জন শিশু একসাথে শোয়। প্রথমে সে খাবার চুরি করত, কিন্তু বন্ধুদের থেকে শেখা গ্লু স্নিফিং তার জীবন বদলে দিয়েছে। এখন সে দিনে ৫-৬ বার গ্লু শুঁকে, যা তার ফুসফুসকে কালো করে দিচ্ছে। তার চোখে আর স্বপ্ন নেই শুধু একটা অস্থায়ী ভুলে যাওয়ার লোভ। এমন হাজারো রাহাত ঢাকায় ঘুরে বেড়ায়, যাদের শরীর মাদকের কারণে ক্ষয়ে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্যের দিক থেকে এদের অবস্থা চরম। ইউনিসেফ এবং ডিএনসি রিপোর্ট অনুসারে, ঢাকায় ৭৫ হাজার পথশিশু গ্লু স্নিফিং-এ আসক্ত, যা তাদের স্নায়ুতন্ত্রকে ধ্বংস করে। এর ফলে ফুসফুসের ক্যান্সার, হার্টের সমস্যা, এবং মানসিক রোগ যেমন সিজোফ্রেনিয়া। একটি ২০২৫ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ শিশু শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সমস্যায় ভুগছে। এদের মধ্যে অনেকে এইচআইভি এবং হেপাটাইটিস-সি-এর শিকার, কারণ মাদকের সাথে যৌন নির্যাতন এবং অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস জড়িত।
শিক্ষা; এটি তাদের জীবনে একটা দূরের স্বপ্ন। ৯০ শতাংশেরও বেশি পথশিশু কখনো স্কুলে যায়নি। মাদকের কারণে তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, যা তাদের চিরকালের জন্য অশিক্ষিত রেখে দেয়। ১২ বছরের ফাতেমা, যে মোহাম্মদপুরের রাস্তায় ভিক্ষা করে। সে একবার স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখত, কিন্তু তার ‘সাহায্যকারী’ বড় ভাইয়েরা তাকে গ্লু দিয়ে আসক্ত করে ফেলেছে। এখন সে দিনে ১০ ঘণ্টা রাস্তায় কাটায়, রাতে অজানা লোকের হাতে নির্যাতিত হয়। এই দুর্দশা শুধু শারীরিক নয় এটি একটা মানসিক যুদ্ধ, যেখানে আশা মরে যায় এবং হতাশা রাজত্ব করে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: স্বপ্নের নগর আজ দুঃস্বপ্নের শহর!
এদের দৈনন্দিন জীবন একটা অন্ধকার চক্র। সকালে ভিক্ষা বা চুরি, দুপুরে মাদক, রাতে অসুরক্ষিত ঘুম। বর্ষায় তারা সেতুতলে পানির মধ্যে ভাসে, শীতে কাঁপে। মাদকের প্রভাবে এরা হঠাৎ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে যা তাদের আরও বিচ্ছিন্ন করে। একটি ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক স্টাডিতে বলা হয়েছে, ঢাকার ২ লাখ ৪৯ হাজার পথশিশুর প্রায় সবাই মাদকের সংস্পর্শে এসেছে। এই চিত্র দেখলে মনে হয়, ঢাকা শুধু একটা শহর নয় এটি একটা যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে শিশুরা অস্ত্রহীন সৈনিক।
কেন এমন হয়? এর পিছনে শুধু ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য নয়, সমাজের গভীর ফাটল। প্রথমত, পরিবারের ভাঙন। ২০২৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৬.৭ শতাংশ শিশুর পরিবারে পিতামাতা মাদক আসক্ত, যা শিশুদের প্রভাবিত করে। গ্রামীণ দারিদ্র্য এবং শহরীকরণ এদের ঢাকায় ঠেলে দেয় পিতামাতা কাজের খোঁজে চলে যায়, শিশু রাস্তায়।
বিজ্ঞাপন
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক চাপ। বাংলাদেশের দ্রুত শহরায়ণে গ্রাম থেকে লাখ লাখ মানুষ আসে, কিন্তু চাকরি না পেয়ে শিশুরা শ্রমিক হয়ে ওঠে। চুরি, ভিক্ষা এতে মাদক একটা ‘সান্ত্বনা’ হয়ে দাঁড়ায়। তৃতীয়ত, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। এদের কেউ সাহায্য করে না; বরং পুলিশের লাঠি এবং সমাজের উপেক্ষা তাদের মাদকের দিকে ঠেলে দেয়। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে পারিবারিক বিচ্ছেদ মাদকের মূল কারণ।
