বৃষ্টির সাথে পাহাড় কাটার কৌশলে এনজিও কর্মকর্তা


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৮:৩৫ অপরাহ্ন, ৩১শে জুলাই ২০২৪


বৃষ্টির সাথে পাহাড় কাটার কৌশলে এনজিও কর্মকর্তা
ছবি: প্রতিনিধি

বৃষ্টি নামলে কক্সবাজারে পাহাড় কাটা নতুন কিছু না। দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টিতে পাহাড় কেটে মাটি সরিয়ে দেয়ার কৌশলটি ব্যবহার করে আসছে জড়িত চক্রটি। আর সম্প্রতি ভারী বৃষ্টিতে সেই কৌশলে পাহাড় কাটা শুরু করেছেন একটি এনজিও শীর্ষ কর্মকর্তা। 


তিনি আবার বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা নেতাও। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে শ্রমিক এনেই কাটা হচ্ছে এই পাহাড়। আর সেই একাধারে এনজিও কর্মকর্তা এবং বাপা নেতা শ্রমিকদের নিদের্শ দিয়ে রেখেছেন পাহাড় কাটার সময় কেউ বাঁধা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলে যেন হামলা করা হয়।যদিও এনজিও কর্মকর্তা বিষয়টি অস্বীকার করে ভিন্ন কথা বলেছেন।


আরও পড়ুন: বৃষ্টিতে কক্সবাজারের ২০০ গ্রাম প্লাবিত


কক্সবাজারে গত কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। কক্সবাজার আবহাওয়ার কার্যালয়ের সহকারি আবহাওয়াবিদ আবদুল হান্নান জানিয়েছেন, বুধবার (৩১ জুলাই) সকাল ৬ টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় কক্সবাজারে ২৭০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের রেকর্ড করা হয়েছে। সকাল ৬ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত ১২ ঘন্টায় মোট বৃষ্টিপাতের পরিমান ৭০ মিলিমিটার। আগামি ৩ দিন ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের আশংকার কথা জানিয়েছেন তিনি।

তিনি জানান, সমুদ্র বন্দরে শক্তিশালী সক্রিয় মৌসুমি বায়ু এবং এর জন্য সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরী হওয়ার ফলে কক্সবাজারকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেয়া হয়েছে

গত এক মাসে অতি বৃষ্টিতে কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ক্যাম্প সহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় অনন্ত অর্ধ শত স্থানে পাহাড় ধসেবর ঘটনা ঘটেছে। যেখানে এক মাসে প্রাণ হারিয়েছে ১১ রোহিঙ্গা সহ ১৮ জন। এরপরও জেলায় পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে।


গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে জেলার অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি কলাতলী বাইপাস সড়কের জেলা কারাগার সংলগ্ন এলাকায়ও চলছে এ পাহাড় কাটা। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির নিদের্শে প্রকাশ্যে পাহাড় কাটার খবর পেয়ে জেলা কারাগার সংলগ্ন রহমতপুর এলাকায় গিয়ে দেখা মিলে এই পাহাড় কাটার দৃশ্য।

 

আরও পড়ুন: কক্সবাজারের ৭ মামলায় গ্রেফতার আরও ৮

মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় ৭/৮ শ্রমিক বৃষ্টির সাথে সাথে পাহাড় কেটে মাটি সরিয়ে দিচ্ছে পানি চলাচলের ছড়ায়। যা পানির ঢলে সাথে নেমে যাচ্ছে নিচুর দিকে। যেখানে ক্যামেরা ভিডিও ধারণ ও ছবি তোলতে গেলেই ডাক দেন এক শ্রমিক।


ওই শ্রমিক প্রতিবেদককে উদ্দেশ করে (আঞ্চলিক ভাষায়) বলেন, ছবি তোলে কোন লাভ হবে না। সব ব্যবস্থা করেই পাহাড় কাটা হচ্ছে। কেউ বাঁধা দিলে মারধরের নিদের্শ দিয়ে রেখেছেন পাহাড়ের মালিক।

কে সেই মালিক এমন প্রশ্নের উত্তরে মিলেছে একটি নাম। তিনি পালস বাংলাদেশ সোসাইটির নিবার্হী পরিচালক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী কলিম। কলিম আবার বাপার কক্সবাজার জেলার নেতাও। তাকে এনজিওদের নানা কর্মকান্ডের পাশাপাশি দেখা মিলে পরিবেশ বিষয়ক নানা অনুষ্ঠান, মানববন্ধন সমাবেশেও। কথা বলেন পরিবেশ রক্ষা বিষয়ক।


