Logo

ডিপিডিসি লাইনম্যানের কোটি টাকার রাজত্ব

profile picture
বশির হোসেন খান
১০ নভেম্বর, ২০২৫, ১৩:১৫
30Shares
ডিপিডিসি লাইনম্যানের কোটি টাকার রাজত্ব
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মাঠপর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। তবে সম্প্রতি এক লাইনম্যান মেটের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগটি আবারও প্রশ্ন তুলেছে- ৩৫ হাজার টাকার বেতনের চাকরিতে থেকেও কীভাবে কেউ কোটি টাকার মালিক হতে পারেন? ডিপিডিসি লাইনম্যান মেট মো. মিলন মিয়া (আইডি: ২১২৬৩) বর্তমানে মাতুয়াইল ডিভিশনে কর্মরত। দীর্ঘ ২০ বছরের চাকরিজীবনে তিনি হয়েছেন বিতর্কিত এক নাম।

বিজ্ঞাপন

একাধিক সূত্র বলছে, তিনি শুধু ডিপিডিসির ভেতরেই নন রাজনীতিতেও প্রভাবশালী মহলের ঘনিষ্ঠ। স্থানীয়ভাবে নিজেকে “শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের আস্থাভাজন কর্মী” বলে পরিচয় দেন মিলন মিয়া। এলাকাবাসী ও সহকর্মীরা জানান, এই পরিচয়ের জোরেই তিনি বছরের পর বছর ধরেই ছিলেন ‘অস্পর্শযোগ্য’।

একাধিক সূত্র জানায়, ২০২৫ সালের ২২ অক্টোবর ডিপিডিসির রমনা ডিভিশন থেকে বদলি হয়ে মিলন মিয়া যোগ দেন মাতুয়াইল ডিভিশনে অভ্যন্তরীণভাবে পরিচিত ‘অবৈধ সংযোগের স্বর্গরাজ্য’ হিসেবে। সেখানে নিয়োগ মানেই মোটা অঙ্কের ঘুষ এমন ধারণা অনেক পুরোনো। মিলন মিয়া মাতুয়াইলে বদলি হতে ৪ লাখ টাকা ঘুষ দেন। ঘুষের টাকাটি নাকি মুগদা ডিভিশনের হিসাব কর্মকর্তা মো. এনায়েত হোসেনের মাধ্যমে পৌঁছে যায় ডিপিডিসির এইচআর দপ্তরের ডিজিএম মনিরুজ্জামানের কাছে। মনিরুজ্জামানকে বলা হয় ‘বদলির গেটকিপার’ যার অনুমতি ছাড়া কোনো লাইনম্যানের স্থানান্তর হয় না। তবে বিদ্যুতের শর্ত ভেঙে বদলি করা হয়। বিদ্যুৎ মন্ত্রনালয়ে শর্তে বলা আছে, কর্মস্থালে তিন বছর চাকরি করতে হবে। তার আগে বদলি হওয়ার সুযোগ নাই। তবে মিলনের ১০ মাস পর হয়নি। টাকার জোরে বদলি হয়েছে বলে সূত্র দাবি করেছেন।

একজন অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মিলন মিয়া তো সবার চেনা মুখ। আওয়ামী লীগের কিছু প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে তাঁর ছবি ঘুরে বেড়ায় ফেসবুকে। এই রাজনৈতিক সম্পর্ক দেখিয়ে তিনি অনেক কিছু ‘ম্যানেজ’ করেন। মাতুয়াইল ডিভিশনে বদলিও তারই অংশ।

