আগুন বন্ধু বটে তবে সতর্ক না হলে পরম শত্রুও


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


আগুন বন্ধু বটে তবে সতর্ক না হলে পরম শত্রুও

আগুন এমন এক প্রাকৃতিক উপাদান যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি সকাল শুরু হয় আগুনের ব্যবহার দিয়ে। আগুন দ্রুত প্রজ্জ্বলনশীল পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়াবিশেষ। এটি তাপোৎপাদী, দহন বিক্রিয়ায় পদার্থের দ্রুত জারণ প্রক্রিয়া। এতে উত্তাপ, আলো সহ বহুবিধ রাসায়নিক উৎপাদ সৃষ্টি হয়। আগুন গরম, কারণ আণবিক অক্সিজেন-এর দুর্বল দ্বি-বন্ধন, দহন বিক্রিয়ার উৎপাদ কার্বন ডাই অক্সাইড ও পানির দৃঢ় বন্ধনে রূপান্তরের সময় শক্তি উৎপাদন করে। জ্বালানীর বন্ধন শক্তি এখানে খুব সামান্যই ভূমিকা পালন করে। 

দহন বিক্রিয়ার একটি নির্দিষ্ট বিন্দু বা জ্বলনাঙ্কে পৌছালে অগ্নিশিখা উৎপন্ন হয়। শিখা হলো আগুনের দৃশ্যমান অংশ। অগ্নিশিখা মূলত কার্বন ডাই অক্সাইড, জলীয় বাষ্প, অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন নিয়ে গঠিত। যথেষ্ট উত্তপ্ত হলে গ্যাস আয়নিত হয়ে প্লাজমা উৎপাদন করতে পারে। প্রজ্জ্বলিত পদার্থের উপাদান এবং অপদ্রব্যের উপস্থিতির ভিত্তিতে শিখার রং এবং আগুনের তীব্রতা ভিন্ন হয়। আগুন প্রজ্জ্বলিত হয় যখন পর্যাপ্ত পরিমাণ জারক যেমন অক্সিজেন গ্যাস বা অন্য অক্সিজেন সমৃদ্ধ যৌগ সমন্বিত একটি দাহ্য পদার্থ ঐ জ্বালানী/জারক মিশ্রণের জ্বলনাঙ্কের অধিক তাপমাত্রার কোনো উৎসের সংস্পর্শে আসে এবং দ্রুত জারণের একটি হার বজায় রাখতে পারে, যার ফলশ্রুতিতে একটি শৃঙ্খল বিক্রিয়া বা চেইন রিঅ্যাকশন উৎপাদিত হয়। এটাকে সাধারণভাবে অগ্নি ত্রিভুজ বলা হয়। 

সঠিক অনুপাতে এই সব উপাদানের উপস্থিতি ছাড়া আগুনের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, একটি দাহ্য তরল শুধুমাত্র জ্বালানী এবং অক্সিজেন সঠিক অনুপাতে থাকলেই প্রজ্জ্বলিত হবে। কিছু জ্বালানী-অক্সিজেন মিশ্রণে অনুঘটক প্রয়োজন হতে পারে যা বিক্রিয়ায় গৃহীত হয় না কিন্তু দহনের সময় কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যোগ করা হলে, বিক্রিয়কসমূহকে অধিক দাহ্য করতে সক্ষম। একবার প্রজ্বলিত হলে শৃঙ্খল বিক্রিয়া সংঘটনের মাধ্যমে আগুন দহন প্রক্রিয়ায় আরো তাপ শক্তি মুক্ত করার মাধ্যমে নিজের তাপ বজায় রাখতে পারে এবং যদি একটি জারক এবং জ্বালানী ক্রমাগত সরবরাহ করা হয় তবে আরও বিস্তৃত হতে পারে।

আগুন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আদিম মানুষের জীবনযাপনে একটি নাটকীয় পরিবর্তন এনেছিল। তাপ এবং আলো প্রাপ্তির জন্য আগুন ব্যবহার করা থেকেই মানুষের পক্ষে খাদ্য রান্নার পদ্ধতি শেখা সম্ভব হয়েছে, যার মাধ্যমে একই সাথে পুষ্টির বৈচিত্র্য এবং প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং খাদ্যে অবস্থিত অণুজীব হত্যার মাধ্যমে রোগ-ব্যাধি হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। আগুন থেকে প্রাপ্ত তাপ মানুষকে ঠান্ডা আবহাওয়ায় উষ্ণ থাকতে সাহায্য করে ও শীতল জলবায়ুতে তাদের বসবাস করতে সক্ষম করে তোলে। এছাড়াও আগুন নিশাচর শিকারী প্রাণীদের থেকে মানুষকে রক্ষা করেছে। 

