সাইফুলের ওই হাত আমাকে আজীবন ডাকবে: আইনজীবী শহীদুল


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭:৪৩ অপরাহ্ন, ২৭শে নভেম্বর ২০২৪


সাইফুলের ওই হাত আমাকে আজীবন ডাকবে: আইনজীবী শহীদুল
ছবি: সংগৃহীত

জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফ চট্টগ্রাম আদালতের বিপরীতে রঙ্গম কনভেনশন হলের গলিতে নির্মমভাবে ঘাতকদের হাতে খুন হন। ঘটনার সময় তার সঙ্গে ছিলেন জেলা আইনজীবী সমিতির আরেক সদস্য অ্যাডভোকেট শহীদুল আলম রাহাত। মৃত্যুর আগে প্রাণপনে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলেন সাইফুল ইসলাম। 


ঘটনাটি নিয়ে মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক আইডিতে একটি স্ট্যাটাস দেন শহীদুল আলম। 


তিনি লেখেন, ‘ভাইয়া আমার পা মচকে গেছে। আমাকে নিয়ে যান!’ সাইফুল, ক্ষমা কইরো ভাই। তোমার ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো ঈমানি চেতনা আমাদের ছিল না। হায়েনাদের হাত থেকে তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না।


আরও পড়ুন: সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করবেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা


ওই স্ট্যাটাসে অ্যাডভোকেট শাপলা ইয়াসমিন নামে এক আইনজীবীর মন্তব্যের বিপরীতে শহীদুল আলম রাহাত লেখেন, আইনজীবীদের মধ্যে আমি সম্ভবত সাইফুলের সবচাইতে নিকটে ছিলাম। আমার দিকে হাত দেখিয়ে বলেছিলো, ভাইয়া আমার পা মচকে গেছে। আমাকে নিয়ে যান। আমি কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে তার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু হায়েনাদের ইট, পাটকেল আর মুহুর্মুহু কাচ ভাঙার আঘাতের কারণে আমিসহ সবাই পেছনে সরে যাওয়ায় সাইফুল সম্পূর্ণ একলা হয়ে যায়। এই অবস্থায় সাইফুলকে স্পটে একা পেয়ে হ্যালমেট পরা এক হায়েনা কুপিয়ে সাইফুলকে শহীদ করে। সাইফুলের ওই হাত আমাকে আজীবন ডাকবে।


শহীদুল আলম রাহাত ২০১২ সালে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হন। ২০১৫ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে নিবন্ধিত হন। 


গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ইসকনের অনুসারীরা হামলা চালিয়েছে। আমাদের ধারণা, তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরাও যোগ দিয়েছে। ঘটনার শুরু মঙ্গলবার দুপুর ৩টার দিকে। প্রিজন ভ্যান আটকে দেওয়া বিক্ষোভকারীদের সরানোর চেষ্টা করে পুলিশ ও বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে আদালত চত্বর থেকে পিছু হটে বিক্ষোভকারীরা। নেমে যাওয়ার সময় বিক্ষোভকারীরা কোর্ট বিল্ডিংয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ ও দোকানপাটে ভাঙচুর করে। এসময় তারা বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলও ভাঙচুর করে। 


তিনি আরও বলেন, এরপর তারা কোর্ট বিল্ডিংয়ের প্রধান ফটকের আগে জড়ো হয়ে আইনজীবীদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের ধাওয়া দেয়। সঙ্গে কিছু আইনজীবী এবং জনগণ অংশ নেয়। বিক্ষোভকারীরা আদালতের প্রধান ফটকের বিপরীতে অর্থাৎ রঙ্গম হলের গলিতে ঢুকে যায়। বেলা সোয়া ৪টার দিকে ৪ থেকে ৫ জন আইনজীবীসহ মোট ১৫ থেকে ২০ জন তাদেরকে ধাওয়া দিতে দিতে ওই সড়কের ভেতরে ঢুকে পড়ি। তখনও প্রধান সড়কে শতাধিক লোকজন ও আইনজীবী ছিলেন। সঙ্গে পুলিশও ছিল। 


আরও পড়ুন: অ্যাডভোকেট আলিফের জানাজায় হাসনাত-সারজিস 


ওরা তখন গলির ভেতর থেকে পাথর ছুড়ছিল। আমরাও তাদের পাথর ছুড়তে ছুড়তে ভেতরে পাঠিয়ে দিই। কিছুদূর যাওয়ার পর আমাদের সংগ্রহে থাকা পাথর শেষ হয়ে যায়। তখন ওরা আমাদের লক্ষ্য করে পাথর এবং কাচ ভাঙা দিয়ে হামলা শুরু করে। তখন আমরা পিছু হটে যাই। এসময় আমি ও সাইফুলসহ মোট ৫ থেকে ৬ জন ছিলাম। একপর্যায়ে পা মচকে গিয়ে সাইফুল পড়ে যায়। তখন সাইফুল আমাকে উদ্দেশ্য করে বাঁচার আকুতি জানায়। কিন্তু উপর্যুপরি হামলার কারণে আমরা তাকে আর আনার সুযোগ পাইনি। 


হামলাকারীদের চেনেন কি না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গেঞ্জি ও হেলমেট পরা একজন লোক সবার আগে আক্রমণ শুরু করে। এরপর অন্যরা হামলা করে। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া কাউকেই আমি চিনি না। বিশেষ করে সামনের সারিতে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে ওইরকম কাউকে আমি চিনতে পারিনি। যদিও পরবর্তীতে আমরা ফুটেজে দেখেছি সাদা শার্ট পরিহিত কয়েকজন হামলা করেছে। 


অ্যাডভোকেট সাইফুলকে উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে এই আইনজীবী বলেন, সাইফুলের ওপর হামলার কয়েক মিনিট পর আমরা পুনরায় লোকজন নিয়ে সাইফুলকে উদ্ধারে যাই। কিন্তু ততক্ষণে হামলাকারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সাইফুল অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে।


পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে শহীদুল আলম বলেন, পুলিশের ভূমিকা শুরু থেকে নিষ্ক্রিয় ছিল। সকাল থেকে পুলিশ সক্রিয় থাকলে এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই ঘটত না।


অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকার বাসিন্দা। তার বাবার নাম জালাল উদ্দিন। তিনি ২০১৮ সালে জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হন। পরবর্তীতে তিনি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে নিবন্ধন পান।


আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যা, যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক ২০


বুধবার (২৭ নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১০টার দিকে সাইফুলের প্রথম জানাজা চট্টগ্রাম আদালত এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দ্বিতীয় জানাজা দুপুর ১২টার দিকে নগরের জমিয়তুল ফালাহ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সর্বস্তরের জনসাধারণের ঢল নামে। জানাজা শেষে নগরের টাইগারপাস মোড়ে সমাবেশ করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। 


এতে অংশ নিয়ে বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। 


সমাবেশে ইসকনকে জঙ্গি সংগঠন আখ্যা দিয়ে ইসকন নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়। এসময় ইসকন ও ভারতবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেয় ছাত্র-জনতা।


প্রসঙ্গত গত সোমবার বিকেলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা চিম্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করে। গতকাল তাকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন। এ নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন ইসকন অনুসারীরা। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয় বিক্ষোভকারীদের।


এমএল/