ডিপিডিসি’র এমডি নিয়োগে গোপন এজেন্ডা কার?
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ০৫:৫৯ পিএম, ৩০শে জুলাই ২০২৫

একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী পঁচিশ বছর ধরে দিন-রাত বিদ্যুৎ বিতরণ ঘিরে কাটিয়েছেন। ঘূর্ণিঝড়ের রাতে ফিডার চালু করা থেকে শুরু করে গ্রীষ্মের দাবদাহে লোড ম্যানেজমেন্ট সবকিছুর পেছনে তাঁর অবদান। এখন তিনি পদোন্নতির মোহে নয়, দায়িত্ব নেওয়ার প্রত্যয়ে একঝলক তাকান এমডির চেয়ারটির দিকে। কিন্তু সেখানে জ্বলছে লাল বাতি নীতির জট। অভিজ্ঞতার বিনিময়ে তিনি পাচ্ছেন দীর্ঘশ্বাস, আর চেয়ারে বসছে কেউ, যিনি আসেন ভিন্ন খাত থেকে। ডিপিডিসির এই নীতিনির্ভর অচলাবস্থা বিদ্যুৎখাতের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলছে।
সূত্র বলছে, এক অজানা কারণে সংশোধন হচ্ছে না বিদ্যুৎ বিভাগের ডিপিডিসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগের মানদণ্ড। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের নির্দেশনা থাকার পরও বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব দপ্তরে নেই কোনো অগ্রগতি। মানদণ্ড সংশোধন না হওয়ায় যোগ্য ও মেধাবীরা এই পদে আবেদন করতে পারছেন না। এতে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে প্রকৌশলীদের মাঝে।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে (ডিপিডিসি) প্রায় ছয় মাস ধরে নিয়মিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নেই। ২০২৫ সালের ২৩ মার্চ নিয়োগপত্রের মেয়াদ শেষে হওয়ার আগেই বিদায় নেন এমডি আব্দুল্লাহ আল নোমান। এরপর থেকে এমডির দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন সরকারি কর্মকর্তা, যিনি মূলত পাওয়ার সেলের পরিচালক (প্রশাসন) হিসেবেই দায়িত্বে ছিলেন।
এই অবস্থাকে বিদ্যুৎখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন “নীতি ও বাস্তবতার সংঘাতের ফল”। এমনকি বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে প্রস্তাব পাঠানোর পরও দায়িত্ব গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেছেন অনেকেই। মূল কারণ ‘সামান্য’ অভিজ্ঞতার ঘাটতিতে বহু যোগ্য প্রকৌশলীর নাম বাদ পড়ছে নিয়োগের প্রাথমিক তালিকা থেকেই।
সূত্র জানায়, ডিপিডিসির এমডি নিয়োগে যে নীতিমালা আছে, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ সালে অনুমোদিত এ নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থীকে অবশ্যই ‘বিদ্যুৎ খাতে কোম্পানি পর্যায়ে’ পাঁচ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, যার মধ্যে কমপক্ষে এক বছর হতে হবে কোম্পানির জিএম বা সমমানের পদে।
এই ‘কোম্পানি পর্যায়ের’ অভিজ্ঞতার ধারা নিয়েই আপত্তি তুলছেন অনেক জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী। তাঁদের যুক্তি, একসময় ডিপিডিসি ও অন্যান্য বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ছিল সরকারি বিভাগ পরবর্তী সময়ে কোম্পানিতে রূপান্তর হয়। ফলে যাঁরা তখন থেকে কাজ করছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা গুণে ধরা হচ্ছে না।
বিদ্যুৎ বিতরণ খাতে দুই যুগের অভিজ্ঞতা থাকা এক প্রধান প্রকৌশলী বলেন, “আমরা কোম্পানির আগের সময় থেকে কাজ করছি, আমাদের অভিজ্ঞতা কি বাতাসে উড়ে গেছে?” তাঁর মতো অনেকেই অভিযোগ করেছেন, ‘কোম্পানি অভিজ্ঞতা’ নামক এই শর্তটি মূলত অনেক অভিজ্ঞকে বাদ দেওয়ার ফাঁদ।