রান্না করা খাবারের প্রমাণ ১০ লক্ষ বছর আগে থেকে পাওয়া যায় যদিও সম্ভবত ৪ লক্ষ বছর আগে মানুষ নিয়ন্ত্রিত ভাবে আগুন ব্যবহার করতে শেখে। প্রায় ১০ লক্ষ বছর আগে একটি নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে আগুন ব্যবহারের কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ বছর আগের সময়কালে আগুন ব্যবহারের ব্যাপক প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সময় থেকেই আগুনের নিয়মিত ব্যবহারের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কৌতূহলউদ্দীপক ভাবে, বায়ুদূষণের প্রতি প্রতিরোধশক্তিও একই সময়ে মানবকূলে বিকশিত হতে শুরু করে। আগুনের ব্যবহার ক্রমশ উন্নত হয়ে হাজার বছর আগে বন্যপ্রাণী নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত পাওয়া যায়।

আগুনের একটি সাধারণ রূপ হলো অগ্নিদাহ, যা পোড়ানোর মাধ্যমে শারীরিক ক্ষতিও ঘটাতে পারে। আগুন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া যা সারা বিশ্বের পরিবেশ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। আগুনের ইতিবাচক প্রভাবের মধ্যে রয়েছে বৃদ্ধি উদ্দীপক হিসেবে কাজ করা এবং বিভিন্ন বাস্তুতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখা। এর নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যে রয়েছে জীবন এবং সম্পত্তির ঝুঁকি, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ এবং পানি দূষণ। যদি আগুন গাছপালার ক্ষতিসাধন করে, তবে ভারী বৃষ্টিপাতের পানিতে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পেতে পারে।
 
এছাড়াও গাছপালা পুড়লে এতে অবস্থিত পটাশিয়াম এবং ফসফরাস ছাইয়ের মধ্যে থেকে পুনঃব্যবহারের জন্য দ্রুত মাটিতে মিশ্রিত হলেও নাইট্রোজেন বায়ুমন্ডলে মুক্ত হয়ে যায়। আগুনের কারণে নাইট্রোজেনের এই ক্ষয় দীর্ঘমেয়াদীভাবে মাটির উর্বরতা হ্রাস করে। তবে এই উর্বরতা পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে নাইট্রোজেন সংবদ্ধকরণ এর মাধ্যমে, যেমনটা বজ্রপাত ও নাইট্রোজেন সংবদ্ধকারী লিগিউম জাতীয় উদ্ভিদ যেমন মটরশুঁটি, শিম বায়ুমন্ডলে উপস্থিত আণবিক নাইট্রোজেনকে অ্যামোনিয়ায় রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে দেখা যায়।

বিশ্বব্যাপী দাবানল প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করা হয়। যেমন বন্যভূমির আগুন ব্যবহার বা নিয়ন্ত্রিত অগ্নিকান্ড। বন্যভূমির আগুন ব্যবহার করার অর্থ হলো প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট আগুন পর্যবেক্ষণ করা হয়। নিয়ন্ত্রিত অগ্নিকান্ড হলো কম বিপজ্জনক আবহাওয়ায় সরকারী সংস্থা দ্বারা প্রজ্জ্বলিত আগুন। অনিয়ন্ত্রিত আগুন নেভানোর জন্য অধিকাংশ উন্নত এলাকায় দমকল বাহিনী অগ্নিনির্বাপন সেবা প্রদান করে থাকে। প্রশিক্ষিত দমকল বাহিনীর কর্মীরা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা যেমন ফায়ার হাইড্রান্ট অথবা ফোম ব্যবহার করে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে।

অগ্নিনির্বাপন মূলত আগুন জ্বলনের উৎস হ্রাস করার উদ্দেশ্যে করা হয়। এছাড়াও কিভাবে আগুন এড়াতে হয় মানুষকে সে শিক্ষা দেওয়াও এর অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন বিদ্যালয় এবং উঁচু ভবনে প্রায়ই ফায়ার ড্রিল পরিচালনা করে নাগরিকদের অগ্নিকান্ডের প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত সে শিক্ষা দেওয়া হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধ্বংসাত্মক আগুন জ্বালানো মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য। আদর্শ ভবনের নিয়মানুযায়ী আগুনের ক্ষতি কমাতে অগ্নি সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। সক্রিয় অগ্নি সুরক্ষার সবচেয়ে সাধারণ রূপ হলো ফায়ার স্প্রিঙ্কলার। অধিকাংশ উন্নত দেশে ভবন, ভবনের উপাদান এবং আসবাবপত্রের অগ্নি প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং দাহ্যতা পরীক্ষা করা হয়। এছাড়াও যানবাহন এবং জাহাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও সজ্জা সামগ্রীও পরীক্ষা করা হয়।