বিজ্ঞাপন

মুগদা ডিভিশনে তিন বছরেরও বেশি সময় কাজ করার সময় থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে ছিল দুর্নীতি ও হয়রানির অভিযোগ। গ্রাহক সেবার নামে উৎকোচ নেওয়া, অবৈধ সংযোগ দেওয়া, বা নিয়মবহির্ভূতভাবে মিটার সংযোগ পরিবর্তনের মতো কাজে তিনি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০২৩ সালে এক তদন্ত কমিটি গঠন হলেও, ‘উর্ধ্বতন মহলের আশীর্বাদে’ সেটি থেমে যায়। এক কর্মকর্তা বলেন, তদন্তে যেতেই আমাদের ওপর চাপ আসে। বলা হয়, ‘ও তো আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ লোক, সাবধানে চলেন।’ এরপর আর কিছুই হয়নি। মুগদায় কর্মরত অবস্থায় মিলন মিয়া নাকি একাধিক বহুতল ভবনে উচ্চচাপ (এসটি) সংযোগ পাশ কাটিয়ে নিম্নচাপ (এলটি) সংযোগ দেন। যাতে বিল কম দেখায়, কিন্তু মিটার ঘোরে পূর্ণ ক্ষমতায়। বিনিময়ে প্রতিটি প্রকল্প থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর সবুজবাগ থানাধীন দক্ষিণগাঁওয়ের ১ নম্বর সড়কে দাগ নং ৩৫৯৭ নম্বর জমিতে মিলন মিয়ার নামে একটি পাঁচতলা ভবন রয়েছে। ভবনটির বিদ্যুৎ সংযোগ (কাস্টমার নম্বর ২৫৯৮৮৯৪৯) রয়েছে তাঁর নিজের নামে। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ছয় বছর আগে তিনি জমিটি কিনে সঙ্গে সঙ্গে ভবন নির্মাণ শুরু করেন। বর্তমানে ভবনটির তিনতলা পর্যন্ত নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে, এবং তিনি নিজে ওই ভবনে বসবাস করছেন। এই ভবন নির্মান করতে খরচ হয়েছে ১০ কোটি টাকার বেশি। স্থানীয়দের কাছে তিনি পরিচিত ‘বিদ্যুতের প্রকৌশলী মিলন’ নামে।

বিজ্ঞাপন

সবুজবাগ এলাকার এক ভুক্তভোগী রবিউল হোসেন বলেন, আমি একবার অবৈধ সংযোগের ঝামেলায় পড়েছিলাম। বিদ্যুৎ অফিসে গেলে বলে, মিলন ভাইকে ধরেন। উনি ২০ হাজার টাকায় একদিনেই কাজ করে দিলেন। আমরা ভেবেছিলাম তিনি বড় অফিসার, পরে জানলাম তিনি লাইনম্যান। সবুজবাগ এলাকার অন্য একজন ভুক্তভোগি জানান, মিলন ভাই আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানগুলোয় প্রথম সারিতে থাকতেন। বড় নেতাদের সঙ্গে ঘোরেন। সবাই জানে উনি খুব প্রভাবশালী। আসলে তিনি মোটা অংকের বিনিময়ে কাজ করে দেন।

শুধু ঢাকাতেই নয়, গাজীপুরে তাঁর নামে রয়েছে আরেকটি বহুতল ভবন। স্থানীয় রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা বলছেন, তিনি নিয়মিত জমি কেনাবেচা করতেন। এক ব্যক্তি বলেন, তিনি আমাদের বলেছিলেন, সরকারি চাকরি করেন, কিন্তু টাকা কোনো সমস্যা না। আওয়ামী লীগের লোকজনের সঙ্গে চলাফেরা আছে। তাই তাঁকে কেউ কিছু বলতে পারে না।

ডিপিডিসির গ্রাহকদের কয়েকজন অভিযোগ করেন, মিলন মিয়া ও তাঁর সহকর্মীরা সার্ভিস সংযোগ, ট্রান্সফার, ও বিল রিভিউয়ের নামে ঘুষ নেন। মুগদার বাসিন্দা রুবেল আহমেদ বলেন, আমার দোকানের সংযোগের জন্য ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছিল। না দিলে বারবার ফাইল আটকে যেত। পরে জানলাম, টাকাটা মিলন ভাইয়ের কাছেই গেছে। আরেকজন গ্রাহক, কামরুল হাসান বলেন, সংযোগে একটু গোলমাল হয়েছিল। অফিসে গেলে বলা হলো, মিলন ভাই ছাড়া কিছু হবে না। ৫ হাজার টাকা দিয়ে দুই ঘণ্টায় কাজ হয়ে গেল। মিটার এখনো ঠিকঠাক চলে।

