মেঘনা পেট্রোলিয়াম তেল চুরির টাকা এমডি'র পকেটে
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ১২:০৬ অপরাহ্ন, ২৩শে জানুয়ারী ২০২৫
# চুরির কৌশল, সিস্টেম লস দেখিয়ে চুরি
# প্রতিবাদ করলে বিপত্তিতে নিরাপত্তাকর্মী
# এমডির ক্যাশিয়ার ডিজিএম লুৎফর
# আমি এই চুরির সঙ্গে জড়িত নন
-মো. টিপু সুলতান এমডি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম
রাষ্ট্রায়ত্ত তেল বিপণন প্রতিষ্ঠান মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ২১ ডিপো থেকে তেল চুরির অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে এই অপকর্ম চললেও বেশির ভাগ সময়ই তা ধরা পড়ে না। মাঝেমধ্যে ধরা পড়লেও শাস্তি হয় না জড়িতদের।
অভিযোগ রয়েছে, খোদ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থপনা পরিচালক মো. টিপু সুলতান তেল চুরির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিপত্তিতে পড়েছেন নিরাপত্তাকর্মীসহ অনেকেই। প্রতি মাসে তেল চুরির ১০ কোটি টাকা যাচ্ছে সিন্ডিকেটের পকেটে। এমডি পাচ্ছেন আয়ের অর্ধেক।
আরও পড়ুন: বিনাটেন্ডারে অর্ধকোটি টাকার কাজ, প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ
অভিযোগ সূত্র বলছে, সারা দেশের ২১টি ডিপোতে তেল সরবরাহ করা হয়। প্রতিটি লরিতে (তেলবাহী গাড়ি) ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন মিলে গড়ে ৯ হাজার লিটার জ্বালানি তেল পরিবহন করা হয়। এসব লরির ধারণক্ষমতা ১০ হাজার লিটার। দুর্ঘটনা এড়াতে এক হাজার লিটারের জায়গা সাধারণত ফাঁকা রাখা হয় প্রতিটি লরিতে।
কেউ চাইলে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ হাজার লিটার পর্যন্ত তেল পরিবহন করতে পারে। মূলত যে স্থানটি ফাঁকা থাকে সেখানেই ২০০ থেকে ৫০০ লিটার পর্যন্ত অতিরিক্ত তেল পরিবহন করে চক্রটি। এই তেলের জন্য কোনো অর্থ পরিশোধ করা হয় না। তেলবাহী লরি বাইরে বের হওয়ার পর সুবিধাজনক স্থানে ওই তেল নামিয়ে তা বিক্রি করে দেয় তারা। প্রায় প্রতিদিনই এভাবে তেল চুরি হয়। পরে চুরি যাওয়া এই তেল সিস্টেম লস, ট্রান্সপোর্ট লস হিসেবে সমন্বয় মেঘনা কর্তৃপক্ষ সমন্বয় করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি এমআই, ফতুল্লা, বাগাবাড়ি, পতেঙ্গা গুপ্তখাল এলাকায় মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ডিপো থেকে তেলবাহী গাড়ি বের হওয়ার সময় দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীরা তা পরীক্ষা করতে গেলে তারা বাধার মুখে পড়েন। এ সময় তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। কিন্তু পরে এই ঘটনা জানাজানি হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো নিরাপত্তাকর্মীদের চাকরি হারানোর হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র বলছে, প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা জোনের ডিজিএম মো.লুৎফর রহমান এমডির ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করছেন। ডিপো থেকে প্রতি মাসে টাকা কালেকশন করেন তিনি। এর পরে সিন্ডিকেটের সঙ্গে ভাগ করে নেন।
