যারা ভেঙ্গেছেন তারাই বানিয়ে দিবেন কুষ্টিয়ার সেই লালন অনুসারীর ঘর


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১১:০২ পূর্বাহ্ন, ১লা জুলাই ২০২৪


যারা ভেঙ্গেছেন তারাই বানিয়ে দিবেন কুষ্টিয়ার সেই লালন অনুসারীর ঘর
ছবি: জনবাণী

৮০ বছর বয়সী চায়না বেগমের ইচ্ছে ছিল লালন অনুসারী মৃত স্বামীর কব‌রে মাথা ঠে‌কি‌য়ে বা‌কিটা জীবন কা‌টি‌য়ে‌ দিবেন। ভিটেমাটিতে প্রতিদিন জ্বালাবেন সন্ধ্যা প্রদীপ। নি‌জের লালন অনুসারী হওয়ায় স্বামীর কব‌রের পা‌শেই নিজ জ‌মি‌তে তু‌লে‌ছি‌লেন টি‌নের চাঁলার ঘর। কিন্তু বাদ সাধ‌লেন এলাকার মেম্বার ও মাতবররা। ভ‌বিষ‌্যতে ওই স্থা‌নে মাজার, মাদক সেবন ও কি‌শোর গ‌্যাং‌য়ের আড্ডাস্থল হ‌তে পা‌রে এমন অ‌ভি‌যোগ তু‌লে এক‌দিন সকা‌লে ‌স্থানীয় আরো ক‌য়েকজন‌কে নি‌য়ে বৃদ্ধার ঘর‌টি ভে‌ঙে ফে‌লেন। দি‌শেহারা বৃদ্ধা প্রতিবাদ ক‌রতে গে‌লে উল্টো লা‌ঞ্চিত হন। কোন কুল কিনারা কর‌তে না পে‌রে চায়না‌ বেগম অ‌ভি‌যোগ ক‌রেন কু‌ষ্টিয়া ম‌ডেল থানায়। 


শুক্রবার (২৮ জুন) ত‌বে শেষ সংবাদ পাওয়া পর্যন্ত বি‌কে‌লে থে‌কে সন্ধ‌্যা পর্যন্ত থানায় চলা উভয়প‌ক্ষের বৈঠকে চায়না বেগমকে অন‌্যত্র এক‌টি নতুন ঘর তৈ‌রি করে দেওয়া স‌ত্ত্বে অ‌ভি‌যোগ ‌মিমাংসা হয়ে‌ছে ব‌লে জানা গে‌ছে। তবে ইচ্ছের বিরু‌দ্ধে মিমাংসা কর‌তে বাধ‌্য করা হ‌য়ে‌ছে কিনা জান‌তে চাইলে চায়না বেগম ব‌লে‌ছেন সম্ম‌তি দি‌য়ে‌ছি। আক্ষেপ আছে কিনা জান‌তে চাইলে কথা ব‌লেন‌নি। 


আরও পড়ুন: মসজিদে মাইকিং করে লালন অনুসারী বৃদ্ধার ঘর ভাঙচুর


এর আগে ২৬ জুন (বুধবার) সকাল ৬টায় কু‌ষ্টিয়া সদর উপ‌জেলার টা‌কিমারা এলাকায় ঘর ভাঙচু‌রের ঘটনা ঘ‌টে‌। 


এলাকার বি‌ভিন্ন মানু‌ষের কাছে খোঁজ নি‌য়ে জানা গে‌ছে,চায়না‌ বেগ‌ম ও তার স্বামী মৃত গা‌জির উদ্দিন দুইজ‌নেই ছি‌লেন বাউল ফ‌কির লালন সাঁইজির অনুসারী। মৃত‌্যুর পর গা‌জির উদ্দিন‌কে মা‌ঠের ম‌ধ্যে নিজ জ‌মিতে কবর দেওয়া হয়।  


চায়না বেগমের সা‌থে কথা হ‌লে তি‌নি প্রতি‌বেদক‌কে জা‌নি‌য়ে‌ছি‌লেন তার স্বামী মৃত্যুর আগে বলে গেছেন, কোথাও জায়গা নাহলে তুমি আমার কবরের পাশেই থাকবা। প্রতিবছর বাতাসার সিন্নি হলেও করবা। তার কথা রাখতেই ঘরখানা তৈয়ার করি। এলাকাবাসী তাকে কিছু জা‌নি‌য়েছিল জান‌তে চাইলে তি‌নি জা‌নি‌য়েছি‌লেন আমাকে না জানিয়েই সব ভেঙে ফেলেছে। ঘটনা জানতে পেরে প্রতিবাদ করে হামলার শিকারও হয়েছেন। 