বিজ্ঞাপন

এবিষয়ে ডিপিডিসির লাইনম্যান মিলন মিয়া নিজেকে সৎ ও নির্লোভ কর্মচারী বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, আমার ২২ বছরের চাকরিজীবনে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। বেতনের টাকা থেকে অল্প অল্প করে জমিয়ে এই জায়গাটি কিনেছি। এতে দোষের কী আছে?” অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, মুগদায় আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছিল, তা সবই অপপ্রচার। তদন্ত কমিটি হয়েছিল, কিন্তু কিছু পায়নি।

বদলির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রমনা থেকে মাতুয়াইলে বদলি হওয়ার জন্য আমি সাবেক নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন) সোনামনি চাকমা স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। যোগাযোগ করিয়ে দেন এইচআর দপ্তরের ডিজিএম মনিরুজ্জামান স্যার। এর বেশি কিছু বলব না। আপনারাই বুঝে নিন। বক্তব্যের শেষ হতে না হতেই ফোন কেটে দেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

ডিপিডিসির এক সাবেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মিলন মিয়া আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ। সাবেক সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরির সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক। অফিসে অনেকে তাঁকে হাস্যরস করে বলে ‘হাসিনার লোক’। ‘ এখনও কেউ তাঁকে তুচ্ছ করতে সাহস পায় না।’

একইভাবে এক কর্মচারী ইউনিয়ন নেতা বলেন, রাজনৈতিক যোগাযোগ না থাকলে এতদিন চাকরি বাঁচত না। তার বিরুদ্ধে ৫টা অভিযোগ হয়েছিল, কিন্তু কোনো তদন্তই শেষ হয়নি।

ডিপিডিসির এইচআর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা অভিযোগ পেয়েছি, তবে প্রমাণ পাওয়া কঠিন। লাইনম্যানরা অনেক সময়ই স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক পরিচয়ে পার পেয়ে যান।

বিজ্ঞাপন

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক কর্মকর্তা বলেন, ডিপিডিসির মাঠ পর্যায়ের দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট। তবে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে নিচের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারা যায় না।

বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন বলেন, সরকারি চাকরিতে অল্প বেতনে থেকেও যারা অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যান, তাঁদের সম্পদ অনুসন্ধান করা এখন সময়ের দাবি। বিদ্যুৎ খাতের মাঠপর্যায়ের দুর্নীতি শুধু রাষ্ট্রের রাজস্ব ক্ষতি নয়, সাধারণ জনগণের জন্যও এক ভয়াবহ ভোগান্তি। ডিপিডিসির মতো প্রতিষ্ঠানে যদি একজন লাইনম্যানও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কোটি টাকার মালিক হতে পারেন, তাহলে পুরো ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। মিলন মিয়া এখনো মাতুয়াইল ডিভিশনে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিভাগীয় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুর্নীতি বন্ধ হবে না, যদি রাজনৈতিক ছত্রছায়া না কাটা যায়। তিনি বলেন, একই প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। একজন লাইনম্যান কি সত্যিই বেতনের টাকায় ঢাকায় ভবন তুলতে পারেন, নাকি ‘আওয়ামী আস্থাভাজন’ পরিচয়ই তাঁর প্রকৃত শক্তি।

জেবি/আরএক্স
Logo

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ

মোঃ শফিকুল ইসলাম ( শফিক )

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ৫৭, ময়মনসিংহ লেন, ২০ লিংক রোড, বাংলামটর, ঢাকা-১০০০।

ফোনঃ 02-44615293

ই-মেইলঃ dailyjanobaninews@gmail.com; dailyjanobaniad@gmail.com

জনবাণী এর সকল স্বত্ব সংরক্ষিত। কপিরাইট © ২০২৫

Developed by: AB Infotech LTD