বর্তমানে ডিপিডিসিতে বহু অভিজ্ঞ প্রকৌশলী জিএম কিংবা প্রধান প্রকৌশলী পদে কর্মরত রয়েছেন। তাঁরা নীতিমালার ওই একটি ধারার কারণে বিবেচনার বাইরে চলে যাচ্ছেন। এতে করে খাতজুড়ে একটি ‘মনস্তাত্ত্বিক’ চাপ তৈরি হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রকৌশলী বলেন, আমাদের বয়স চলে যাচ্ছে, অবসরের কাছাকাছি, অথচ দায়িত্ব নিতে পারছি না শুধু নীতির একদমই অপ্রয়োজনীয় শর্তের কারণে।” তিনি বলেন, “বিদ্যুৎখাতে এই যে নেতৃত্ব সংকট, তা আসলে কৃত্রিম। সংশোধন করতে পারলেই সমাধান সম্ভব।
২০২৩ সালের মাঝামাঝি মন্ত্রণালয় পর্যায় থেকে সুপারিশ আসে এই নীতিমালার সংশোধনের। পরিকল্পনা ছিল, ‘বিদ্যুৎ কোম্পানিতে’ নয় বিদ্যুৎ খাতে অভিজ্ঞ’ এমন প্রার্থীদেরও বিবেচনায় আনা হবে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকেও মতামত চাওয়া হয়, খসড়াও প্রস্তুত হয়। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বাস্তবায়ন হয়নি কিছুই। অভিযোগ উঠেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের নির্দেশনা থাকার পরও বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারহানা মমতাজ নীতিমালা সংশোধন না করে তরিগড়ি করে ডিপিডিসির এমডি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। তাহলে প্রকৌশলীদের প্রশ্ন এমডি নিয়োগে গোপন এজেন্ডা কার?
একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, নীতিমালাটি এতটাই কঠোর ও সংকীর্ণ যে কার্যত একচেটিয়া নিয়োগের সুযোগ তৈরি করছে। ফলে কোনো কোম্পানিতে অভিজ্ঞ জনবল থাকা সত্ত্বেও তারা এগোতে পারছে না।
প্রশ্ন উঠছে, তবে কি সচেতনভাবে একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করে রাখা হচ্ছে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নেতৃত্ব পরিবর্তন, উত্তরাধিকার তৈরির একটি প্রক্রিয়া থাকা জরুরি। কিন্তু ডিপিডিসির মতো প্রতিষ্ঠান নেতৃত্বশূন্য থাকলে পুরো সিস্টেমে স্থবিরতা নেমে আসে।
সাবেক জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মো. তামিম বলেন, নিয়ম-কানুন যদি বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না, তাহলে সেটা কেবল কাগজে-কলমেই রয়ে যায়।” তিনি আরও বলেন, “বিদ্যুৎ বিতরণ খাতে অনেক চ্যালেঞ্জ সামনে, সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বের সংকট ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা রফিকুল আলম বলেন, ডিপিডিসির মতো একটি কোম্পানি যার গ্রাহকসংখ্যা ১৭ লাখের বেশি এবং পুরো ঢাকা শহরের বড় অংশকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, সেখানে দীর্ঘমেয়াদি নেতৃত্বশূন্যতা শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, পুরো ব্যবস্থাপনাকেই অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেয়। তিনি বলেন, সরকার যদি বিদ্যমান নীতিমালাকে বাস্তবভিত্তিক করে না তোলে, তাহলে ভবিষ্যতে এমডি নিয়োগ নয়, পুরো পরিচালনাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। অভিজ্ঞ জনবল আছে, নেতৃত্ব দেওয়ার মানসিকতা আছে, প্রয়োজন কেবল বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নীতিমালার। নতুবা ডিপিডিসি শুধু একজন এমডির অভাবেই নয়, নেতৃত্ব সংকটের প্রতীক হয়ে উঠবে।
এ বিষয়ে জানতে বিদ্যুৎ সচিব ফারহানা মমতাজের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেনি। এমনকি তার দপ্তরে গিয়ে সাক্ষাত মেলেনি।
এ বিষয় বিদ্যুৎ বিভাগের প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সবুর হোসেন বলেন, মানদণ্ড সংশোধনের বিষয়টি নিয়ে উপদেষ্টা ও সচিব মহোদয়ের দপ্তর থেকে কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি। নির্দেশনা পেলেই আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, এসংক্রান্ত গাইডলাইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে।
আরএক্স/