৮ বছরে শেষ হয়নি কর্ণফুলী মেরিন ড্রাইভ

সিডিএ'র রাজীব-জসিম-অসীমকে ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:২৯ অপরাহ্ন, ২৬শে জুলাই ২০২৫


সিডিএ'র রাজীব-জসিম-অসীমকে ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ
ছবি: প্রতিনিধি

আবুল হাসনাত,চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের মানুষের বহু প্রত্যাশার ‘কর্ণফুলী মেরিন ড্রাইভ’ প্রকল্প আট বছরেও পূর্ণতা পায়নি। ২০১৭ সালে একনেকে অনুমোদিত ৮ দশমিক ৩ কিলোমিটারের ‘কালুরঘাট-চাক্তাই সড়ক ও বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প’-এর কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। প্রাথমিক বাজেট ছিল ২,৩১০ কোটি টাকা। সময় বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৭৭৯ কোটি টাকায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০২৫ সালের মাঝামাঝি এসে এখনো প্রায় ২০ শতাংশ কাজ বাকি রয়েছে। অথচ প্রকল্পটি সিডিএর অগ্রাধিকারভুক্ত উন্নয়ন হিসেবে বিবেচিত ছিল।


প্রকল্প এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সড়ক ও বাঁধ নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণগুলোর মান আশঙ্কাজনকভাবে নিম্ন। নদী থেকে উত্তোলিত অপরিশোধিত বালুতে রয়েছে পলিথিন, কাদা ও বিভিন্ন আবর্জনা। প্রতিরক্ষা বাঁধে প্রয়োজনীয় শক্তিশালী রডের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে ১৬-২০ মিমি রড। রাস্তার কার্পেটিংয়ে ব্যবহৃত পাথর অনেকটাই ভাঙা ও ধূলিময়, যা স্থায়িত্বের ঝুঁকি তৈরি করছে। ব্লক বসানোর আগে সঠিকভাবে বালির বেডিং না দেওয়ায় ইতোমধ্যে বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অনিয়ম প্রকল্পের ভবিষ্যত টেকসইতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।


প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)-এর প্রকল্প পরিচালক রাজীব দাশ, সমন্বয়কারী কর্মকর্তা জসিম ও অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ ইতোমধ্যে জমা পড়েছে এবং প্রকল্পটি তাদের নজরদারির আওতায় রয়েছে। এই সব অনিয়ম ও অপশাসনের ফলে একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প দুর্নীতির পঙ্কে নিমজ্জিত।


প্রকল্পের কাজ পেয়েছে স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, যাদের বিরুদ্ধে বারবার নিম্নমানের কাজ করার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির ইনচার্জ অসীম কুমার বাবুর নেতৃত্বে মানহীন উপকরণ দিয়ে কাজ পরিচালিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে শ্রমিকরা। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির মালিক দিদার আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতো। এমনকি তার এক আত্মীয়ের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ থাকলেও তা সরকারি তহবিল থেকেই পূরণ করা হয়েছিল পূর্ববর্তী সরকারের সময়। এখানেই শেষ নয়—স্পেক্ট্রার এক কর্মকর্তা দায় চাপিয়ে দেন ইনচার্জের ওপর, আর ইনচার্জ সাংবাদিকদের বলেন, “সবকিছু সিডিএ জানে, ওখানেই যান।” এই দায় এড়িয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি থেকেই স্পষ্ট—নিম্নমানের কাজ ও অপচয়ের দায় কেউ নিতে রাজি নয়।


প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ ও শ্রমিকদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক ক্ষোভ। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষতিপূরণ কমাতে ও অনিয়ম আড়াল করতে সিডিএ’র সমন্বয়কারী কর্মকর্তা জসিম স্থানীয়দের ভয়ভীতি ও চাপ প্রয়োগ করেছেন। শ্রমিকদের দাবি, ক্যামেরা দেখলেই পলিথিন পরিষ্কার করতে বাধ্য করা হয়, যাতে প্রকৃত চিত্র ধরা না পড়ে। অনেক শ্রমিকই সরাসরি স্বীকার করেছেন, তারা নিম্নমানের উপকরণ আলাদা করে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হন নির্দেশ অনুযায়ী। অথচ প্রকল্পটি চট্টগ্রামবাসীর অর্থায়নে পরিচালিত—সেই প্রকল্পে এমন অনৈতিক নিয়ন্ত্রণ গভীর উদ্বেগজনক।


প্রকল্পের সড়ক ঘেঁষে প্রাকৃতিক দৃশ্যের সৌন্দর্যে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়লেও সন্ধ্যার পরেই এলাকা হয়ে পড়ে জনশূন্য। পর্যাপ্ত লাইটিং, নিরাপত্তা বাহিনী বা পর্যটক সহায়ক ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে এখনো এটি পূর্ণাঙ্গ পর্যটন আকর্ষণে রূপ নিতে পারেনি। সামান্য পরিকল্পনা ও সঠিক তদারকিতে এই মেরিন ড্রাইভ হতে পারত দেশের অন্যতম পর্যটন জোন। কিন্তু বাস্তবতায় এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে এক অনিরাপদ, অপরিণত প্রকল্প যার ভেতরে লুকিয়ে আছে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম।


চট্টগ্রামের মানুষের চোখে এখন এই প্রকল্প এক উজ্জ্বল উন্নয়ন নয়—বরং এটি হয়ে উঠেছে দুর্নীতি, সময়ক্ষেপণ ও জবাবদিহিহীনতার প্রতিচ্ছবি। বলিরহাট, চাক্তাই, চাক্তাইঘাটসহ আশেপাশের এলাকার বাসিন্দারা প্রশ্ন তুলছেন—এই বিপুল ব্যয়ে তৈরি প্রকল্পের কাজ কেন এখনো শেষ হলো না? স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল করিম বলেন, “সরকারি টাকা নিয়ে খেলছে। সড়কের গুণমানই প্রমাণ করে কোথায় কতটা দুর্নীতি হয়েছে।” জনমতের স্পষ্ট দাবি—এই প্রকল্পে জড়িত সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। নয়তো, দেশের অন্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎও একই পরিণতির শিকার হবে।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে জসিম বলেন,“আমি প্রকল্পে ইকুইপমেন্ট ও সরঞ্জামের বিষয়টি দেখছি। কাজের গুণগত মান ও উপকরণের মান সরাসরি আমার আওতায় পড়ে না।তবে সরেজমিনে পাওয়া কাদা ও পলিথিনযুক্ত বালু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব অভিযোগ সঠিক নয়। পলিথিন বা নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের দায় আমার নয়।'


এবিষয়ে প্রকল্প পরিচালক রাজীব দাশ জনবাণীকে বলেন, “ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা কীভাবে কাজের অনিয়মের দায় সিডিএ’র ওপর চাপাতে পারে, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”