স্থানীয়রা জানান,ঘটনার দিন ভো‌রে মুস‌ল্লিরা স্থানীয় মস‌জি‌দে ফজ‌রের নামাজ আদায় কর‌তে গে‌লে নামাজ শে‌ষে ইমাম সা‌হেব মাজারকে ইসলাম ধর্মের প‌রিপন্থী জা‌নি‌য়ে আলোচনা ক‌রেন। এলাকার সাবেক ইউপি মেম্বার এনামুল হক, মাতবর মোশারফ হোসেনসহ বেশ ক‌য়েকজ‌নের ইন্ধ‌নে এই আলোচনা হয়। এরপ‌রেই সা‌বেক ইউপি সদস‌্যর নেতৃ‌ত্বে এলাকার ক‌য়েকজন লালন অনুসারী ওই বৃ‌দ্ধার ঘর ভাঙচুর ক‌রে।


চায়না বেগ‌ম এলাকার সাবেক ইউপি মেম্বার এনামুল হক, মাতবর মোশারফ হোসেন, আনার মণ্ডল ও সাইদুল হাজির নাম উল্লেখ করে তাঁদের বিরুদ্ধে বাড়িঘর ভাঙচুর করে অন্তত লক্ষাধিক টাকার ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনেন তিনি। 


ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তা ম‌ডেল থানার এস আই খায়রুজ্জামান জানি‌য়ে‌ছেন, শুক্রবার বিকেল চারটায় কুষ্টিয়া মডেল থানায় উভয়পক্ষকে ডেকে বৈঠকে বসেন। সেখানে চায়না বেগম ও বোন জামাই সাধু শাহাবুদ্দিন সাবুসহ স্থানীয় কাউন্সিলর মাতব্বর ও অভিযুক্তরা উপস্থিত ছিলেন। চায়না বেগমের অনুমতি সাপেক্ষে এবং সকলের সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়,ওই জ‌মির পাশেই চায়না বেগমের ছেলে ম‌জিবুর রহমা‌নের ভিটা রয়েছে। সেই ভিটায় আলাদা করে চায়না বেগমের জন্য নতুন করে বসতভিটা করে দেয়া হবে। এবং সেই বসতভিটা নির্মাণ খরচ বহন করবে অভিযুক্ত সকলেই। 


বৈঠ‌কে থাকা পৌর কাউন্সিলর এজাজ আহমেদ জা‌নি‌য়ে‌ছেন, ওসির উপস্থিতিতে সকলে একমত পোষণ করেন যে, যেখানে চায়না বেগ‌মের ঘর ছিল সেই স্থান লোকশুন্য, মাদকের আস্তানা এবং কিশোরগ্যাং-এর আনাগোনা। তাই  সেখানে বৃদ্ধার একলা থাকা অনিরাপদ এবং ঝুঁকিপূর্ণ। 


আরও পড়ুন: কুষ্টিয়ায় তিন দিন ব্যাপী কৃষি মেলার উদ্বোধন


অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে সা‌বেক ইউপি সদস‌্য এনামুল হক বলেন,ওই বৃদ্ধা বাড়ি করেছেন একটি মাঠের মধ্যে ফাঁকা জায়গায়৷ সেখানে যাওয়ার পথ নেই, তাকে দেখারও কেউ নেই৷ এছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের আস্তানা হওয়ার আশঙ্কায় তার ঘরটি এলাকাবাসী ভেঙে দিয়েছে৷ 


মিমাংসার পর মু‌ঠো‌ফো‌নে কথা হয় চায়না বেগ‌মের সাথে। বয়‌সের ভা‌রে কথা স্পষ্ট বল‌তে পার‌ছি‌লেন না। তা‌কে মিমাংসা কর‌তে চাপ দেওয়া হ‌য়ে‌ছিল কিনা জান‌তে চাইলে তি‌নি জানান,সম্ম‌তি দি‌য়ে‌ছিলাম। কোন আক্ষেপ আছে কিনা এমন প্রশ্নে কথা ব‌লেন‌নি তি‌নি। 


নির্মাণ হবে চায়না বেগমের নতুন বসত ঘর। কিন্তু সেটা স্বামীর কবর থে‌কে দু‌রে। সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানো হবে না স্বামীর কবরের পাশে থেকে। ত‌বে কি চায়না বেগমের আক্ষেপ রয়েই গেল, হলো না স্বামীর কবরের পাশে থাকা" এখন এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খা‌চ্ছে স্থানীয়‌দের ম‌ধ্যে। 


জেবি/এজে