ঢাকার রাস্তায় মাদক বিক্রেতারা শিশুদের টার্গেট করে সস্তা গ্লু, ইয়াবা। দারিদ্র্য মাদক ঘটায়, মাদক আরও দারিদ্র্য ঘটায়। এই কারণগুলো শুধু তথ্য নয় এগুলো জীবনের কঠোর সত্য, যা সমাজকে প্রশ্ন করে: আমরা কি এদের জন্য কিছু করছি? আলোর রেখা কি যথেষ্ট? সরকার এবং এনজিওরা কি করছে? বাংলাদেশ সরকারের নারকটিক্স কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্ট (ডিএনসি) এবং সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার মিনিস্ট্রি পথশিশুদের জন্য রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম চালায়। ২০২৫ সালে সরকার ১০০টি নতুন রিহ্যাব সেন্টার খোলার ঘোষণা দিয়েছে, যার মধ্যে ঢাকায় ২৫টি। কিন্তু বাস্তবে এই সেন্টারগুলোতে শুধু ১০ শতাংশ শিশু পৌঁছায়, কারণ সচেতনতার অভাব এবং দূরত্ব।
ইউনিসেফ এবং সেভ দ্য চিলড্রেন পথশিশুদের জন্য ‘স্ট্রিট চিলড্রেন প্রটেকশন’ প্রোগ্রাম চালায়, যাতে মাদকমুক্তি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা অন্তর্ভুক্ত। ঢাকা আহসানিয়া মিশনের ‘রোড চিলড্রেন প্রোগ্রাম’ ৫ হাজার শিশুকে রিহ্যাব করেছে, যেখানে কাউন্সেলিং এবং ভোকেশনাল ট্রেনিং দেওয়া হয়। বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটির মতো সংস্থা শিক্ষা কেন্দ্র খোলে, যেখানে মাদক আসক্ত শিশুদের থেরাপি দেওয়া হয়।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু সাফল্য? একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৩.৩৩ শতাংশ শিশু রিহ্যাবের পরও ফিরে যায় রাস্তায়, কারণ ফলো-আপ নেই। সরকারের বাজেট অপ্রতুল ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে বাজেটে পথশিশু জন্য মাত্র ৫০ কোটি টাকা, যা ৩ লক্ষ শিশুর জন্য যথেষ্ট নয়। এনজিওরা কাজ করছে, কিন্তু সমন্বয়ের অভাবে ফলপ্রসূ নয়। ২০১৮ সালে দ্য ওয়্যারের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, গ্লু স্নিফিং শিশুদের জন্য একটা ‘নিউ ফ্যামিলি’ তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু ২০২৫ সালে এখনও চ্যালেঞ্জ অটুট। এই উদ্যোগগুলো আলোর রেখা, কিন্তু অন্ধকারকে সম্পূর্ণভাবে দূর করতে পারছে না।
পথশিশুরা শুধু নিজেদের যন্ত্রণায় নয় তাদের মাদক আসক্তি সাধারণ মানুষের জীবনকে বিষাক্ত করে তুলছে। প্রথমত, নিরাপত্তার ঝুঁকি। মাদকের প্রভাবে এরা চুরি, ডাকাতি, এমনকি হামলা। ঢাকার মিরপুর বা উত্তরায় এলাকায় প্রতি সপ্তাহে ১০-১৫টি চুরির ঘটনা পথশিশুদের সাথে যুক্ত। একটি ২০২৫ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৪০ শতাংশ শিশু সামাজিক সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে, যা শহরের অপরাধহার বাড়ায়।
দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য ঝুঁকি। এরা রাস্তায় থুতু ফেলে, অসুস্থ হয়ে ওঠে, যা এইচআইভি এবং টিবির মতো রোগ ছড়ায়। স্কুলের কাছে থাকলে শিশুরা প্রভাবিত হয় একটি পোস্টে উল্লেখ আছে, কলম্বোতে ২ লাখ ৩০ হাজার স্কুল ছাত্র মাদক আসক্ত, যা ঢাকার জন্যও সতর্কবার্তা। ঢাকায় অফিস যাওয়ার সময় এরা ট্রাফিক জ্যাম করে, যা মানসিক চাপ বাড়ায়।
বিজ্ঞাপন
তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক ক্ষতি। এরা দোকান লুট করে বা ভিক্ষায় চাপ দিয়ে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি করে। গণমাধ্যমের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৪.৪৫ লক্ষ পথশিশু অর্থনীতিতে বার্ষিক ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি করে। শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হয় বর্জ্য, মাদকের প্যাকেট সর্বত্র। সাধারণ মানুষের জন্য এটি একটা অসহায় অসুবিধা, প্রতিদিনের জীবন যেন একটা যুদ্ধ। একটি এক্স পোস্টে বলা হয়েছে, ফুটব্রিজে ছায়াময় জীবন যা সকলের জন্য বিপদ।
ঢাকার পথশিশুরা মাদকের শিকার হয়েছে, কিন্তু তাদের গল্প শেষ হয়নি। এটি আমাদের সকলের গল্প একটা সমাজের ব্যর্থতা এবং পুনর্জন্মের সম্ভাবনা। যদি আমরা এখন উঠে দাঁড়াই, তাহলে এই অন্ধকারে আলো জ্বালানো যাবে। না হলে, ঢাকা শুধু একটা শহর থাকবে না এটি হয়ে উঠবে একটা যন্ত্রণার স্মৃতিস্তম্ভ।
বিজ্ঞাপন








