ডিএসসিসি’র ফেরারী আরিফ ৯ মাস পর ফের বহাল


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ১১:৫৩ পূর্বাহ্ন, ২৮শে জুলাই ২০২৫


ডিএসসিসি’র ফেরারী আরিফ ৯ মাস পর ফের বহাল
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া ।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পরিবহন বিভাগে যেন নিয়ম-নীতির বাঁধভাঙা বন্যা চলছে। এক সময় দায়িত্বে চরম অবহেলায় পথচারী মৃত্যুর ঘটনায় চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন কর্মকর্তা মো. আরিফ চৌধুরী। কিন্তু নয় মাসের ব্যবধানে ফের চাকরিতে ফেরত! শুধু তাই নয়, মাত্র দুই মাসের মাথায় পেয়েছেন ‘অলৌকিক’ পদোন্নতি। প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই, তবুও ‘চলতি দায়িত্ব’ হিসেবে এখন তিনি পরিবহন তত্ত্বাবধায়ক।


অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক পরিচয় ও প্রভাব খাটিয়ে সংস্থার ভেতরে গড়ে তুলেছেন এক ধরনের ‘রামরাজত্ব’। চাপ, ভয়, জবরদস্তি সবকিছু মিলিয়ে এখন তিনি যেন ডিএসসিসির একজন অলিখিত কর্তা!


২০২৩ সালের ২৫ এপ্রিল। রাজধানীর মুগদা এলাকায় মদিনাবাগ সিয়াম টাওয়ারের সামনে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান পথচারী মো. মাহিন। গাড়িটি ছিল ডিএসসিসির, চালক ছিলেন না কোনো বৈধ কর্মকর্তা—বরং নিরাপত্তা প্রহরী মো. রুবেলকে মৌখিকভাবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন কম্পিউটার অপারেটর আরিফ চৌধুরী। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হন তিনিই।


তৎকালীন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ওই বছরের ৩০ এপ্রিল তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করেন। কিন্তু ডিএসসিসির এই ‘দৃঢ়’ সিদ্ধান্ত টিকলো না বছর ঘুরতে না ঘুরতেই।


২০২৩ সালের ২ জুলাই তিনি আপিল করেন, শুনানি হয় ২০২৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। শুনানির আদেশে ‘নির্দোষ’ বলা হয়নি কোথাও। তবুও চাকরি ফেরত পান। ২৪ ফেব্রুয়ারি জারি হয় পুনর্বহালের অফিস আদেশ।


আর ঠিক দুই মাস পর, ৩০ এপ্রিল, তিনি হয়ে যান পরিবহন তত্ত্বাবধায়ক (চলতি দায়িত্ব)। অথচ এই পদে যোগ্যতা হিসেবে প্রয়োজন স্নাতক ডিগ্রি, আরিফ চৌধুরীর ফাইলে রয়েছে কেবল এইচএসসি পাসের সনদ!


চলতি বছরের ১৯ জুন গভীর রাতে ডিএসসিসির মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্টো-চ ৫১-৫০০) ব্যবহার করে নেত্রকোনা সফরে যান তিনি। অনুমতি নেননি কারো। গাড়ির চালকও ছিলেন না ডিএসসিসির কেউ, বরং নিরাপত্তা প্রহরী মো. মহিদুল মল্লিক।


এ বিষয়ে আরিফ চৌধুরীর সাফাই, “আমি ভাড়া গাড়িতে গিয়েছিলাম।” আর মহিদুল বলছেন, “আমি কোনো গাড়ি চালাইনি।” কিন্তু একাধিক সূত্র বলছে, গাড়িও গেছে, চালকও ছিলেন বেসামরিক। জ্বালানি ব্যবহারের ব্যাখ্যা নেই, অনুমতির কাগজ নেই তবু যাতায়াতের বিল পরিশোধ হয়েছে সংস্থার বাজেট থেকেই।


সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের আত্মীয় পরিচয়, আবার সুইডেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতার ঘনিষ্ঠতা এই দুই পরিচয়ে ডিএসসিসিতে তৈরি করেছেন এক প্রভাবশালী বলয়। একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের আগস্টের পর আরিফ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি চক্র করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে।


তাদের অভিযোগ, বদলি ও পদোন্নতির আদেশে হস্তক্ষেপ, তদন্তে প্রভাব বিস্তার এবং ভীতি ছড়িয়ে নিজেদের পছন্দের সিদ্ধান্ত আদায় করে নিচ্ছেন তারা।


ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, “পদোন্নতি যদি নিয়মবহির্ভূতভাবে হয়ে থাকে, তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”


ডিএসসিসির পরিবহন মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাছিম আহমেদ বলেন, “নেত্রকোনা সফরের বিষয়ে কিছু জানি না। তবে নানা অভিযোগ আছে। এখনো কিছু ঘটেনি আমার সঙ্গে।”


আর কর্মকর্তারা বলছেন, “এটাই সবচেয়ে ভয়ংকর কেউ কিছু বলছে না। কারণ, এদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস নেই কারও।”


নিয়মের বাইরে গিয়ে একজন দোষী কর্মকর্তা কীভাবে চাকরি ফিরে পান, আবার কীভাবে প্রাপ্যতা ছাড়াই পদোন্নতি পান এই প্রশ্নে মুখ বন্ধ প্রশাসন। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত, তবুও বহাল তবিয়তে পদোন্নতিপ্রাপ্ত এ ঘটনা শুধু আরিফ চৌধুরীর নয়, এটি ডিএসসিসির শাসনব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতার প্রতীক। প্রশ্ন উঠেছে ডিএসসিসিতে কি আদৌ নিয়ম-নীতির কোনো মূল্য আছে? নাকি রাজনীতির ছত্রছায়ায় ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’ই এখন যোগ্যতা।


আরএক্স/