ডিপিডিসির প্রকৌশলী ইমরোজের জমজমাট সাব-স্টেশন ব্যবসা
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ১১:২৬ পূর্বাহ্ন, ১৬ই মার্চ ২০২৫

# ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে ট্রান্সফরমার ক্রয়ে বাধ্য করেন
# ডিজিটাল পাওয়ারের নামে নিম্ন মানের ট্রান্সফরমার বিক্রি
# গ্রাহকদের ফাইল আটকে রেখে বাণিজ্য
# ব্যবসার নেপথ্যে এমডি নোমান ও পরিচালক শফিক
# ইমরোজের দুই ভোটার আইডি কার্ডে পৃথক নাম
# বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে
- সোনা মনি চাকমা, নির্বাহী পরিচালক (এইচআর), ডিপিডিসি
# দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে
- ড. ইকবাল মাহমুদ সাবেক চেয়ারম্যান, দুদক
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইমরোজ আলী নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধ বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন। সরকারি সংস্থায় চাকরি করে নিজ সংস্থাতেই সরবরাহ ব্যবসা পরিচালনা করছেন তিনি, কিভাবে বৈধতা পায় প্রশ্ন ভুক্তভুগিদের। অভিযোগ আছে, ডিপিডিসির উর্ধ্বতন কিছু অসাধু কর্মকর্তার আশির্বাদের হাত ইমরোজ আলীর মাথার ওপর থাকায় তিনি নির্বিঘ্নে ডিজিটাল পাওয়ার এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস নামে বিদ্যুৎ সরঞ্জাম সরবরাহ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতে পারছেন। আর তাকে ম্যানেজ না করে বা তার প্রতিষ্ঠান থেকে মালামাল না নিলে কোনো শিল্প উদ্যোক্তা কিংবা বহুতল ভবন নির্মাণকারী সংস্থা ‘সাব-স্টেশন’ স্থাপনের অনুমোদনই পান না ডিপিডিসি থেকে। ব্যবসায়ীদের জিম্মি করেই তিনি তার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই সব অভিযোগের তথ্য উঠে এসেছে ইমরোজ আলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা পড়া অভিযোগপত্র থেকে। সম্প্রতি এক ভুক্তভোগী তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ জমা দেন।
লিখিত অভিযোগে দাবি করা হয়েছে, ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমানকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইমরোজ আলী তার ডিজিটাল পাওয়ার এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস নামক প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন। এই কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে ইমরোজ আলী’র স্ত্রীর নাম ব্যবহার হয়েছে। ডিজিটাল পাওয়ারের মাধ্যমে বিগত কয়েক বছরে ট্রান্সফরমার, কেবলস, সার্কিট ব্রেকার, কমপ্লিট সাব-স্টেশন, হাই সুইচগিয়ার, এলটি সুইজার, এমডিবি বক্স, ডিবি বক্স, এসডিবি বক্স, জেনারেটর সাপ্লাই, সাব-স্টেশন মেইটেন্যান্স, ট্রান্সফরমার ওয়েল সেন্ট্রিফিউজিং, কমপ্লিট সোলার সিস্টেম সরবরাহসহ বিদ্যুতের নানা সরঞ্জাম বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন ইমরোজ আলী। রাজধানীর ১৫৪ মতিঝিলে সি/এ রোড এলাকায় ডিজিটাল পাওয়ার এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের করপোরেট অফিসটি পরিচালিত হচ্ছে। এদিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলাকার মাতুয়াইল দক্ষিণ পাড়া কলেজ রোডের হাজী টাওয়ারে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। যেখানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন প্রকৌশলী এস এম সাগর মাহমুদ ওরফে ইমরোজ আলী। আর এই প্রতিষ্ঠানের কারখানা রাজধানীর ডেমরা বাজারের পাশে ঐতিহ্যবাহী আহমেদ বাওয়ানি টেক্সটাইলস মিলসের একটি কক্ষের মধ্যে। প্রতিষ্ঠানটিতে সাধারণ মানুষের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
অভিযোগনামায় আরো বলা হয়েছে, উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইমরোজ আলীর চাকরির বেশির ভাগ সময় কেটেছে গ্রীডে। সাউথ-১ গ্রীডে কর্মরত থাকার সময়েই তার ডিজিটাল পাওয়ার ফুলে-ফেঁপে ওঠে। কারণ নায়ানগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, মাতুয়াইল, শ্যামপুর, কাজলা, জুরাইন, ফতুল্লা উঠতি শিল্পাঞ্চল এলাকা। গত কয়েক বছরে এ এলাকায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ডিজিটাল পাওয়ারের মাধ্যমেই বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করাতে বাধ্য হয়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। ডিপিডিসির এমডি নোমান ও পরিচালক অপারেশন শফিকুলের সু-দৃষ্টি থাকায় ইমরোজ আলীকে আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। এই কর্মকর্তা ডিপিডিসির গ্রীডে (সাউথ-১) কর্মরত আছেন। চাকরিবিধি ভঙ্গ করে ২০১৬ সাল থেকে তিনি এই ব্যবসার সাথে জড়িত। এভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন এই প্রকৌশলী।
