খাগড়াছড়িতে বছরে পঞ্চাশ কোটি টাকার বাণিজ্য

উলু ফুলে স্বপ্ন পুরন পাহাড়ের মানুষের


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৩:২৯ অপরাহ্ন, ৩০শে মার্চ ২০২৪


উলু ফুলে স্বপ্ন পুরন পাহাড়ের মানুষের
ছবি: প্রতিনিধি

খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য তিন জেলায় উলু ফুল প্রাকৃতিক ভাবে জন্মায়। আর এখন পাহাড় জুড়ে উলু ফুল সংগ্রহ করার মৌসুম চলছে। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পাহাড়িরা নিজেদের বাগান ছাড়া দুর্গম এলাকায় গিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে খোঁজ করে উলু ফুল সংগ্রহ করেন। আটার থেকে বিশটি করে বেঁধে এক আটিঁ উলু ফুল স্থানীয় বাজারে নিয়ে গিয়ে ১৪ থেকে ১৫ টাকা দরে বিক্রি করেন। আবার অনেক ব্যবসায়ি গ্রামে গ্রামে ঘুরে আটি সংগ্রহ করেন। এ উলু ফুল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন অসংখ্য পরিবার।


খাগড়াছড়ি বন বিভাগের বন কর্মকর্তা কার্যালয় জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে এ লেখা পর্যন্ত ১২৩০০০ ব্রুম (উলু ফুলের পরিমান) তার রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪,৩০,৫০০ টাকা। শহরের কলেজপাড়া ও খবংপড়িয়া সড়কের উলু ফুল শুকানোর মাঠে গিয়ে দেখা যায়, বোরো মৌসুমের ধান চাষ করা হয় না এমন ফসলি জমিতে এক সাথে চারটি খোলায় কয়েকশ যুবক শ্রমিক উলু ফুল রোদে শুকানোর কাজে ব্যস্ত। কেউ শুকনা ফুল বেঁধে রাখছেন। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে পাঠাতে ট্রাকে ভর্তি করছেন।


খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভিত বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে উলু ফুল প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়। ভালো লাভ হয় বলে গত দুই তিন বছর ধরে স্থানীয়রা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন। কোন পানি দিতে হয় না, বিনা পরিচর্যায় সহজেই চাষ করা যায়। শুধু লাগিয়ে দিলেই হয়ে যাচ্ছে। 


আরও পড়ুন: আখাউড়ায় ৫০ লাখ টাকার ভারতীয় আতশ বাজি উদ্ধার করেছে বিজিবি


খাগড়াছড়ি স্থানীয় উলু ফুল ব্যবসায়ি মোঃ নাসির উদ্দিন বলেন, বাজারে এর দাম একটু কম। ইদানিং দেখা যাচ্ছে ভারত, নেপাল ও মায়ারমার থেকে কিছু মাল দেশে আসছে। বিশেষ করে ভারতের কিছু চোরায় পথে মাল আসে যার কারণে আমাদের বাজারে মূল্য একটু কম। সরকার যদি চোরায় পথে যে মাল আসে এগুলো বন্ধ করলে আমাদের বাজার দাম অনেক বেড়ে যাবে। আমাদের পাহাড় থেকে আরো বেশি সংগ্রহ করে বাজারজাত করতে পারব।


কথা হলে স্থানীয় উলু ফুল ব্যবসায়ি মোঃ মানিক বলেন, এই বছর মালের দাম বেশি, কিন্তু ফুল কম। সদর ছাড়া মহালছড়ি-দীঘিনালাসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে সংগ্রহ করি। আমার মাঠে পনের থেকে ২০ জন শ্রমিক প্রতিদিন কাজ করে। এই মাঠ থেকে ২০ থেকে ২৫ ট্রাক মাল যায়। এখানে কোটি টাকার বেশি ইনভেস্ট করতে হয়। আর এক উলু ফুল স্থানীয় ব্যবসায়ি মোঃ মমতাজ উদ্দিন বলেন, (১৮, ১৯ ও ২০টি) করে বেঁধে এক আটিঁ উলু ফুলের দাম ছিল ১৬-১৭ টাকা আর এ বছর হয়েছে ২২-২৩ টাকা। গত বছরের তুলনায় এ বছর উলু ফুলের দাম বেশি। ব্যবসায়ি কম তাই বিক্রি হয়েছে কম। ঢাকা থেকে আসা উলু ফুল ব্যবসায়ি মোঃ রেজাউল, মোঃ শহীদ বলেন, খাগড়াছড়ি জেলা ছাড়া রাঙামাটির বাঘাইছড়ি ও লংগদু উপজেলা থেকে শুকনা উলু ফুল স্থানীয় ব্যবসায়ি থেকে কিনে নিয়ে যায়। এক মৌসুমে ১৪-১৫ ট্রাক ঢাকা, রাজশাহী, সিলেটসহ সারাদেশে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করি।


