আসছে বর্ষাকাল বাড়ছে আতঙ্ক
বিশেষ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:৫১ অপরাহ্ন, ২৯শে মে ২০২৫

বাংলাদেশ, যাকে বলা হয় ‘নদীমাতৃক দেশ,’ প্রতি বছর বর্ষাকালে নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়।
প্রতি বছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বন্যা, জলাবদ্ধতা, ভূমিধস, এবং পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, এবং তিস্তার মতো বড় নদীগুলোর পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীভাঙন তীব্র হয়, যা কৃষিজমি, বসতবাড়ি, এবং জীবিকা ধ্বংস করে দেয়।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ শ্রমিক নেবে জাপান
এই দুর্যোগ শিশু ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য মারাত্মক ক্ষতি, কারণ তারা এর প্রভাব সহ্য করার জন্য কম প্রস্তুত থাকে। এই সময় শিশুরা বিশেষভাবে ঝুঁকির মুখে পড়ে, কারণ তাদের দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং পরিবেশগত পরিবর্তনের প্রতি সংবেদনশীলতা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করে। হুমকির মুখে জীবন-জীবিকা। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি এবং ভারতের উজান থেকে আসা ঢলের কারণে দেশের নিম্নাঞ্চল, বিশেষ করে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট, এবং হাওর অঞ্চল প্লাবিত হয় ২০২৪ সালের আগস্টে বন্যায় ১১টি জেলায় প্রায় ৫৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে ১২ লাখ ছিল শিশু।
ফসল, ঘরবাড়ি, এবং অবকাঠামো ধ্বংস হয়, যা কৃষক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেমন ২০২৪ সালের বন্যায় প্রায় ১০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের মতো শহরগুলোতে দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে পানি জমে থাকে, যা যানজট ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করে।
জমে থাকা পানি মশার প্রজনন বাড়ায়, যা ডেঙ্গুর মতো রোগ ছড়ায়। এছাড়াও পাহাড়ি অঞ্চল, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, এবং রাঙামাটিতে ভারী বৃষ্টির কারণে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। এটি জানমালের ক্ষতি করে এবং শিশুদের জন্য বিপজ্জনক পরিবেশ তৈরি করে। বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে কৃষি, পরিবহন, এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হয়। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.১% এ নেমে আসতে পারে, যার একটি কারণ চরম আবহাওয়া। বর্ষাকালে আতঙ্কের মূল কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগের তীব্রতা ও ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধি। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বন্যা, ঝড়, এবং তাপপ্রবাহের মতো চরম আবহাওয়া ৪৬% বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টির ধরন অনিয়মিত ও তীব্র হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং হিমালয়ের হিমবাহ গলন পানির প্রবাহ বাড়াচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে চরম আবহাওয়ার ঘটনা গত দুই দশকে ৪৬% বেড়েছে।
নদীভাঙনের প্রভাব : প্রতি বছর হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালে শরীয়তপুর, চাঁদপুর, এবং সিরাজগঞ্জে পদ্মা ও যমুনার ভাঙনে শত শত পরিবার গৃহহীন হয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত দশকে নদীভাঙনে প্রায় ১০,০০০ হেক্টর জমি হারিয়েছে।
জীবিকার উপর প্রভাব: কৃষক ও মৎস্যজীবী সম্প্রদায় তাদের জীবিকা হারায়, যা দারিদ্র্য বাড়ায়। নদীভাঙনের কারণে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো প্রায়ই শহরে পাড়ি জমায়, যা শহরের জনসংখ্যার চাপ বাড়ায়।
শিশুদের উপর প্রভাব: নদীভাঙনে স্কুল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হলে শিশুদের শিক্ষা বন্ধ হয়। ২০২৪ সালে বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন শিশু স্কুলে যেতে পারেনি।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি: বাস্তুচ্যুত শিশুরা দূষিত পানি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে ডায়রিয়া, ডেঙ্গু, এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়।
মানসিক চাপ: বাড়ি ও পরিবেশ হারানোর কারণে শিশুদের মধ্যে মানসিক অবসাদ ও উদ্বেগ বাড়ে।