সম্প্রতি মেঘনা পেট্রোলিয়ামের প্রধান স্থাপনা থেকে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে মেসার্স আবদুর রউফ অ্যান্ড সন্সের নামে একটি গাড়িতে তেল ভর্তি করা হয়। গাড়িটি ‘সিকিউরিটি পয়েন্টে’ পৌঁছানোর পর সন্দেহ হলে অতিরিক্ত একটি ড্রাম পাওয়া যায়, যেখানে প্রায় ২০০ লিটার ডিজেল ছিল। একই ভাবে গত সপ্তাহে ফতুল্লা ডিপোতে গিয়ে দেখা গেছে দুটি গাড়িতে তেল ভর্তি করে বের হচ্ছেন। এই সময় গাড়িতে অতিরিক্ত একটি ড্রাম দেখা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, সরাসরি তেল চুরির সঙ্গে জড়িতদের বেশির ভাগই শ্রমিক। এদের পরোক্ষ সহায়তা করছেন কোম্পানির ব্যবস্থপনা পরিচালক মো. টিপু সুলতান। কেউ এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে নানাভাবে হেনস্তা করা হয়। বিশেষ করে নিরাপত্তাকর্মীরা নানা রকম ভয়ভীতির শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
যেভাবে চুরি হয় জ্বালানী তেল:জ্বালানী তেল বিক্রির সাথে সংশ্লিষ্ট এমন একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ডেলিভারির সময় ডিপো থেকে পরিমাপে তেল কম দেয় সরকার নিয়ন্ত্রিত জ্বালানী তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিঃ (এমপিএল)। আবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সিস্টেম লস দেখানো হয়। এভাবে অতিরিক্ত তেল তারা সুযোগ বুঝে তাদের নিধারিত পার্টির কাছে অপেক্ষাকৃত কম দামে বিক্রি করে। সঠিক পরিমাপে তেল না পাওয়ায় আরেক দফা চুরি করে পাম্প মালিক ও কর্মচারীরা। আর চোর সিন্ডিকেটে নিয়ন্ত্রণ করেন প্রতিষ্ঠানের এমডি। এভাবে গ্রাহকের কাছে পৌছাতে শতকরা ৫ থেকে ৬ শতাংশ তেল চুরি হয়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে পরিবহন থেকে শুরু করে পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে।
বদলেছে চুরির কৌশল: বিগত সময়ে তেল চুরির সাথে জড়িত পেট্রোল পাম্পকে মাঝে মাঝে আইনের আওতায় আনতে পারলেও বর্তমানে এরা কৌশল বদলিয়ে ডিভাইস বসিয়ে তেল চুরি করছে। যা ধরা খুবই কঠিন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। তারা বলছেন, তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা সঠিক পরিমাপে তেল দেয়না। সেখান থেকেই চুরিটা শুরু হয়। আর চুরি করে যে তেল তারা জমায় তা পরে অন্যত্র অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে বিক্রি করে দেয়। পাম্পে আগে এনালগ মিটারে তেল বিক্রি করা হতো। এখন সব পাম্পে তেল বিক্রির জন্য বিএসটিআই অনুমোদিত ডিজিটাল মিটার ব্যবহার করা হয়।
আরও পড়ুন: মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড টেন্ডার জালিয়াতির মাস্টার ইনাম
বিএসটিআই, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর ও র্যাব প্রায়ই অভিযান চালিয়ে তেল কম দেওয়ার অভিযোগে জরিমানা ও পেট্রোল পাম্পের সংশ্লিষ্ট ইউনিট সিলগালা করে দেয়। কিন্তু এখন তেল মাপে কম দেওয়ার জন্য ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা হয়। ডিভাইসটি পাম্পের ভেতরে লাগানো হয়। এটা লাগিয়ে দিলে নির্দিষ্ট পরিমাণ তেল স্বয়ংক্রিয়ভাবে কম বের হবে। কেউ বুঝতে পারবে না। আবার কোন সংস্থা অভিযান চালালে তা এক মিনিটের মধ্যেই সঠিক পরিমাপে সেট করা সম্ভব। ডিভাইসটির জন্য আলাদা টেকনিশিয়ান আছে। সে এসে নিজেই ডিভাইস লাগিয়ে দেয়। এই ডিভাইসের সঙ্গে আবার সুইচ রয়েছে। ইচ্ছামতো সুইচ অন-অফ করা যায়। এই পদ্ধতিতে লিটারে ৪০/৫০ এমএল তেল অনায়াসে কম দেওয়া যায়। ডিভাইসটি এমনভাবে বসানো হয়, যা দেখা যায় না। বিএসটিআইর লোকজন উপস্থিত হলে মুহূর্তের মধ্যে সবার অলক্ষ্যে ডিভাইসটি অফ করে দেওয়া সম্ভব। তাহলে আর কারচুপি ধরা পড়বে না।
এ ব্যাপারে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. টিপু সুলতান বলেন, আমি এই চুরির সঙ্গে জড়িত নন। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য নয়। আমি কারো কাজ থেকে টাকা নেয় না।
আরএক্স/