পাহাড় কাটায় জড়িত শ্রমিকদের উত্তেজনাকর মারমুখি আচরণে ওই স্থান থেকে কৌশলে সরে আসেন প্রতিবেদক। কথা বলেন আশে-পাশের এলাকাবাসির সাথে। সাইফুল ইসলাম চৌধুরী কলিমকে চেনেন প্রভাবশালী এক শীর্ষ ব্যক্তি। যে পাহাড়টি কাটা হচ্ছে তার মালিক তিনি। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে শ্রমিক এনেই এসব পাহাড় কাটা শুরু করা হয়েছে। শুধু তার এই পাহাড় না আশে-পাশের পাহাড় কাটার ক্ষেত্রেও রয়েছে কলিমের নির্দেশনা ও সহায়তা। তার অনুমতিতেই রোহিঙ্গা শ্রমিক দিয়ে পাহাড় কাটছেন অনেকেই। এসব রোহিঙ্গা শ্রমিকরা খুবই খারাপ প্রকৃতির এবং হামলা মারধর করতে ভয় করেন না। আর এসব রোহিঙ্গা শ্রমিকদের নেতা হিসেবে রয়েছেন ওই এলাকার জনপ্রতিনিধি ঝিলংজা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ ইউনুছ।


আরও পড়ুন: কক্সবাজারে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠে বিজিবি-পুলিশ-র‌্যাব


ওই স্থানের খুব নিকটেই কলিমের সহায়তায় আরও একটি পাহাড় কটতে দেখা গেছে। যে পাহাড়টি কাটছেন মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির নির্দেশে। তিনি ওই এলাকার জিমাবুল হকের ছেলে। তার স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রামের বাঁশখালীর পুইছড়ি। কলিমের নিকটজন হিসেবে পরিচিত নিজাম। আর ওই পাহাড় কাটার স্থানে শ্রমিকদের নিদের্শনা দিতে দেখা গেছে ইউপি সদস্য মোহাম্মদ ইউনুছকে।

ওই এলাকার যুবক সাইফুল ইসলাম বলেন, পাহাড় খেকোরা শুধু পরিবেশ ধ্বংস করার পাশাপাশি দেশ ও জাতির শক্রতা করছে। তাদের কারণেই প্রতি বছর পাহাড় ধসে অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে।


আরেক ব্যক্তি মোবারক আলী বলেন, ‘কিছু করার নেই। এই দৃশ্য দীর্ঘ দিন ধরে দেখে আসছি। ভারী বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটলেই প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। বাকী সময় চুপ থাকে। এছাড়া বরাবরই দূর্বল লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রভাবশালীরা পার পেয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে সব পাহাড় সমান হয়ে যাবে। প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া অবশিষ্ট পাহাড় রক্ষা করা সম্ভব নয়’।

এব্যাপারে পালস বাংলাদেশ সোসইটির নিবার্হী পরিচালক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী কলিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ওই এলাকায় আমার একটি জায়গা রয়েছে। যেখানে গাছ লাগানোর জন্য কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছেন। আমার জায়গায় পাহাড় কাটার কথা না। যে জায়গাটিতে পাহাড় কাটা হচ্ছে এটা অন্য কারও হতে পারে।

নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘পাহাড়ে আমার জায়গা আছে। কিন্তু আমি কোন পাহাড় কাটি নাই। গত ১ মাসেও আমি কোন পাহাড় কাটি নাই। তবে পাহাড় থেকে একটা গাছ পড়েছে। সেই গাছটির মাটি সরানোর জন্য শ্রমিকরা কাজ করছেন।

ইউপি সদস্য মোহাম্মদ ইউনুছের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।


আরও পড়ুন: কক্সবাজারে কোটা আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ভাংচুর


কক্সবজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আতাউল গণি ওসমানী জানান, ‘যারা পাহাড় কাটছে তারা অবশ্যই অপরাধী। সে যেই হউক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে বরাবরই সচেতন করা হচ্ছে, পাহাড় কাটা বন্ধে এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা লোকজনকে সরে যাওয়া জন্য। যারা পাহাড় ধ্বংস করছে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবেনা’।


পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন জানান, যারা পাহাড় কাটছে তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর নিয়মিত মামলা করছে। তারই ধারাবাহিকতায় পাহাড় খোকো যতই প্রভাবশালী হউক না কেন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


এসডি/