শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট ‘ফাইভ পার্সেন্ট পিডি’ তবিবুর

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট প্রকৌশলী তবিবুর রহমান তালুকদার ঘাঁটি গেড়ে বসে আছেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে। সরকার পতনের এক বছর পরও জনগণের স্বাস্থ্যসেবা খাতের গুরুত্বপূর্ণ এ দপ্তরটি দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছেন। তার বিরুদ্ধে দেশের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমসহ আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের জমানায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে পিডি (প্রকল্প পরিচালক) হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সেই সুবাদে আর্থিকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন তিনি।
একই সঙ্গে দেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভান্ডার ভারতে পাচারের অভিযোগ রয়েছে এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে। সম্প্রতি প্রকৌশলী তবিবুর রহমান ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের ‘র’ এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র থেকে জানা গেছে। ফ্যাসিবাদের বিগত বছরগুলোতে প্রকল্প পরিচালকদের কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়লেও শেখ হাসিনার আর্শিবাদে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। উপরন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের সময় প্রধান প্রকৌশলী পদোন্নতি নিতে তৎপর রয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত “মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি” প্রকল্পে চলছে ভয়াবহ অনিয়ম, ঘুষ ও কমিশন বাণিজ্য। এই দুর্নীতির মাস্টার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) প্রকল্প পরিচালক তবিবুর রহমান তালুকদার। ২০২১ সালের অক্টোবরে অনুমোদিত ১,৮৮২ কোটি টাকার এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল দেশের ৩০টি জেলায় নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা সম্প্রসারণ। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে সরকারি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অনুসন্ধানে মাঠে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগ রয়েছে— রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ও প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদে তিনি গড়ে তুলেছেন একটি দুর্নীতির সাম্রাজ্য, যেখানে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প তার নিজের ও ঘনিষ্ঠদের পকেটে চলে যাচ্ছে। ডিপিএইচইয়ের ভেতরের একাধিক সূত্র জানায়, তবিবুর রহমান প্রকল্পের প্রতিটি ধাপে কমিশন নেওয়া অলিখিত নিয়মে পরিণত করেছেন। পছন্দের ঠিকাদারদের কাছ থেকে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দেওয়া হতো। অধিদপ্তরের ভেতরে এখন তাঁর নতুন নাম ‘ফাইভ পার্সেন্ট পিডি’। নিয়ম অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার কথা থাকলেও, তিনি নিয়মিতভাবে তা এড়িয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় লোয়েস্ট ঠিকাদারকে কাজ দেন, কমিশন আদায়ের সুবিধার জন্য। ফলে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কোটি কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়, অথচ কাজের মান অত্যন্ত নিম্নমানের। বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা ছিল ইউরোপীয় মানের পাইপ ও সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে ভারতীয় নিম্নমানের পণ্য, যার ফলে অনেক স্থানে স্থাপিত পানি সরবরাহ লাইন কয়েক মাসেই অকেজো হয়ে পড়েছে।
দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, প্রকল্প চলাকালীন সময়ে তবিবুর রহমানের নামে ও বেনামে অর্জিত হয়েছে ধানমন্ডি ও উত্তরা এলাকায় ফ্ল্যাট, বিলাসবহুল গাড়ি এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি টাকার লেনদেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের অর্থেই এসব সম্পদ গড়ে উঠেছে। দুদকের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। তবে সংস্থার ভেতর থেকেই অভিযোগ “উচ্চপর্যায়ের প্রভাব ও রাজনৈতিক চাপের কারণে তদন্ত এগোচ্ছে ধীর গতিতে।”
এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,“প্রমাণ এতটাই স্পষ্ট যে, এটি লুকানো সম্ভব নয়। কিন্তু উপরের প্রভাবশালী মহল তদন্তকে বারবার থামিয়ে দিচ্ছে।”
বিজ্ঞাপন
এ বিষয় তবিবুর রহমানের মুঠো ফোনে কল দিলে রিসিভ করেনি। এমনকি ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে উত্তর মেলেনি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, তিনি শাসকদলের প্রকৌশলী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, এবং সেই রাজনৈতিক সংযোগকেই কাজে লাগিয়ে বিশ্বব্যাংকের এই প্রকল্পে অপ্রতিরোধ্য প্রভাব বিস্তার করেছেন।
স্থানীয় সরকার বিভাগ একাধিকবার তদন্তের নির্দেশ দিলেও, আজও কোনো প্রতিবেদন জমা পড়েনি। প্রশাসনের অনেকেই বলছেন, “তবিবুরের পেছনে শক্ত রাজনৈতিক আশ্রয় না থাকলে এত বড় দুর্নীতি সম্ভব হতো না।” তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো। বিশেষজ্ঞদের মতে “দুদক যদি প্রভাবমুক্ত থেকে পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে এই দুর্নীতির সংস্কৃতি শুধু জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নয়, রাষ্ট্রের সেবাব্যবস্থাকেও পঙ্গু করে দেবে।”
বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় জনগণের জন্য নেওয়া এই পানি সরবরাহ প্রকল্প এখন পরিণত হয়েছে লুটপাটের মঞ্চে। টেন্ডার সিন্ডিকেট, কমিশন বাণিজ্য ও রাজনৈতিক প্রভাবের জালে জড়িয়ে পড়েছে একটি মহৎ জনস্বাস্থ্য উদ্যোগ। সচেতন মহলের অভিমত দুদক ও স্থানীয় সরকার বিভাগ দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের বিচারের মুখোমুখি না করলে এই দুর্নীতির সংস্কৃতি কখনোই থামবে না।
বিজ্ঞাপন








