আবাসন খাতের মাফিয়া টিএন্ডটির নুরুল হক


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ০৮:৫২ অপরাহ্ন, ৯ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫


আবাসন খাতের মাফিয়া টিএন্ডটির নুরুল হক
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

# একজন সামান্য কর্মচারীর হঠাৎ করে বিত্তশালী

# স্বৈরাচার আ.লীগের আমলে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ

# ৮ বছরে ৩৮ টি ভবনের মালিক

# অবৈধ টাকার গরমে ছেড়েছেন সরকারি চাকরি

ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি

 -ড. ইকবাল মাহমুদ সাবেক চেয়ারম্যান, দুদক 


সরকারের টেলিফোন সংযোগ বিতরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের (টিএন্ডটি) লাইন লেবার হিসেবে ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশ করেন নুরুল হক। চাকরির সামান্য বেতনের আয়ে একজন কর্মচারীর ঢাকা মহানগরীতে পরিবার নিয়ে বসবাস করা প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধের শামিল। তবে নুরুল হক ব্যতিক্রম। দৃশ্যমান সম্পদের হিসেব বলছে, সময়ের ব্যবধানে তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। 


চাকরিরত অবস্থাতেই অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করেছেন আবাসন খাতে। ছোট্ট একটি সরকারি চাকরি যেখানে দেশের কোটি বেকার মানুষের কাছে সোনার হরিণ, অবৈধ টাকার গরমে নুরুল হক সেই চাকরি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছেন। যা তার অনেক সহকর্মীর কাছেও বিস্ময়কর ঘটনা। কেউ কেউ বলছেন, আলাদীনের চেরাগ হাতে না পেলে একজন সামান্য কর্মচারীর হঠাৎ করে এমন বিত্তশালী হওয়া অসম্ভব। আর তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ফলে, তাকে আওয়ামী লীগের দোসর ও অন্যতম সুবিধাভোগী হিসেবেও চিহ্নিত করা হচ্ছে। তার ঘনিষ্ঠ সূত্রের মতে, নুরুল হকের একজন জামাতা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত এবং এক ভাইয়ের ছেলে পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই)। তাদের অবৈধ অর্থও নুরুল হকের ব্যবসায় রয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্র। আর কেউ তার অর্থ-সম্পদ নিয়ে টু-শব্দ করলে একটি বিশেষ বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে বলে ক্ষমতা জাহির করেন বলেও অভিযোগ আছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদ মালিক বনে যাওয়া নুরুল হককে নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।


নুরুল হকের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে ও সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে পাওয়া গেছে তার অস্বাভাবিক উত্থানের অজানা অনেক তথ্য। তার বর্তমান পরিচয় তাকওয়া নেক্সজেন প্রোপার্টিজ নামক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। কোম্পানির বিভিন্ন পদে রেখেছেন আত্মীয়-স্বজনকে। এই কোস্পানি প্রতিষ্ঠার আগে দীর্ঘ দিন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই সরকারকে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা করেছেন তিনি। তার অনুমোদনবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-তাকওয়া সমিতি, তাকওয়া বিল্ডার্স, তাকওয়া প্রোপার্টিজ। এসব নাম দিয়ে তিনি অনেকগুলো ভবন নির্মাণ করেছেন, অথচ কোম্পানির অনুমোদন না থাকায় সরকারকে এক পয়সার ভ্যাট-ট্যাক্সও দেননা তিনি।


সূত্র নিশ্চিত করেছে, সরকারি চাকরি করা অবস্থাতেই ২০১৬/১৭ সালে এই ব্যবসা শুরু করেন তিনি, যা চাকরিবিধি অনুযায়ী নিয়মের লঙ্ঘন। তবে, ঢাকা শহরে জমি কিনে ভবন নির্মাণের মত ব্যবসায় বিনিয়োগের অর্থ তিনি কোথায় পেয়েছেন, সেটা নুরুল হকের পরিচিতজনদের মনেও জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। চাকরিরত অবস্থায় অবৈধ আবাসন ব্যবসা শুরুর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। উৎসবিহীন অর্থ দিয়ে ও অনুমোদনহীন কোম্পানির নামে দাঁড়াতে থাকে একের পর এক ভবন। অবৈধ অর্থে বানানো ভবনের ফ্ল্যাট বিক্রির টাকায় ফুলে-ফেপে ওঠে নুরুল হকের ব্যাংক-ব্যালেন্স। অবৈধ ব্যবসা থেকে অর্জিত টাকার গরমে তিনি ২০২১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন। সূত্রের তথ্য মতে সরেজমিনে খোঁজ নিতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৮টি ভবনের সন্ধান মিলেছে। যার মধ্যে ৩০ টির কাজ সম্পন্ন হয়েছে, ৮টি ভবনের কাজ চলমান। যার বেশিরভাগ ভবনেই আছে প্রতারণার অভিযোগ ও প্রভাব খাটিয়ে দখল বাণিজ্যের।


নুরুল হকের সঙ্গে ব্যবসায়ীকভাবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, মাত্র ৭ থেকে ৮ বছরে রাজধানীর বাড্ডা ও আশপাশের এলাকায় এতগুলো ভবন গড়ে তুলেছেন তিনি, যা অবিশ্বাস্য। যেখানে সরকারের বড় পদে থাকা কর্মকর্তারা একটি ফ্ল্যাট কিনতেও হিমশিম খায়, নুরুল হক কোন আলাদীনের চেরাগ হাতে পেয়ে এত সম্পদ গড়লেন, তা তিনিই বলতে পারবেন। এত বড় দুর্নীতিবাজের কর্মকাণ্ড দুদক ও গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত হওয়া দরকার বলে মনে করেন বাড্ডা এলাকার সাধারণ মানুষ।


অবৈধ সম্পদ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অভিযুক্ত নুরুল হক এর মুঠো ফোনে কল দিলে তিনি রিসিপ করেননি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও উত্তর মেলেনি। এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতিবাজরা যতই ক্ষমতাধর হউক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।  


এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দুর্নীতিবাজরা সক্রিয় থাকে। তাই তাদের নিমূল করা কঠিন। তবে দিনে দিনে বাড়ছে দুর্নীতি। প্রিয় পাঠক, আগামী পর্বে থাকছে নুরুল হকের অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি এবং প্রশাসনের কর্মকর্তা জামাতা পুলিশ কর্তকর্তা ভাতিজার প্রভাব খাটিয়ে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের আমলে দখলবাজির চিত্র।


আরএক্স/