সূত্র মতে, রাজধানীর বড় একাংশে বিদ্যুত সংযোগ সরবরাহ করে ডিপিডিসি। যে সমস্ত গ্রাহকরা বিদ্যুতের উচ্চচাপ সংযোগ নিতে এই দপ্তরে আসেন; তাদের টার্গেট করে ইমরোজ আলীর প্রতিষ্ঠান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইমরোজ আলী তার ডিজিটাল পাওয়ারের মাধ্যমে বিদ্যুতের সাব-স্টেশন স্থাপন ও ট্রান্সফরমার বিক্রি করে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা করছেন, যা একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তিনি করতে পারেন না। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পে তার প্রতিষ্ঠানের ট্রান্সফরমারও তিনি সরবরাহ করছেন। গত বছরে ডিজিটাল পাওয়ারের মাধ্যমে ৩০০টি ট্রান্সফরমার সরবরাহ করা হয়। সেই ট্রান্সফরমারগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায়, ডিজিটাল পাওয়ার সরবরাহ করা ট্রান্সফরমারের মধ্যে বেশিরভাগ অত্যন্ত নিম্নমানের। ডিপিডিসির কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে নীরব আছেন। অভিযোগ আছে, শীর্ষ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই নিয়মবিহর্ভূতভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছেন ওই কর্মকর্তা। এ রকম ব্যবসা করা সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা ও ডিপিডিসি’র নিজস্ব চাকরি প্রবিধানমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিপিডিসির একজন নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ইমরোজ আলী যতগুলো ট্রান্সফরমার তৈরি করেছেন, তা খুবই নিম্নমানের। যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। তবে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। কারণ তার এই ব্যবসার নেপথ্যে রয়েছে ডিপিডিসি’র এমডি নোমান ও পরিচালক শফিক।
সংস্থাটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ইমরোজ আলী বিভিন্ন শাখার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীদের চাপ প্রয়োগ করে গ্রাহকদের ফাইল আটকে রাখেন। তার কোম্পানি থেকে মালামাল সরবরাহ করবে; এমন চুক্তির পরেই মিলে উচ্চচাপের সংযোগ। তিনি যেহেতু ডিপ্লোমা প্রকৌশল পরিষদের নেতা; তাই ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলেন না। তবে বিষয়টি গোটা দপ্তরের সবাই জানেন।
অভিযোগ রয়েছে, তার প্রতিষ্ঠানের মালামালের দাম বাজারের অন্যান্য কোম্পানির চেয়ে তুলনামূলক বেশি। আবার মানেও ভালো না। এসব বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ জানাতে গেলে উল্টো তার হয়রানির মুখোমুখি হয়েছেন অনেকেই।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ডিপিডিসির উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইমরোজ আলীকে কল করলে তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন। এরপর টানা চার দিন কল ও বার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয় ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (এইচআর) সোনা মনি চাকমা বলেন, আমি অবগত নই। কেউ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ দিকে ডিপিডিসির পরিচালক(অপারেশন) শফিকুল ইসলাম এর মুঠোফোনে কল দিলে তিনি রিসিপ করেননি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে উত্তর মেলেনি।
এ বিষয় ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান এর মুঠোফোনে কয়েকবার ঢোন দিলেও তিনি রিসিপ করেনি। একমকি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে উত্তর মেলেনি।
এ বিষয় ডিপিডিসি উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইমরোজ আলীকে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও উত্তর মেলেনি। এমনকি তিনি বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে হুমকি ধামকি দিয়েছেন। যাতে নিউজ প্রকাশ না করা হয়।
এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতিবাজরা যতই ক্ষমতাধর হউক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দুর্নীতিবাজরা সক্রিয় থাকে। তাই তাদের নিমূল করা কঠিন।
আরএক্স/