পরিবেশগত ক্ষতি: নদীভাঙন জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে, বিশেষ করে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর আবাসস্থল। কৃষিজমি হ্রাস পাওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি: নদীভাঙনের কারণে অবকাঠামো (রাস্তা, সেতু, বিদ্যুৎ লাইন) ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা পুনর্র্নিমাণে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪.১% এ নেমে আসতে পারে, যার একটি কারণ নদীভাঙন ও বন্যার মতো দুর্যোগ।
আরও পড়ুন: সংবাদপত্রে ঈদুল আজহার ছুটি ৫ দিন
কৃষি খাত: বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় ১৪.২৩% কৃষি খাত থেকে আসে। বর্ষায় বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে ধান, পাট, এবং শাকসবজির মতো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের বন্যায় ফেনী, নোয়াখালী, এবং কুমিল্লার মতো এলাকায় প্রায় ১০ লাখ হেক্টর কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা খাদ্য উৎপাদন এবং কৃষকদের আয়ের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
প্রাক্কলিত ক্ষতি: ২০২৪ সালে কৃষি খাতে বন্যার কারণে প্রায় ৫০০-৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। ২০২৫ সালে এই ক্ষতি তীব্রতার উপর নির্ভর করে আরও বাড়তে পারে।
অবকাঠামোর ক্ষতি: বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে রাস্তাঘাট, সেতু, এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ক্ষতি হয়। ২০২৪ সালে বন্যায় প্রায় ১০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েন, এবং রাস্তা ও সেতুর পুনর্র্নিমাণে সরকারের ব্যয় বেড়েছে। যেমন, ২০২১ সালে মাদারীপুরে নদীভাঙনে একটি প্রধান সড়ক ধ্বংস হয়, যার পুননির্মাণে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল।
প্রাক্কলিত ক্ষতি: অবকাঠামোর ক্ষতি পুননির্মাণে বছরে গড়ে ২০০-৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়।
শিল্প ও বাণিজ্য: বন্যার কারণে পরিবহন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হলে তৈরি পোশাক শিল্প এবং অন্যান্য রপ্তানিমুখী খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তৈরি পোশাক শিল্প, যা দেশের অর্থনীতির ৬-৮% অবদান রাখে, বন্যার সময় সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হওয়ায় উৎপাদন হ্রাস পায়।
২০২৪ সালে বন্যার কারণে রপ্তানি আয়ে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলে অনুমান করা হয়।
মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়: বন্যার কারণে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেলে খাদ্যের দাম বাড়ে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। ২০২৫ সালের মার্চে গ্রামীণ মূল্যস্ফীতি ৯.৪১% এবং শহুরে মূল্যস্ফীতি ৯.৬৬% ছিল, যা বন্যার প্রভাবে আরও বাড়তে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায়, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় ৫৮ লাখ (৫.৮ মিলিয়ন) মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং ৫,০২,৫০১ (৫ লাখের বেশি) মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে ৩,৪০৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। এই বন্যায় ফেনী,
নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, এবং কক্সবাজারের মতো জেলাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের ৮০% এলাকা বন্যাপ্রবণ, এবং প্রতি বছর গড়ে ১৮% এলাকা (২৬,০০০ বর্গকিলোমিটার) প্লাবিত হয়। বড় বন্যায় এই পরিমাণ ৫৫% বা তার বেশি হতে পারে। প্রতি বছর হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়, যা বাস্তুচ্যুতির একটি প্রধান কারণ। উদাহরণস্বরূপ, গত দশকে প্রায় ১০,০০০ হেক্টর জমি নদীভাঙনে হারিয়েছে।
আরও পড়ুন: জাপানে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টির তীব্রতা ও ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাস্তুচ্যুতির হার বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ১৩৩ লাখ (১৩.৩ মিলিয়ন) থেকে ২৩০ লাখ (২৩ মিলিয়ন) মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে।
প্রতি বছর বর্ষাকালে বাংলাদেশে গড়ে ৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, তবে বড় বন্যার বছরে এই সংখ্যা ৫০ লাখ বা তার বেশি হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। বাস্তুচ্যুতি কমাতে নদী শাসন, বন্যা প্রতিরোধী অবকাঠামো, এবং জলবায়ু তহবিলের ব্যবহার জরুরি।
এসডি/