অগ্নি সুরক্ষা ব্যবস্থা অগ্নি প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হলে, অগ্নি বীমা আর্থিক ক্ষতি কমাতে পারে। আগুন কখন লাগবে সেটা আগে থেকে বলা যায় না। তাই আগুন লাগার মতো দুর্ঘটনা যেনো না ঘটে সেই জন্য আমাদের আগাম সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অগ্নি দুর্ঘটনা আমাদের দেশে হরহামেশাই হচ্ছে। প্রতি বছর আগুনের কারনে আমাদের দেশে বিপুল অর্থের ক্ষতি যেমন হচ্ছে তেমনি ঝরে যাচ্ছে মূল্যবান প্রাণ। তাই আগুন প্রতিরোধের জন্য আমাদের করনীয় বিষয়গুলো জেনে রাখতে হবে। নিচে এমন কিছু প্রয়োজনীয় সতর্কতা দেয়া হলো : 

১। রান্নার কাজে গ্যাস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। গ্যাস বিস্ফোরণ হয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই এর জন্য বিশেষ সতর্কতা ও সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। যেমনঃ ক) রান্নার পর চুলা সম্পূর্ণভাবে নিভিয়ে ফেলা, খ) ভেজা জামা কাপড় চুলার উপর শুকাতে দেয়া যাবে না। এতে কাপড়ে আগুন লেগে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, গ) গ্যাসের চুলা জ্বালানোর কমপক্ষে ১৫ মিনিট আগে রান্নাঘরের সকল জানালা দরজা খুলে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে, ঘ) গ্যাসের চাবি অন করার আগে ম্যাচের কাঠি ধরাতে হবে, ঙ) গ্যাসের চুলার হোজ পাইপটি ফাটা বা ক্ষতিগ্রস্থ হলে পরিবর্তন করতে হবে।

২। বাসাবাড়িতে বৈদ্যুতিক লাইনে অগ্নি সংযোগ ঘটে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই এই বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন: ক) বাসাবাড়ির বৈদ্যুতিক লাইন প্রতি ছয় মাস পর পর নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। ক্রটিপূর্ন লাইন পাওয়া গেলে দ্রুত সারাতে হবে। এতে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে, খ) সঠিক মানের বৈদ্যুতিক তার বা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে। ইলেকট্রিক সামগ্রীতে সরাসরি বৈদ্যূতিক সংযোগ রেখে কখনো চলে যাওয়া যাবে না, গ) ক্ষতিগ্রস্থ বা নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার বা সরঞ্জাম ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে, ঘ) খোলা বাতির ব্যাবহার পরিহার করতে হবে। 

৩। এছাড়াও বাসাবাড়ি ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে আরও কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন: ধুমপান বর্জন করতে হবে অথবা ধুমপান করলে অবশিষ্ট অংশ নিভিয়ে নিরাপদ স্থানে ফেলতে হবে, অনভিজ্ঞ লোক দিয়ে রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থ ব্যাবহার করা যাবে না, অগ্নি:স্ফুলিঙ্গ নিরোধক সুইচ ও প্লাগ ব্যাবহার করতে হবে, সহজে দাহ্য বস্তু দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরী কমাতে হবে, কর্মস্থলের কাছে পর্যাপ্ত পানি বা বালির ব্যবস্থা রাখতে হবে, নিয়মিত অগ্নি নির্বাপনী মহড়ায় অংশ নিতে হবে, অগ্নি নির্বাপনী ও প্রতিরোধ সম্পর্কে প্রথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহন করতে হবে।

অগ্নি নির্বপনী সেচ্ছাসেবক বাহিনীর পরামর্শ গ্রহন করতে হবে, বাসায় বা প্রতিষ্ঠানে সবসময় এক বালতি পানি ও এক বালতি বালি রাখতে হবে। এগুলো আগুন নেভাতে সাহায্য করে, অগ্নি ঝুঁকি অনুসারে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্র মজুদ রাখতে হবে, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের প্রয়োগ ও ব্যবহার বিধি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিতে হবে, প্রতিষ্ঠানের ও বাড়ির সকল স্থান আবর্জনামুক্ত রাখতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় ডকুম্যান্ট বা কাগজপত্রের প্রয়োজন শেষ হলে পুড়িয়ে ফেলতে  হবে।

লেখক: মো: আরাফাত রহমান, কলামিস্ট, সহকারি কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

এসএ/