ঢাকা উলু ফুল ব্যবসায়ি মোঃ নায়িম বলেন, উলু ফুল দেশীয় শিল্প। ষোল বছর ধরে খাগড়াছড়িতে উলু ফুল ব্যবসা করে যাচ্ছি। পূর্বপুরুষরাও এ ব্যবসা করে গেছেন। চলতি মৌসুমে দশ ট্রাকের বেশি ফুল পাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। খাগড়াছড়ি বন বিভাগের বন কর্মকর্তা বলেন, ফুল ঝাড়ুতে কোন পরিচর্যা করতে হয় না, পানি লাগে না এবং প্রতি বছর এখান থেকে যে ফুল সংগ্রহ হবে পাহাড়ের অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধি হবে।


আরও পড়ুন: নাফনদীর ওপার থেকেই ঘুরে গেল মিয়ানমারের যুদ্ধ জাহাজ


সরকারি বিভিন্ন খাস জমি ও অন্যান্য জমিতেও প্রচুর পরিমান ঝাড়ু ফুল জন্মে এগুলো যদি স্থানীয় জনগোষ্ঠীরা আগুন না দেয় এবং জুম চাষের সময় নষ্ট না করে তাহলে এগুলো সংরক্ষন করে এখান থেকে ব্যাপক পরিমান ফুলের ঝাড়ু সংগ্রহ করতে পারবে এবং অথনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে সমৃদ্ধ হতে পারে এবং দেশের যে পরিমান ফুলের ঝাড়ুর চাহিদা সেটাও এখান থেকে মেটাতে পারে।


খাগড়াছড়ি উলু ফুল সমবায় সমিতি সাধারণ সম্পাদক মোঃ নাসির উদ্দিন বলেন, খাগড়াছড়ি জেলা ছাড়া রাঙমাটির বাঘাইছড়ি, লংগদু উপজেলাসহ মিলে এক মৌসুমে প্রায় আটশ ট্রাক মাল যায় সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এতে খাগড়াছড়িতে এক মৌসুমে ৫০ কোটি টাকার উলু ফুলের বাণিজ্য হয়। খাগড়াছড়িতে স্থানীয় পঞ্চাশ জন ব্যবসায়ি আছে। পঞ্চাশ জন ব্যবসায়ির অধিনে প্রায় ২০ হাজার জন শ্রমিক কাজ করে তাদের সংসার জীবন জীবিকা চলছে। উলু ফুলের প্রতি অনেকের নজরই নেই।


খাগড়াছড়ি বন বিভাগের বন কর্মকর্তা মোঃ ফরিদ মিঞা বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে ফুলের ঝাড়ু (উলু ফুল) এক সময় অবহেলিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে চাহিদার কারণে এটা খুবই মূল্যবান হয়েছে। এখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠী কম পরিশ্রমে, কম বিনিয়োগে এটা থেকে ফসল পাচ্ছে। চাহিদা থাকায় বেশ চড়া দামে বিক্রিও হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়িরা এখান থেকে সংগ্রহ করে বন বিভাগের কার্যালয়ে সরকারি রাজস্ব জমা দিয়ে পরিবহন করে ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নিয়ে যায় এবং বেশ ভালো দামে বিক্রি করে। বন বিভাগ এটা আরো জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে।


তিনি বলেন, ফুল ঝাড়ু নিয়ে কেউ বাগান করতে চাইলে এবং বাঁচিয়ে রাখতে যা যা করা প্রয়োজন আমরা তা করার জন্য প্রস্তুত আছি। ঝাড়ু ফুল যত আকর্ষণীয় করতে পারবে এবং যত প্যাকেজিং ও সুন্দর করতে পারবে তাহলে এটির দেশের বাহিরেও চাহিদা আছে। আমরা যদি দেশের বাহিরে রফতানি করতে পারি তাহলে আমরা আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করতে পারি এবং স্থানীয় মানুষরা আরো অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হতে পারে। তিনি বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থ বছেরে এখন পর্যন্ত চাল লাখ উনষাট হাজার পাঁচশ টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। এক মৌসুমে এটা দু-এক গুণ বেড়ে যায়।


এমএল/