পদ্মা সেতুর বিতর্কিত প্রকৌশলী বহাল, চলছে মেগা টেন্ডারের খেলা
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ০৩:২৩ অপরাহ্ন, ১৭ই জুলাই ২০২৫

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও আলোচিত মেগা প্রকল্প। এই প্রকল্পের নাম শুনলেই দেশের মানুষের মনে গর্ব ও ত্যাগের মিশ্র অনুভূতি জাগে। কিন্তু এই সেতুর ইতিহাসে আছে দুর্নীতি, ষড়যন্ত্র ও আন্তর্জাতিক বিতর্কের কালো অধ্যায়ও। আর সেসব বিতর্কের মাঝেই ছিলেন প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস, যিনি তখন সেতু বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন।
অবাক করার মতো তথ্য হলো, সেই বিতর্কিত প্রকৌশলী আজও বহাল তবিয়তে রয়েছেন একই পদে। শুধু তাই নয়, নতুন সরকার ‘পরিবর্তন’ ও ‘সংস্কার’-এর ঘোষণা দিলেও তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই। বরং তিনি আরও বেশি শক্তিশালী অবস্থানে থেকে একের পর এক মেগা প্রকল্পের টেন্ডার আহ্বান করছেন, যার পেছনে আছে ক্ষমতার অদৃশ্য ছায়া, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা এবং একধরনের রহস্যময় নীরবতা।
সূত্র জানায়, ২০১২ সালে কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের মাধ্যমে পরামর্শক নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে অর্থায়ন স্থগিত করে। দুর্নীতি দমন কমিশন বনানী থানায় মামলা করে সাতজনকে আসামি করে। সেই মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন কাজী মো. ফেরদৌস। মামলায় অভিযোগ ছিল বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন টিকিয়ে রাখতে একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য ঘুষের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যার নেপথ্যে ছিলেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি।
পরবর্তীতে মামলার কয়েকজন আসামিকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং আদালতের রায়ে কারও বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ হয়নি। তবে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় একজন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠা যে শুধু প্রশাসনিক বিব্রতকর নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকেও গভীর উদ্বেগের বিষয় তা নিয়ে আজও বিতর্ক থামেনি।
বর্তমান সরকার গত নির্বাচনে ‘সুশাসন ও স্বচ্ছতা’-র কথা বলেছিল। প্রথম দিকে প্রশাসনে কিছু রদবদলও হয়েছে। কিন্তু গত এগারো মাসে সেতু বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌসের পদে কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তনের এই অসম্পূর্ণ রূপ দেশবাসীর মনে একধরনের বিভ্রান্তি ও হতাশা সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠছে সংস্কার কি শুধুই রাজনৈতিক নেতৃত্বে সীমাবদ্ধ, নাকি আমলাতন্ত্রেও তার কোনো বাস্তব প্রয়োগ হবে?
এই প্রশ্ন আরও প্রবল হয়েছে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা একটি প্রজ্ঞাপন ঘিরে। ২০২৫ সালের ৮ জুলাই জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে—চলতি অর্থবছরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি ছাড়া অন্য খাতে নতুন ভবন নির্মাণ করা যাবে না। সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সেতু বিভাগ সেই নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে একের পর এক টেন্ডার আহ্বান করেছে। এসব টেন্ডারের মধ্যে রয়েছে প্রশাসনিক ভবন, ভিজিটরস গ্যালারি, ডরমিটরি ও আবাসন প্রকল্প—যেগুলোর প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া একই প্রজ্ঞাপনে বলা হয় যেসব প্রকল্পে ৫০ শতাংশ অগ্রগতি হয়নি, সেগুলোর জন্য নতুন অর্থ ছাড়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু পদ্মা সেতু মিউজিয়াম ও অডিটোরিয়াম নামে একটি প্রকল্পে এই নিয়ম লঙ্ঘন করে সরাসরি কাজ শুরু করে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই প্রকল্পটি ছিল পুরনো সরকারের পরিকল্পনার অংশ, যা এখন নতুন সরকারের আমলে কার্যত চুপিসারে বাস্তবায়ন হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী বলেন, “পুরনো প্রকল্পগুলো নতুন করে শুরু হচ্ছে, কিন্তু সেগুলোর পেছনে যে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দরকার, তা আসছে কোথা থেকে—এই প্রশ্নে কেউ ঘাঁটাতে চায় না। কারণ সবাই জানে, কাজী সাহেব যেখানে আছেন, সেখানে নীরব থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই নীরবতা কেবল প্রশাসনের নয়, রাজনৈতিকভাবেও তা উদ্বেগজনক। কারণ সরকারের একাংশ হয়তো চাচ্ছে প্রশাসনিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে, কিন্তু আরেক অংশ সেই প্রক্রিয়াকে প্রতিরোধ করছে পুরনো আমলাতান্ত্রিক জোট ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। তাতে করে একধরনের দ্বৈত সরকার ব্যবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে—যেখানে মন্ত্রী-উপদেষ্টারা বদলালেও প্রকল্পের নিয়ন্ত্রকেরা থেকে যান একই, একই পদ্ধতিতে।
বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগে পদ্মা সেতু থেকে সরে গিয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত আদালতে প্রমাণ হয়নি ঠিকই, কিন্তু একজন প্রকৌশলীর নামে এমন অভিযোগ থাকলে তাঁর ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় উচ্চ পদে কাজ করার সুযোগ নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কাজী মো. ফেরদৌসের ক্ষেত্রে যেন উল্টো চিত্র—তিনি শুধু বহালই নন, বরং আগের চেয়েও বেশি পরিসরে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন।
সেতু বিভাগের ভেতরের একাধিক সূত্র জানায়, বর্তমানে অন্তত চারটি প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান হয়েছে যেগুলো বাজেটীয় নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর মধ্যে দু’টি প্রকল্পে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে আগে থেকেই শর্ত নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের অনিয়ম দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রশাসনিক আস্থাও ক্ষুণ্ণ করছে।
সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য আসেনি। যোগাযোগ করা হলে একাধিক মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন। কেউ কেউ সরাসরি বলেন, "উপরে নির্দেশ না এলে কিছু বলা যাবে না।"
এই নিঃশব্দতা থেকেই স্পষ্ট হয়—প্রশাসনে এখনো সেই পুরনো ধারা বহাল আছে, যেখানে বিতর্কিত কর্মকর্তা থাকেন নিরাপদ, আর প্রশ্ন করা মানেই ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ নতুন সরকার যেভাবে পরিবর্তনের অঙ্গীকার করেছিল, তাতে এমন চিত্র দেখা মোটেও প্রত্যাশিত নয়।
অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি সত্যিই নতুন পথ নির্মাণ করতে চায় সরকার, তবে কাজী মো. ফেরদৌসের মতো বিতর্কিত কর্মকর্তাদের নিয়ে জোরালো অবস্থান নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। প্রশাসনিক জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে শুধুই রাজনৈতিক নেতৃত্ব বদলালেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না। বরং তা পরিণত হবে ‘পুরনো ভুলের নতুন সংস্করণ’ এ যার দায় শেষ পর্যন্ত পুরো সরকারের উপরই বর্তাবে।
আরএক্স/